**********
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন আত্মযন্ত্রণার সম্মোহনে নিঃশব্দচিত্তে শব্দচারী কবি ।  তিনি জগৎকে দেখেছেন সম্পুর্ণই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে। ফলে তাঁর কবিতার সবক্ষেত্রেই নৈরাশ্য হতাশা ক্লান্তি ও অবসাদের ছাপ স্পষ্টরূপে প্রতিভাত; সবকিছু সম্পর্কেই তাঁর অবিশ্বাস,অবিশ্বাস ঈশ্বরেও। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মতো পরম ঈশ্বর বিশ্বাসী মহীরুহের ছায়ায় থেকে তিনি যে কি বিপুল শক্তিতে নিজেকে সেই মহীরুহের প্রবল ছায়া  থেকে মুক্ত রেখে নিজের আলোকে মুক্ত আকাশের ঠিকানা দিতে পেরেছিলেন তা’ ভাবলেও সত্যিই অবাক লাগে ।

তুলসী লাহিড়ী তাঁর এক রচনায় লিখেছেন, ‘মূলত, মেধা-মননের পরিচর্যায় এ সময়ের কবিরা কবিতাকে করে তোলেন অতি উচ্চ মার্গের শিল্পপ্রতিমারূপে …এক্ষেত্রে অন্যতম পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন সুধীন দত্ত। তার কবিচিত্ত সমস্ত বিশ্ব-ব্রহ্মা- ঘুরে বীজ সংগ্রহ করেই নির্মাণ করেছে কাব্যের কল্পতরু। জীবনানন্দ দাশ এ জন্যই বোধ করি তাঁকে ‘আধুনিক বাংলা কাব্যের সবচেয়ে নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা বলে অভিহিত করেছিলেন’।

দীপ্তি ত্রিপাঠী বলেছেন: ‘সুধীন্দ্রনাথের কাব্য যেন ভ্রষ্ট আদমের আর্তনাদ। তিনি স্বর্গচ্যুত কিন্তু মর্ত্যে অবিশ্বাসী। তাঁর মধ্যে বিজ্ঞতা আছে কিন্তু শান্তি নেই, যুক্তি আছে কিন্তু মুক্তি নেই। তাঁর কাব্য কোনো আশ্বাসের আশ্রয়ে আমাদের পেঁৗছে দেয় না। সুধীন্দ্রনাথের নঞ্র্থক ও পরে ক্ষণবাদী জীবনদর্শন আমাদের ধর্মপুষ্ট বাংলা সাহিত্যে এক অভিনব সংযোজন।…সুধীন্দ্রনাথের কাব্য পাঠকালে মনে হয়, কবি যেন এক নিঃসঙ্গ চূড়ায় দাঁড়িয়ে আধুনিক জীবনের নিঃসীম শূন্যতা নৈরাশ্য ভারাতুর নয়নে অবলোকন করেছেন।’

কবি সুধীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা শ্বাশ্বতী, খুবই পাঠক সমাদৃত, কতবার আবৃত্তি করেছি সেই ষোল সতেরো বছর বয়স থেকেই - এখনো মনে হয় অমন একটি কবিতা যদি নিজে লিখতে পারতাম !! কবিতাটি আসরের পাঠকদের জন্যে তুলে দিলাম :
-------------
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এর কবিতা
শাশ্বতী
------------
শ্রান্ত বরষা, অবেলার অবসরে,
প্রাঙ্গণে মেলে দিয়েছে শ্যামল কায়া ;
স্বর্ণ সুযোগে লুকাচুরি-খেলা করে
গগনে-গগনে পলাতক আলো-ছায়া।
আগত শরৎ অগোচর প্রতিবেশে ;
হানে মৃদঙ্গ বাতাসে প্রতিধ্বনি :
মূক প্রতীক্ষা সমাপ্ত অবশেষে,
মাঠে, ঘাটে, বাটে আরব্ধ আগমনী।
কুহেলীকলুষ, দীর্ঘ দিনের সীমা
এখনই হারাবে কৌমুদীজাগরে যে ;
বিরহবিজন ধৈর্যের ধূসরিমা
রঞ্জিত হবে দলিত শেফালি শেজে।
মিলনোৎসবে সেও তো পড়েনি বাকী,
নবান্নে তার আসন রয়েছে পাতা :
পশ্চাতে চায় আমারই উদাস আঁখি ;
একবেণী হিয়া ছাড়ে না মলিন কাঁথা।

একদা এমনই বাদলশেষের রাতে—
মনে হয় যেন শত জনমের আগে—
সে এসে সহসা হাত রেখেছিল হাতে,
চেয়েছিল মুখে সহজিয়া অনুরাগে ;
সে-দিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া
মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে ;
অনাদি যুগের যত চাওয়া, যত পাওয়া
খুঁজেছিল তার আনত দিঠির মানে।
একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী ;
একটি নিমেষে দাঁড়ালো সরণী জুড়ে,
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি ;
একটি পণের অমিত প্রগলভতা
মর্ত্যে আনিল ধ্রুবতারকারে ধ’রে
একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা
প্রলয়ের পথ ছেড়ে দিল অকাতরে।।

সন্ধিলগ্ন ফিরেছে সগৌরবে ;
অধরা আবার ডাকে সুধাসংকেতে,
মদমুকুলিত তারই দেহসৌরভে
অনামা কুসুম অজানায় ওঠে মেতে।
ভরা নদী তার আবেগের প্রতিনিধি,
অবাধ সাগরে উধাও অগাধ থেকে ;
অমল আকাশে মুকুরিত তার হৃদি
স্বাতি মণিময় তারই প্রত্যভিষেকে।
স্বপ্নালু নিশা নীল তার আঁখি-সম ;
সে-রোমরাজির কোমলতা ঘাসে-ঘাসে ;
পুনরাবৃত্ত রসনায় প্রিয়তম ;
কিন্তু সে আজ আর কারে ভালোবাসে।
স্মৃতিপিপীলিকা তাই পুঞ্জিত করে
আমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরীর কণা :
সে ভুলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে
আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না ।।

------------------------------- (চলবে)