জগৎ সৃষ্টির পর জীব সৃষ্টির সেই আদি লগনে,
শ্রষ্টাপুরুষ বসলেন অতিদীর্ঘ এক ধ্যানাসনে।
তাঁর সেই দীর্ঘতর ধ্যানের প্রাক্কালে, সঙ্গোপনে
জীবের এক আশ্চর্য লীলার ছবি অতি সযতনে,
আঁকলেন মনোমাঝে আপনার মনোমত করে।
শ্রষ্টার সেই ইচ্ছার পূর্ণতা দিতে, দীর্ঘকাল ধরে
চললো জীবের মাঝে লীলাময় জীবনের খেলা;
অমনি শুরু হলো সভ্যতার মহাবিস্ময়ের পালা।
সেদিন সেই খেলার যাত্রাকালে মানুষ-জন্তু-সব
ছিল পশুত্বে একাকার; কেবা পশু কেবা মানব
ছিলনাকো ভেদ। বিবর্তনের এক সুদীর্ঘ পথে
বহুকাল হেঁটে; মানুষ উঠে এলো সভ্যতার রথে।
পরে অসভ্য নির্বাক মানুষের মুখে ফুটল ভাষা,
নরের প্রাণে জন্ম নিল আধিপত্যের পিপাসা।
শুরু হলো সভ্য-অসভ্যের জোর কাছিটান খেল,
হারজিতের সেই খেলায় আজকের পশুকূল—
পরাজয় মেনে হয়ে গেল আজন্ম মানুষের দাস!
বুদ্ধির লড়াইজয়ী নর, ছিঁড়ে পশুত্বের খোলস
মানুষ হয়ে বেরিয়ে এল; কণ্ঠে ধরে বাণী—
যাদের শাসনে মত্ত আজ এই বিশ্বজগৎ খানি।
সেদিনের সেই হারজিত খেলায় জেতা মানুষ;
অন্তরে অন্তরে জাগ্রত করল পশু শিকারের হুঁশ।
বনের হিংস্র পশুর মতোই পশুর মাংসের লালসা,
নিয়ত নরের প্রাণে জাগিয়ে তোলে রসনার তৃষা।
তারপর শুরু হলো মানুষের পশু শিকারের খেলা,
সাথে পশুপালনের সুবুদ্ধিও হয় তাদের মেলা।
ক্রমে ক্রমে পশুশক্তি হলো আয়েসের মূলাধার
পশুবধের বেলায়ও তাদের ধারতে হয়নি ধার।
ধার কেন ধারবে মানুষ, কৈফিয়তই কে নেবে?
শ্রেষ্ঠর সাথে পাল্লা দিতে কে আছে— কে দেবে?
খেয়ালি এই খেলার ফাঁকে মানুষের আবিষ্কার;
মহাশক্তির এক উৎস চিরন্তন— বিরাট শক্তিধর
আছেন জগৎব্যাপী, এ বিশ্বজগৎ তারই অধীন
তিনি তুষ্ট হলে পরে মঙ্গলালোক জ্বলে সীমাহীন।
জেগে উঠে তাই ধর্মবোধ, শুরু হয় শক্তির সাধন
সৃষ্টি হলো ধর্ম-বর্ণ-গোত্র, আরও কত বিভাজন।
এই বোধ থেকে জন্মিল আরেক প্রথাগত খেলা;
মনের পাঁঠার নামে বনের পাঁঠাবলির হিংস্র লীলা।
জবেকরা পশুর তরপানিতে নরের জাগে পরিতোষ,
ধর্মবোধে উন্মত্ত আজ মাংসভূক কথিত সভ্য মানুষ।
বিধাতা তুমি কি এখনো রয়েছ গভীর ধ্যানাসনে
চলছে কি তেমনি খেলা; যা তুমি ধরেছিলে মনে?
এক মানব জাতির মাঝে হাজারো বিদ্বেষের লীলা
তুমি কি চেয়েছ দেখতে এই রক্তের হোলিখেলা?
আপন প্রজাতির স্নেহবন্ধনে প্রাণীরা করে না ভ্রম,
মানুষের বেলায় শুধু হলো এর বিশাল ব্যতিক্রম।
ভাই ভাইকে বধে, পুত্র বধে আপন পিতা-মাতা
একি আশীর্বাদ মানবের তরে নিয়ে এল সভ্যতা!
সভ্যতার আলোর নামেতে নরে গ্রাসিতে অন্ধকার
স্বার্থ রক্ষার তাগিদে মানুষ পশুকে মানায় হার।
অসভ্যতার খেলা খেলে আজ সভ্য মানুষের দল
এ খেলায় কত নিষ্পাপ প্রাণ হারাতেছে অবিরল।
আজকের এই সভ্য মানুষের হাজারো আবিষ্কার—
অধুনা এই সভ্যতার তরে হতে পারে অহংকার,
আনেনি তো তা মানুষের তরে ন্যূনতম আশীর্বাদ
অহংকার শুধু গাঁথিয়া চলিছে রক্তের বুনিয়াদ।
জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ ভরা রক্তিম সভ্যতা
কোন পথে বয়ে আনবে মানবের কল্যাণ বারতা?
হে বিশ্ব বিধাতা, সাজাও এবার নতুন করে ধ্যান
এহেন সভ্যতার আদল ভেঙে মানুষে জাগুক জ্ঞান।