*****************
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ব্যক্তিগত জীবনেও প্রচণ্ড হতাশা ও অবিশ্বাসের মধ্যেই যেন দিনাতিপাত করেছেন। তাঁর ২৪ বৎসর বয়সে তিনি ছবি বসুকে বিয়ে করেন, কিন্তু বিয়ের এক বছরের মধ্যেই তাঁদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তারপর ১৮ বৎসর যাবৎ তাঁর জীবন তীব্র একাকীত্বের মধ্যে কাটে । এই সময়টুকুই তাঁর জীবনের কবিমানস গড়ে ঊঠার মুখ্য সময় আর তাই ছিল তাঁর দেখা জীবনের চরম নৈরাশ্যময় অবয়ব । ১৯৪৩ সালের ২৯ মে প্রখ্যাত রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী রাজেশ্বরী বসুকে বিয়ে করেন । এই দীর্ঘ ১৮ বছরের কঠিন নিরাশাই তাঁর্র কাব্য জগতে অবসাদের বিপুল ছায়া ফেলে - এমনই ধারণা তাঁর কাছের মানুষদের ।।
ভাগ্যের এমন পরিহাসই হয়তো তাঁকে ঈশ্বর বিমুখ করে তোলে রবীন্দ্রছায়ার মোহমুদ্গরে থেকেও।
এবিষয়ে তুলসী লাহিড়ী লিখেছেন, ‘তাঁর কবিতায় ঈশ্বর জিজ্ঞাসা দ্বন্দ্বমুখর হলেও তা মানবতন্ত্রী অথচ শূন্য ও নাস্তিবাদী বৈনাশিক চেতনায় পরিব্যাপ্ত। বাল্যকালে পিতার অদ্বৈতশিক্ষার পাঠে সংশয় তাঁকে অনেকটাই জড়বাদে উপনীত করেছিল। পরবর্তীতে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সাহিত্য-দর্শন অনুশীলন তাঁর এ চেতনাকে আরও শানিত করে। বৌদ্ধদর্শনের শূন্যবাদ থেকে তিনি নাস্তিক্যবাদের রসদ পেয়েছিলেন। বৈরী বিশ্বের প্রতিকূলতা ও ব্যক্তিজীবনের ব্যর্থতাও তাঁর মধ্যে নাস্তিক্যবাদী ভাবনা উপ্ত করেছে। তিনি অর্জন করেছেন সোহংবাদ বিষয়ে ধারণা। শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধদর্শনের ক্ষণবাদে আস্থাশীল হয়েছেন। ধর্ম ও ঈশ্বর সম্পর্কে এই অবিশ্বাস আধুনিক মানুষের চিত্তে সৃষ্টি করে প্রবল সংশয়।
এযুগের কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাই ধর্ম ও ঈশ্বরের প্রতি প্রবল অবিশ্বাস করেছেন, এমনকি ঈশ্বর সম্পর্কে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতেও ছাড়েননি। কবিকে কেউ কেউ ঈশ্বরবিরোধী বা নাস্তিক্যবাদী সংজ্ঞায় ফেলতে চাইবেন’। ‘হুমায়ূন আজাদ’ তাঁর ‘আমার অবিশ্বাসে’ বলেই ফেলেছেন, ‘ত্রিশের অন্যান্য কবিরা অবিশ্বাসী হলেও সুধীন্দ্রনাথ দত্তই ঈশ্বরকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। কবি সুধীন্দ্রনাথ ইংরেজ কবি এলিয়ট দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন’।
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’র চরম নৈরাশ্যময় একটি কবিতা আসরের পাঠকদের জন্যে উদ্ধৃত করলামঃ -
----------------------
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’র কবিতা
অপচয়
-----------------------
প্রেয়সী, আছে কি মনে সে-প্রথম বাঙ্ময় রজনী,
ফেনিল মদিরা-মত্ত জনতার উল্বণ উল্লাস,
বাঁশির বর্বর কান্না,মৃদঙ্গের আদিম উচ্ছ্বাস,
অন্তরের অন্ধকারে অনঙ্গের লঘু পদধ্বনি ?
আছে কি স্মরনে,সখী, উৎসবের উগ্র উন্মাদনা,
করদ্বয়ে পরিপ্লুতি, চারি চক্ষে প্রগল্ভ বিস্ময়,
শুন্য পথে দুটি যাত্রী, সহসা লজ্জার পরাজয়,
প্রতিজ্ঞার বহুলতা,আশ্লেষের যুগ্ম প্রবর্তনা ?
সে-শুদ্ধ চৈতন্য, হায়, বৃথা তর্কে আজি দিশাহারা,
বন্ধ্যস্পর্শে পরিণত স্বপ্নপ্রসূ সে-গাঢ় চুম্বন ;
ভ্রাম্যমাণ আলেয়ারে ভেবেছিল বুঝি ধ্রুবতারা,
অকূল পাথারে তাই মগ্নতরী আমার যৌবন।।
মরে না দুরাশা তবু ; মনে হয় এ-নিঃস্ব জগতে
এতখানি অপচয় ঘটাবে না বিধি কোনও মতে ।।
------------------------
এই কবিতায়ও দেখা যায় তিনি এই জগতকেই নিঃস্বরূপে দেখছেন যা চরম নৈরাশ্যবাদীদের বিশেষ লক্ষণ, গাঢ়চুম্বনকেও তিনি বিচার করছেন বন্ধ্যস্পর্শে পরিণত স্বপ্নপ্রসূ !! কি গাঢ় তাঁর ভাবের নৈরাশ্যময়তা ! কী অভিনব তাঁর এই অবিশ্বাসের স্বরূপ !
------------------------------ (চলবে)