আমার একটা বেদনার দিঘী ছিল – দেখতে দেখতে ওটা সাগর হয়ে গেল।
শুনেছি তখন আমার দুই বছর-
অহিংসার সাধক আমার বাবা পুড়ে গেল বন্ধুর হিংসাযজ্ঞে,
জীবনে পায়নি ‘বুদ্ধ-শান্তি’, মরণে পেল
আমার বেদনার ছোট্ট দিঘীটাও সেইদিনই তৈরী হল।
তারপর মা, আমার চিরবঞ্চিত-শৈশবের সর্বত্রাতা বিপদনাশিনী মা,
স্বামীর লাল চিতা নিবে গেছে ঠিকই,
কিন্তু শাড়ি বেয়ে সাদা আগুন লেগে গেছে সমস্ত সত্ত্বায়
দশদিক ভরে গেছে পাহাড়ের মত অনড় শ্বেত-আগুনে
পড়শি পুরুষের ছোঁক-ছোঁক, স্বামীর ভিটায় আত্মীয়দের চোখ,
অর্ধাহারে শিশুপুত্র - কতবার যে সতীদাহ হল
মাথার আর কী দোষ – এভাবে কতদিন ঠিক থাকে?
তাও দিন কাটছিল,
কিন্তু যেদিন মা সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেল
আমার বেদনার দিঘীটা একলাফে নদীর রূপ নিল।
দেখতে দেখতে দেড় যুগ হতে চলল-
প্রতি বছরের মত চৈত্রসংক্রান্তিতে পুকুরে নেমে ডাব খাব, হঠাৎ -
ডাবের জলে একটা ছায়া – একটা জলরঙা মেয়ের ঘোর লাগানো ছায়া
ও এল, জলের মতই কলকল উচ্ছ্বল – আমার নিবু এল,
কিছুই না-পাওয়া জীবনে এই প্রথম বুঝলাম - পাওয়া কাকে বলে
টের পেলাম অলির আনন্দ
কদিনের জন্য বেদনার নদীটা আমার শুকিয়েই গেল ।
যাবার সময় জোড়া শালিক সাক্ষী করে নিবু বলে গেল-
আসছে চৈত্রসংক্রান্তিতে তোমাদের সিঁদুরে আমগাছতলায় সিঁদুর পড়ব
কণ্ঠীবদলের পালা হবে।
অলির আনন্দ শেষে শুরু হল চাতকের আকাশ চাওয়া
হায়, একে একে কেঁটে গেল আঠারোটি সংক্রান্তি-
সিঁদুরে আমগাছে সিঁদুরে আম ধরে
সিঁদুর পড়া কেউ আসে না – আমার একলা ঘরে।
এই আঠারো বছরে আমার বেদনার নদীটা আঠারোটি সাগর হয়ে গেছে।