আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি,
আমার তখন মায়ের চোখ এড়িয়ে
অমঙ্গলের ইশারায় হারিয়ে যাবার বয়স।
পরন্ত শৈশব; আমার রক্তের কণায় কণায়
তখন অদম্য উৎসাহের আবির্ভাব।
কৌতূহল মিশ্রিত উত্তেজনার স্পন্দিত কণ্ঠে,
ভয়ার্ত নিস্তব্ধতার রেশ কাটিয়ে জানতে চেয়েছি—
মুক্তিযুদ্ধ!

আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি,
আমার তখন ভয়হীন উত্তেজনা।
জননীর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ আমি;
বাঁচার সংগ্রামে থেকেছি নিষ্প্রাণ।
নিরাপদে আশ্রয় নিতে গিয়ে দেখেছি—
পথে ঘাটে ছড়িয়ে থাকা রক্তমাখা লাশ
জীবনকে ভালবেসে পালিয়ে বাঁচতে
মায়ের আঁচল ধরে পচা জলে কেটেছি সাঁতার,
আর ভয়ে শুষ্ক গলা ভেজাতে
সেই জল করেছি পান।

আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি,
দেখেছি শশব্যস্ত মানুষের নিদারুণ চঞ্চলতা।
দাদার হাতে বন্দুক, মাথায় উস্কো-খুস্কো চুল,
গালভরা দাড়ি, রক্ত জবার মতো লাল চোখ—
যখন ট্রেনিং শেষ করে অস্ত্রসজ্জিত দাদা ফিরলেন
আমরা সবাই হতবাক হয়ে গেছি!

“যুদ্ধে না গেলেই কি নয় বাবা...?”
বড়মা বলতে গিয়ে দাদার চোখ দেখে থেমে গেলেন।
নির্বাক মায়ের ভেজা চোখ উপেক্ষা করে
দাদা বললেন, “সম্ভব হলে বেঁচে থেকো,
আর যদি বেঁচে থাকি তবে দেখা হবে।”
দাদার প্রস্থানকালের সেই শেষ কথাটি
বিষন্নতার স্বরে আজও বেজে যায়
আমার হৃদয়ের তারে তারে।

আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি,
আজও আমার মনে পড়ে সেই বিষন্ন স্মৃতিগুলি
সবাক চিত্রের মত দৃশ্যগুলি এক এক করে
ভেসে উঠে আমার মনের পর্দায়।
মুক্তিযুদ্ধ!
রক্তাক্ষরে লেখা স্মৃতিভরা বিষন্ন নাম!
এই শ্যামল চোখে দেখা ভয়ার্ত অভিজ্ঞান!
কী বিষন্ন ছবি!
কামান গ্রেনেডের অষ্টপ্রহর গর্জন;
পথে-ঘাটে ছড়ানো বিকৃত লাশ;
থোকা থোকা রক্ত-মাংসের গা শিউরে-ওঠা রূপ—
প্রতিবাদী হবার ইঙ্গিত এনে দেয়।

আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি,
দীর্ঘ যুদ্ধের পর আমি তখন অন্তরে অন্তরে
কৈশোরের উত্তপ্ত আহ্বান অনুভব করছি।
ভয়হীন উত্তেজনা তখন আমার হৃদয়ে-
জাগিয়ে তুলছিল ঝাঁপিয়ে পড়ার চঞ্চলতা!
কিন্তু মায়ের বাহুবন্ধন এড়াতে পারিনি আমি,
তবুও ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বেরিয়ে এসেছে—
‘জয় বাংলা’।

আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি,
শুনেছি অসহায় মানুষের বিমর্ষ হাহাকার
মৃতপ্রায় বিক্ষত মানুষের করুণ চিৎকার—
জল-জল-জল, তারপর নিশ্চুপ!
বাহুবন্ধনে আবদ্ধ আমি সেইসব তৃষিত শহীদের
আত্মার জন্যে ফেলেছি দু’ফোটা চোখের জল।
কেননা, ক্ষিপ্ত প্রাণ আমার ঝাঁপিয়ে পড়েছিল
দুর্বার এক সৈনিক জীবনে।