বনমল্লিকার নাম হয়তো আপনারা শুনে থাকবেন;
নামটির মধ্যে বেশ একটা আর্তি আছে,
একটা উদোম বন্যতাও থাকতে পারে;
কিন্তু এ বনমল্লিকা সে বনমল্লিকা নয়।
কাজেই নামটিও আপনাদের অজানা থাকাই স্বাভাবিক।
শহরের এক বনেদি ঘরেই জন্ম হয়েছিল তার
প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে মা-বাবাও যেমনটি ভেবে থাকেন-
ছেলে হলে মল্লার আর মেয়ে হলে মল্লিকা ...
এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
তার জন্মক্ষণে শাঁখ বেজেছিল বটে তবে তা নিতান্তই ভুলবশত।
জন্মের কিছুক্ষন পরেই জানা গেল -
তার কোনও লিঙ্গ পরিচিতি নেই; সে অজনিকা।
বাড়িতে বিষাদের সুর আর চাপা গুঞ্জন
-শিশুটিকে ফেলে আসবে কোথাও?
না; ফেলে আসতে হয়নি কষ্ট করে।
বাতাসের কান যেমন সবকিছুই শুনে নেয়
তেমনি খবর পৌঁছে দিতেও তার জুড়ি মেলা ভার।
একদল বৃহন্নলা এসে তাকে তুলে নিয়ে গেল আনন্দ আগ্রহে।
মা-বাবার শাপমুক্তি ঘটলো!
যাবার আগে অবশ্য ওরা বলেছিল-
শিশুটি আসলে মেয়ে প্রজাতির ক্লীব।
-নাম রেখেছ তোমরা কিছু
সোনামুখী... চন্দ্রমুখী...?
কাঁদতে কাঁদতে মা বলেছিল –
ভেবেছিলাম মেয়ে হলে মল্লিকা আর ...
ওরা বলল- ঠিকাছে, ঠিকাছে; ওটাই হবে-
বনবাসী মল্লিকার নাম রেখে দে বনমল্লিকা।
হাসতে হাসতে, গা দুলিয়ে নাচতে নাচতে চলে গিয়েছিল ওরা।
বনমল্লিকা এখন আগত যৌবনা,
চোখে কাজল টানে, লিপস্টিক দেয় ঠোঁটে,
কানে বড় আকারের দুল আর দুহাতে একগাদা চুড়ি।
উৎসবের সময় ডাক পড়ে বনমল্লিকার।
গানের তালে তালে নেচে ওঠে সে,
লোকে বলে হিজড়ে-নাচ।
ভিড়ও হয় প্রচুর!
উদ্ভ্রান্ত মত্ত যুবকেরা ওকে প্রকাশ্যে চুমু খায়,
আদর করে,
অন্তরালে নিয়ে গিয়ে দলিত মথিত করে;
বনমল্লিকার ভাল্লাগেনা।
তবে এতদিনে সে জেনে গেছে-
হিজড়েদের সম্মান থাকতে নেই,
লজ্জা থাকতে নেই,
এমনকি থাকতে নেই কোনও প্রতিরোধ।
ইতিমধ্যে সে দু’একবার বাড়িতেও ঘুরে এসেছে
জন্ম ভিটে বলে কথা!
লোকে বলেঃ ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’...
কিন্তু অভিজ্ঞতায় সে বুঝে গেছে যে
বাড়িতে সে একেবারেই অনভিপ্রেত...
বুকে অসীম কষ্ট নিয়ে দিন কাটে বনমল্লিকার
অজনিকা মায়েরা তাকে ভালবাসায় ভরিয়ে দেয়
আর শিখিয়ে দেয়
অনন্ত কষ্টের দলা গিলতে গিলতে
কিভাবে হো হো করে হাসতে হয়,
নাচতে হয়,
গাইতে হয়...
কিন্তু এ বনমল্লিকা সে বনমল্লিকা নয়।
মন খারাপ করা উদাস দুপুরে
পুকুর পারে বসে
তার ঢিল ছুড়তে ইচ্ছে করে;
খুব আদর খেতে ইচ্ছে করে
তবে সেই উন্মত্ত যুবকদের আদর নয়
রাজকুমারের আদর...
পক্ষিরাজ ঘোড়ায় উড়ে এসে
সে তার চোখে পরিয়ে দেবে প্রেমের সুরমা,
জড়িয়ে ধরবে সজোর ঘনিষ্ঠতায়।
সমকামীদের আন্দোলনে দিগ্বিদিক তোলপাড়
ছেলেরা ছেলেদের আর
মেয়েরা মেয়েদের বিয়ে করার অধিকার চাইছে
অথচ কী কপাল নিয়েই সে জন্মেছে!
অজনিকা মায়েরা আরও একটি শিশুকে নিয়ে এসেছে
- মেয়ে প্রজাতির ক্লীব।
কিছু আগেই সে জেনে গেছে
তৃতীয়প্রকৃতিকেও মানবিক স্বীকৃতি দিয়েছে মহামান্য আদালত।
এই শিশুটিকে সে আর নাচুনে হতে দেবে না;
সে ওকে স্কুলে পাঠাবে;
নাম দেবে অরুন্ধুতি; মায়ের নাম বনমল্লিকা।
সে ওকে মানুষের মতো মানুষ করে তুলবে,
বিয়েতে সানাই বাজবে আকাশে বাতাসে
বছর যেতে না যেতেই কোল জুড়ে ফুটফুটে একটা ...
না, না; একটু হয়তো বেশিই ভেবে ফেলেছে সে,
স্বপ্নের উড়ান বুঝি এমনই হয়,
......লাগামছাড়া।
ভাবতে ভাবতে তার চোখে জল চলে আসে।
নিজেই চোখের জল মুছে নেয় সে।
ক্লীব-মায়েরা তার আবদার শেষ পর্যন্ত মানবে তো?
তবু এই যে ভাবনাটুকু সে ভাবতে পেরেছে
সেই অনুভবে
তার দু’চোখ বেয়ে আবার জল নেমে আসে,
আবার... আবার... আবার জল নামে...
-আনন্দের অমলিন জল;
বিরল সংগ্রামের এক প্রত্যয়ী অশ্রুধারা...