চোখ মেলে দেখি,আগুন জ্বলছে ঘরের চালায়,
বাবার দেহ দুয়োয় নিথর,মায়ের শরীর মৃত আঙিনায়,
- বাবা -বা-বা,মা-মা মা মা- ছুঁয়ে দেখলাম জীবন,
না মৃত্যু,চিৎকার করে উঠলাম ' হে ঈশ্বর '..
আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে অথচ চোখে জল নেই,
বুকে ব্যাথ্যা নেই..
ছুটতে লাগলাম,উঠোন ভর্তি ছাই গাদা,চতুর্দিক ধোঁয়াময়..সব ডিঙিয়ে সব ফেলে এসে দেখি জেঠিমা শুয়ে রাস্তায়,কোনো প্রাচীর নেই আমাদের ভিটায়,মৃত ভাই,বোন - নয়ন,শ্যামল সঙ্গে শুয়ে দুধের শিশু,মারা গেছে ভোর বেলায়..সারা শহরে আগুন লেগেছে বোধহয়,আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে অথচ চোখে জল নেই,বুকে ব্যাথ্যা নেই..
ছুটতে লাগলাম,যতদূর চোখ গেল কেবলই আগুন,মৃত দেহ..নেই জীবন্ত কেহ,সব ফেলে পালিয়ে যাচ্ছি,একে একে বাঁশবন,দুখুদের কাঁঠাল তলা..জোড়া পুকুরের কলমিখেত,হাজারদুয়ারী..অখিলের দোকান,সব ফেলে ছুটছি কেবল,কেবলই আগুন,দাউ দাউ করে পুড়ছে সব..
বুড়ো মন্দির এর সামনে এসে হাঁপিয়ে গেলাম,চেয়ে দেখি সিঁড়িতে বসে হাত পাখা নিয়ে হওয়া খাচ্ছেন ঈশ্বর..বা হাতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হাসলেন তিনি,কি বিচ্ছিরি গা জ্বলছে আমার..কি ভীষণ পাশবিক হতে ইচ্ছে হচ্ছে...
তাঁর চোখ চোখ রেখে স্বজোরে বিদ্রোহ ঘোষণা করলাম, হেকে উঠলাম 'এ আপনি কি করলেন! কি ভাবে করতে পারলেন ? ' আপনার সারা গায়ে রক্ত !!'
তিনি আবার হাসলেন ' তাঁর হাসির আঘাতে এক লক্ষ্য কথোড রশ্মি বয়ে গেল হৃদপিণ্ডে,যেন আমার আর্টারি তে খুর চালাচ্ছে কেউ..
তিনি বললেন ''ডিলিট করছি সমস্ত অপ্রয়োজন..স্থাবর অস্থাবর আমার প্রিয়জন খোয়া গেছে অসময়'' তাঁর ডান হাতের পিলার খানা সজোরে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে,এবং এক টুকরো ইট ছুল কনুই..
তিনি বললেন ''কুনো ব্যাঙের রক্ত সংবহন,সিলেবাসে প্রয়জন ?''
"মিউরিদায়ির বসত বাড়ি ভেঙে বানাও তোমার বাড়ি কংক্রিটে এ কোন আয়োজন ?"
"ধর্মে নামে পরব দিনে ২২মাসের বাছুর কিনে করেছ জবাই,কবে বলেছি আমি এ সবুজ নিরামিষ,এ দেহ আমিষ,হ্যা খেলে খাওয়া যায় ? "
উত্তর গোছালাম,না প্রশ্ন ভুলে গেলাম,না ভুল শুনলাম,
বুঝতে পারছি না..
চেয়ে দেখলাম,ঈশ্বর হাসছেন এখনো,তাঁর চতুর্দিকে হাজারের কুনোব্যাং,সারা বারান্দা জুড়ে ক্ষুর কাঁচি নিডল..
তাঁর প্রশ্ন খুঁজে পেলাম না,উত্তর বহুদূর..
বললাম সব্বাই কে হত্যা করে আমায় কেন জীবিত রেখেছেন ! 'আমিই কেন' ?
তিনি আবারও ঘড়ি দেখলেন,বললেন "কেবল আমিই পারতাম সব টুকু সবুজ বুনে দিতে ?,কেবল আমিই পেরেছি চিরহরিৎ বুক জুড়ে জ্বালাতে দাবানল?''
এসব প্রশ্নে গা গুলোচ্ছে যেন, চোখ সরিয়ে নিলাম চোখ থেকে,তাঁর থেকে নিস্তার প্রয়োজন,ছুটতে শুরু করলাম,ছুটতে ছুটতে দুপুর গড়িয়ে গেল,এগারো তিস্তা ঊনত্রিশ ডুয়ার্স,খাল বিল নদী পেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম হিমালয়ের চুড়োয়..
এ জীবন নিরর্থক,আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে,অথচ! ঝাপিয়ে পড়লাম সর্বোচ্চ পিক থেকে.. যেন ভাসছি,যেন মায়ের মুখ ভেসে আসছে,এবং আমি ভেসে যাচ্ছি,ভাসতে ভাসতে পৌঁছলাম এক সাহারায়..অরণ্য ঘন,ঠায় দাঁড়িয়ে ইউরেশিয়ান তৈগা যেন-চারদিক বিছানো ঘাসের চাদর,খেলে বেড়াচ্ছে ৮হাজার কিমি হেঁটে আসা লক্ষাধিক ধূসর খয়েরি ওয়াগ্লভোগেন..
মাথার ভিতরে কেরোসিনের সলতে যেন জ্বলে,হওয়ায় দোলে-এবং ঈশ্বর,কুনোব্যাং..
কী ভীষণ গা গুলোচ্ছে,বুঝে উঠতে পারছি না ঈশ্বরের পছন্দের কুনোব্যাং !
ছুটতে ছুটতে পৌঁছলাম আইভরি কোস্ট সীমান্তে,
নেই মানব নেই দানব নেই তারকাটা বেড়া ঘেরা কোন দেশ,দিগন্ত..
দেখি মিস ওয়াল্ড্রন'স রেড কোলোবাস ঘিরে ধরেছে আমায়,
এবং প্রত্যেকেই বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে আমায়-আমি অধম,একাকী অসহায়,পাশ কাটিয়ে লাইবেরিয়ার দিকে ছুটে চলেছে সহস্র বলগা হরিণ..এবং আমি নিয়েছি পিছু..
ছুটতে ছুটতে চলে এলাম উত্তর মেরু,এখানে ভীষন অন্ধকার,গভীর এক রাত এবং কেঁপে উঠছে হৃদপিণ্ড ঠান্ডায়..আমার বাবার মুখ মনে পড়ছে ভীষন..ঝাঁকে ঝাঁকে উইপোকা খেলে বেড়াচ্ছে বরফের গা বেয়ে এবং কুমির;না না টিকটিকি..বাড়ি যেতে ইচ্ছে হচ্ছে,
নয়তো বাড়ি থেকে খানিকটা দূর..
' ওই যে বাবা উঠোনে শুয়ে '
ছুটতে ছুটতে পৌঁছলাম মিশরের দিক,
সূর্য এখনো পশ্চিমে ঠিক,সম্মুখে তুতেন খামেন জ্বলছে আগুনে,
ইট পিরামিড তলিয়ে যাচ্ছে ভু গর্ভে,আমাকে তাড়িয়ে আসছে খামসিন,আমি দৌড়াচ্ছি,পালাচ্ছি,দৌড়তে দৌড়তে পৌঁছে গেছি নীল নদের পার,
দেখি ঈশ্বর হেঁটে আসছেন;না না আমি এগোচ্ছি..
নাহ! আমি বুঝে উঠতে পারছি না,তিনি আসছেন না আমি এগোচ্ছি তাঁর দিকে..!
ঈশ্বর আমার সমুক্ষে,তাঁর গাল বেয়ে রক্তের মত লাল,লাখ লাখ কুনোব্যাং চতুর্দিকে তাঁর,ঝাঁকে ঝাঁকে সবুজ ময়ূর উড়ে বেড়াচ্ছে সারাটা আকাশ,আমি কাঁদতে পারছি না,অথচ আমার গলায় অদ্ভুত বেদন,নদীর পারে সোনালী ধান,হওয়ার দোলায় খেলছে চড়ুই।
নত হলাম,আমি ক্লান্ত এবং মৌন..
তিনি হাসছেন,তাঁর ডান হাতে পাখা,বাম বুকে ক্ষত,
সারা দেহ ক্ষতবিক্ষত..
©সুমন