আমি সেই মেয়ে যে মাতৃ জঠরে খুন হতে হতে হইনি।
ভ্রুণে মরিনি বলে জন্মের সময় মুখে নুন দিয়ে প্রাণে মারার নিদান দিয়েছিল কেউ।
জন্মের সময় মুখে মধু দিতেও ভুলে গেছিল বাড়ির লোকজন,
শঙ্খ ও উলু পড়েনি আমার জন্মক্ষণে, বাজেনি মঙ্গলঘণ্টা।
“ইবারো বিটি” – বলে বাপ-মায়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়েছিল।
কলিকাল তাই হয়ত যোগমায়া হতে হয়নি।
কলির কোনো কেষ্টকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়নি আমায়।
বুড়ো ঠাকুরদা বলেছিল মাটির হাড়ি করে জলে ভাসিয়ে দিতে।
অভাবের সংসারে দুই দিদির পিঠে আবার আমি,
আমি সেই মেয়ে যে পরিবারের সবার বোঝা।
হিন্দু মুসিলিম সব ধর্মই নারীকে পড়িয়েছে বেড়ি।
নারী অন্তঃপুরবাসী, ইসলামে তার মসজিদে যাওয়া নিষেধ। সনাতন ধর্মে নিষেধ অনেক কিছুতেই।
সবাই বলতো বিটি না মাটি, তার উপর গায়ের রং আবার চাপা।
নাম রাখা হল ‘ফেলি’
সবাই বলতো ফেলি, যমে নিলেও গেলি আর পরে নিলেও গেলি।
যমের অরুচি হয়ে বেঁচেই গেলাম,
আমি সেই মেয়ে যে ফেলনার মতই কাদা মাটি ঘেটে মানুষ হয়েছিলাম।
পাড়ার ইস্কুলে মিড-ডে-মিল খেয়ে প্রাইমারি স্কুল যখন শেষ হলো।
বাবা বললো, মেয়েছেলের আর পড়ার দরকার নেই।
দুই দিদির মত এখানেই পড়া শেষ তোমার।
দিদিদের তেরোতেই বিয়ে হয়েছে, এবার ফেলির পালা।
এক ছুটে সেদিন চলে গেছিলাম স্কুলের মতি মাস্টারের কাছে,
পড়াশোনায় মন্দ ছিলাম না,
এই নিশ্চিন্তপুর গাঁয়ের ইস্কুলে আমার আগে কেউ বৃত্তি পাইনি।
মতি মাস্টার তাই খুব স্নেহ করতো আমায়।
সেদিন সন্ধ্যায় মতি মাস্টার বাড়ি বয়ে এসে বাবাকে বুঝিয়ে গেল।
বাবা তবুও বোঝেনি।
সুকেশ ঘটককে তলে তলে লাগিয়ে দিল।
যেদিন বিয়ের দিন ঠিক হলো, সেদিন ছিল আমার পুতুলের বিয়ে।
আমাকে ভুল বুঝিয়ে বলা হয়েছিল পুতুল বিয়ের জন্যে আয়োজন।
যখন বুঝলাম আমারই বিয়ে আজ তখন বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা,
বাড়ি থেকে পালিয়ে এক দৌড়ে গেলাম মতি মাস্টারের বাড়ি।
আমার কান্নায় মতি মাস্টার কি বুঝলো জানিনা।
শেষে বিডিও আর পুলিশ এসে সেদিন আমার বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছিল।
বাপ-মায়ের মুখ পুড়িয়ে আমি লগ্নভ্রষ্টা হলাম।
বিডিও আর পুলিশ বাপ-মা কে বুঝিয়ে বড় স্কুলে ভর্তি করালো,
এর পর মাধ্যমিকে আমি জেলার মধ্যে হলাম প্রথম।
আমি নাকি সবার গর্ব এই বলে হেডস্যার বুকে টেনে নিয়েছিল।
অনেক বড় হতে হবে আমায়... অনেক বড়।
এরকম অনেক ফেলি পেটের মধ্যেই খুন হয়,
কুঁড়িতেই নষ্ট হয় শৈশব,
রান্নবাটি খেলা ছেড়ে সংসারের ঘানি টানতে হয়,
আমি ফেলি নাকি সবার গর্ব!
চোখের সামনে অনেক দৃশ্যপট হাজির হল,
অনেক ফেলি ঘিরে ফেললো আমার চারিপাশ।
সমাজে অনেক ফেলি হারিয়ে যাচ্ছে।
আমি সেদিন হেড স্যারের পা ছুঁয়ে শপথ করেছিলাম,
সব ফেলিদের স্বপ্ন আমি সফল করবোই।
ইতিহাসে ফেলিদের কথা লেখা নেই,
লেখা নেই মহাকাব্যেও।
আমাদের কথা কেউ লিখে রাখেনি।
কৃষ্ণ মানে ননীগোপালের জন্য দুধের শিশু যোগমায়াকে অবলীলায় মেরে ফেলেন মহাকবি ব্যাস।
আমাদের মেরে ফেলতে কাঁপে না কবির কলম।
ডাক্তারের নিপুন হাত আমাদের অঙ্কুরেই বিনাশ করে।
সে দিক থেকে আমি ভাগ্যবান।
তবুও ভয় হয়,
নির্ভয়ারা আজও শিকার হয় পিশাচের।
শ্বসুড় বাড়িতে আত্মঘাতী হয় নববধু।
গৌরী লঙ্কেশ কেও প্রাণ দিয়ে প্রমান করতে হয় সাহসিকতা।
শবরীমালার আয়াপ্পান স্বামীর কাছে আমরা ব্রাত্য।
কিন্তু সে এক দিন ছিল আমাদের,
দেবী দুর্গাও নারী ছিলেন, অস্ত্র হাতে রক্ষা করেছিলেন ত্রিভুবন।
বেদের যুগে অপালা লোপামুদ্রা তোমরাও ছিলে।
ইতিহাস মনে রেখেছে রিজিয়া আর লক্ষীবাঈকে।
তবুও সহমরণে আমাদের সতী করেছো, নিয়েছো সীতার অগ্নি পরীক্ষা।
দ্রোপদীর কাপড় খুলেছো রাজদরবারে।
তুমি, তুমি, তোমরা তারিয়ে তারিয়ে পড়েছো,
দেখেছে গোটা হস্তীনাপুর।
মনেপড়ে সীতা হয়ে জন্মালাম যখন,
বাবা মায়ে মাটির কলসীতে করে
পুঁতে দিয়েছিল চাষের জমিতে।
শেষে সেই মাটিতেই মিশে যেতে হয়েছিল আমায়।
তবুও তোমাদের সন্দেহ দূর করতে পারিনি আজও।
অভিশাপে পাষান হতে হল সুন্দরী অহল্যাকে।
কাব্যে সাহিত্যে ছত্রে ছত্রে অপমান করেছো আমায়।
পুরুষার্থ পালনে নারী অনুসঙ্গ মাত্র।
আজও ফেলিদের অনেক অবজ্ঞা সয়ে বড় হতে হয়।
গর্জে উঠতে হয় পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে।
এভাবেই ফেলিরা বেড়ে উঠুক,
কবির কল্পনায় নয় বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে।