সেই একটা সময় যখন সারাক্ষণই কবি, কবিতা ও কবিতা আবৃত্তি নিয়ে দিনের সিংহভাগই  যেতো কেটে - সেই সময়ে কী এক উত্তাল সময়ও গেছে সারা দেশে - তবু নিভৃতে একে একে সুধীন্দ্র, বিষ্ণু, অমিয়, জীবনানন্দ, অন্নদাশংকর, নজরুল পড়ে  ফেলার এক গোগ্রাসী প্রতিযোগিতা ছিল - তার যত না পাঠক্রমের চাহিদা মেটাতে- তারচে' অনেক বেশী মনের ক্ষুদা মেটাতে । রবীন্দ্রনাথ শেষ তো কবেই হয়ে গেছে; একের পর এক রচনাবলী, শরৎচন্দ্র, শরদিন্দু, মাণিক, বনফুল, যাযাবর - আহা কী সেই দিন- কী সেই সময় !!

এই চার মেধাবী কবির মধ্যে অমিয় ও জীবনানন্দ আমার বিশেষ প্রিয়।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও অমিয় চক্রবর্ত্তী'র কবিতা সম্পর্কে বলেছিলেন, ' অনুভূতির বিচিত্র সুক্ষ্ম রহস্য'; বুদ্ধদেব বসু তাঁর উপাধি দিয়েছিলেন-'কবির কবি' রূপে, আর শিবনারায়ন রায় ডেকেছিলেন 'বিশ্বপথিক' রূপে ।।
এই চার কবির প্রত্যেকেরই প্রথম দিকের কবিতায় রবীন্দ্র প্রভাব সুস্পষ্ট, যদিও ওঁরা সযতনে রবীন্দ্র প্রভাব এড়ানোর বহুলপ্রয়াসী ছিলেন ।

কবি অমিয় চক্রবর্ত্তীর সুবিখ্যাত 'বৃষ্টি' কবিতাটি এতোবার পাঠ করেছি যে এখনো কবিতাটি মুখস্থ রয়ে গেছে - ৩০ বছর পড়েও  ।

'কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে।
ফাল্গুন বিকেলে বৃষ্টি নামে।
শহরের পথে দ্রুত অন্ধকার।
লুটোয় পাথরে জল, হাওয়া তমস্বিনী;
আকাশে বিদ্যুৎজ্বলা বর্শা হানে
ইন্দ্রমেঘ;
কালো দিন গলির রাস্তায়।
কেঁদেও পাবে না তাকে অজস্র বর্ষার জলধারে।
নিবিষ্ট ক্রান্তির স্বর ঝরঝর বুকে
অবারিত।
চকিত গলির প্রান্তে লাল আভা দুরন্ত সিঁদুরে
পরায় মূহুর্ত টিপ,
নিভে যায় চোখে
কম্পিত নগরশীর্ষে বাড়ির জটিল বোবা রেখা।
বিরাম স্তম্ভিত লগ্ন ভেঙে
আবার ঘনায় জল।
বলে নাম, বলে নাম, অবিশ্রাম ঘুরে-ঘুরে হাওয়া
খুঁজেও পাবে না যাকে বর্ষায় অজস্র জলধারে।
আদিম বর্ষণ জল, হাওয়া, পৃথিবীর।
মত্ত দিন, মুগ্ধ ক্ষণ, প্রথম ঝঙ্কার
অবিরহ,
সেই সৃষ্টিক্ষণ
স্রোত:স্বনা
মৃত্তিকার সত্তা স্মৃতিহীনা
প্রশস্ত প্রচীর নামে নিবিড় সন্ধ্যায়,
এক আর্দ্র চৈতন্যের স্তব্ধ তটে।
ভেসে মুছে ধুয়ে ঢাকা সৃষ্টির আকাশে দৃষ্টিলোক।
কী বিহ্বল মাটি গাছ, দাঁড়ানো মানুষ দরজায়
গুহার আঁধারে চিত্র , ঝড়ে উতরোল
বারে-বারে পাওয়া, হাওয়া, হারানো নিরন্ত ফিরে-ফিরে-
ঘনমেঘলীন
কেঁদেও পাবে না যাকে বর্ষায় অজস্র জলধারে।'

                                                                (চলবে)