অজপাড়াগাঁয় জন্ম আমার, বাবার দোকানদারি,
গৃহবধূ মা-ও বাবার যোগ্য সহকারী।
আমার ছোট ভাই ছিল এক, আমি তখন তেরো,
স্কুলে যাই, স্বপ্ন দেখি, মায়ের আদরেরও
ভাগ ছাড়ি না, ভাইয়ের সাথে খুনসুটি দিনরাত।
সময় আঁকে শরীর জুড়ে চিহ্ন অকস্মাৎ!
মা ডেকে নেয় ঘরের ভিতর, শেখায় সামলে চলা;
ঘুম আসে না, যন্ত্রণা হয়, মাকেই শুধু বলা
যায় সে কথা; সময় চলে- থামতে জানে না সে।
নবম শ্রেণীর প্রথম হয়ে দিন কাটে উল্লাসে।
বাবার চোখে স্বপ্নের ঘোর- ‘একটি বছর বাদে
মাধ্যমিকে জেলার সেরা’- কল্পিত সংবাদে।
*************************
আমি তখন চতুর্দশী, তখন জ্যৈষ্ঠ মাস;
গ্রীষ্মকালীন দীর্ঘ ছুটি; মায়ের অভিলাষ
-কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসি মামার বাড়ি গিয়ে;
ইচ্ছে পূরণ হবে মায়ের, নিজেই যাবে নিয়ে।
সঙ্গে কিছু বই নিয়েছি; পড়ার সরঞ্জাম
ছাড়লে কি আর চলবে খেয়ে পাকা কাঁঠাল, আম!
মামার বাড়ি খুব দূরে নয়, হেঁটেই যাতায়াত,
পথিকজনও পরিচিত, কি দিন কিবা রাত।
দুপাশ জুড়ে ফসলি ক্ষেত, তখন বিকেল ক্রমে
পড়ছে ঢলে, চলছি হেঁটে মা-মেয়ে বিক্রমে।
হায়রে কপাল! পথের মাঝেই ভিনদেশি চার-পাঁচ
যুবক এসে ধরল ঘিরে, ছিল না আন্দাজ
কী চায় ওরা; ওদের চাওয়া জানত ওরাই ভালো-
আমরা দুজন, মা আর মেয়ে, দেখেছি মিশকালো
বর্বরতার নৃশংস রূপ, মায়ের চেতন হলে
মাটির পরে পা বিছিয়ে আমায় অকুস্থলে
শুশ্রূষাতে ভরিয়ে দিয়ে বলল কানে কানে
-‘জ্ঞান ফিরেছে? এসব কথা কেউ যেন না জানে;
ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না, মামার বাড়িই চল,
কয়েকটা দিন কেটে গেলেই ফিরবে মনের বল’।
**************************
সেই থেকে মাস দুয়েক হল হইনি রজস্বলা,
মায়ের নাকি কঠিন ব্যামো, বন্ধ চলা-বলা।
কদিন বাদেই অমরলোকে চলল মায়ের গাড়ি,
ভাবছি বসে মায়ের পথেই আমিও দিই পাড়ি-
এমন সময় বুকের ভিতর কার যেন আবদারে
চমকে উঠি –‘মা! সেদিনের পশুর অত্যাচারে
আমার জন্ম; ভীষণ ইচ্ছে, আসব তোমার কোলে-
মৃত্যুদণ্ড দিও না মা, অবাঞ্ছিত বলে’।
****************************
সে ডাক শুনে ঘর ছেড়েছি নিরুদ্দেশের পথে-
প্রলেপ দিতে আসবে কি কেউ কপাল পোড়া ক্ষতে?
***************************
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এক মমতাময়ী
মায়ের চোখের দৃষ্টি আমায় করেছে প্রত্যয়ী।
সব শুনে সে বলল ‘বাছা, আমাদের আশ্রমে
মেয়ে হয়েই থাকবে তুমি, দেখবে ক্রমে ক্রমে
তোমার কোলে আলোক হয়ে হাসবে আগন্তুক!
সেই কথাটি ভেবেই কাটুক দিনগুলি উন্মুখ।
**************************
আমার এখন চল্লিশে পা, ছেলের পঁচিশ পার,
ক’মাস আগেই চাকরি পেল- গ্রুপ বি অফিসার।
*************************
বাবা, তুমি কেমন আছো; কেমন আছে ভাই?
আমার কথা ভুলেই গেছ- কিছুই মনে নাই?
কী আর আমার করার ছিল? লজ্জা পেতে প্রানে;
সারা জীবন কাটত সবার তীব্র অসম্মানে।
এই জীবনে স্বপ্ন পূরণ হয় কি সবার, বলো?
আমার স্বপ্ন ছেলেই এখন; জীবনের সম্বলও।
ছেলের কাছে সব বলেছি জীবন ইতিহাস;
আমাদের এই আশ্রমে সব ধর্ষিতাদের বাস।
বিয়ের জন্য বলছি কতো, হচ্ছে না সে রাজি,
-ধর্ষিতা সব মায়ের জন্য জীবন রাখবে বাজি।
উপার্জনের সবটুকু তার আশ্রমে দেয় ঢেলে।
এক জীবনে আর কী চাওয়া, এমন রত্ন পেলে!
**************************
কিশোরী মা বলেই ডাকে সকল আশ্রমিক।
সময় চলে আপন মনে টিকটিক, টিকটিক...