জাপান আমরা জানি উদিয়মান সূর্যের দেশ,চেরী ফুলের দেশ, অন্যদিকে হ্রস্বতম কবিতার দেশ, হাইকুর দেশ ।  জাপানী কবিতা অন্যান্য দেশের কবিতার মতো নয় । সে দেশের কবিতা অবিমিশ্র- কাব্যিক ও অকাব্যিক কোন বিবেচনা প্রসূত নয়। কবিতার আকৃতি এখানে মূলতঃ হ্রস্বতম । এদের কবিতা চীনের কবিতার কাছে ঋণী হলেও জাতীয় মানসিকতায় পরিস্রুত । জাপানী কবিতা চীনের মতোই সংযত । ফলে তাদের কবিতায় অনেক কিছুই অনুক্ত । এক ফুলের কলির বিকাশে, সমগ্র বসন্তকে ধরার চেষ্টা । সন্ধ্যা ঝরা পাতার দৃশ্য বর্ণনায় হেমন্তকে ধরার প্রচেষ্টা । ঘাসের উপরে শিশির ফোটার দৃশ্যে সমগ্র জীবনের অনিত্যকে ধরার চেষ্টা । জাপানিরা মনের ভাব সংক্ষেপে প্রকাশ করতেই বেশী পছন্দ করে। ‘কথা কম কাজ বেশী’,। এই নীতিতেই তারা বিশ্বাসী। মানে অল্প কথায় ভাবের ব্যাপক বিস্তার ঘটাতে চায় তারা তাদের গীতি-কাব্যে।তাই জাপানকে বলা হয়  " হ্রস্বতম কবিতার দেশ "।
   জাপানে কবিতা চর্চা সমাজের সকলেই করে। কবি বলে আমাদের মতো, ওখানে কোন রকম কোন আলাদা সম্প্রদায় নেই। সকলেই মোটামুটি লিখতে পারেন। অনুভূতির প্রাধান্য ও ছন্দের সারল্যই এর মূল কারণ।
জাপানের বেশীর ভাগ কবিতাই ‘তানকা’ বা ‘ওয়াকা’। তানকা হলো জাপানি সংক্ষিপ্ত কবিতা , পাঁচ পংক্তিতে( ৫-৭-৫-৭-৭) মোট একত্রিশ মাত্রায় রচিত।  পাঁচ পংক্তির এই ‘তানকা’ বা ‘ওয়াকা’ পর্যায়ক্রমে যোগ করে রেনগা, যার অর্থ "সংযুক্ত কবিতা", রচিত হত ।  সাতশো বছর আগে জাপানে শুরু হয়েছিল কবিতার সহযোগী রচনাকে উৎসাহিত করার জন্য । প্রতিষ্ঠার কয়েক শতাব্দী পরে, রেঙ্গার প্রথম স্তবকটি অনেক ছোট হাইকুর জন্ম দেয় আর তা  মধ্যযুগে জাপানে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পায় ,   ‘হাইকু’ (৫-৭-৫) মোট সতেরো মাত্রার কবিতা ।  
জাপানের প্রাচীনতম কবিতা সংগ্রহ ‘কোজিকি’ (৭১২ খ্রীষ্টাব্দে সংকলিত)। এর আগেও কবিতা মৌখিক ভাবে প্রচলিত ছিল, তবে তা লিপির অভাবে তখন লিপিবদ্ধ হতে পারেনি।
৭৫৯ খ্রীষ্টাব্দে সংগৃহীত ‘মানয়োও শুউ’ ( দশ হাজার পত্রের সংকলন) , পৃথিবীর অন্যতম কবিতা সংগ্রহ। ।

তানকা
জাপানিরা গীতি-কাব্য হিসাবে তানকার ব্যবহার করতো,সেই অনুযায়ী ধ্বনিবিন্যাসই শ্রেয়।
জীবনের সুখ দু:খ,আশা-আকাঙ্খা, হতাশা, প্রতিবাদ, আনন্দ, উল্লাস, নৈতিক অবক্ষয়, সবগুলিই তানকার বিষয় হতে পারে অনায়াসে।
তানকার ফর্মটি (৫-৭-৫-৭-৭) মূলত ওয়াকা(waka) ফর্ম থেকে এসেছে ৷
তানকায় (৫-৭-৫) -কে জাপিনিরা upper phrase( (কামি নো কু)-য়ে বিষয়বস্তু।
(৭-৭) -কে বলে lower phrase(শিমো নো কু)-য়ে সারমর্ম।
প্রথম তিন লাইনে বা চরণে প্রকাশ পায় বিষয়বস্তু,ভাবমূর্তি,রূপ-প্রতিরূপ,
প্রতিচ্ছায়া-প্রতিচ্ছবি বা কথামালা এবং পরের দুই লাইনে প্রকাশ পায় সারমর্ম।
তানকা বিষয়ের দিক থেকে জোর দেয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঋতুবৈচিত্র, জীবনের আশা নিরাশা প্রভৃতিকে।
সপ্তম শতাব্দী থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ‘টাংকা’ প্রধান ক্লাসিক্যাল কবিতার রূপ। অষ্টম শতকের ‘মনইয়োশু’ কবিতার সংকলনে ৩১ সিলেবলের ছোট ‘টাংকা’ কবিতাকে দীর্ঘ আকারের  রেঙ্গা ‘চোকা’ বা ‘নাগাচিতা’ কবিতা থেকে পার্থক্য করার জন্য ‘টাংকা’ নামটি ব্যবহার করা হয়। অষ্টম শতাব্দীর শেষ দিকে ‘চোকা’ এবং অন্যান্য কম গুরুত্বপূর্ণ ট্রাডিশনাল কবিতা লেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ‘টাংকা’ই টিকে থাকে জাপানি ভাষায় লেখা পরিশীলিত প্রকৃতির কবিতা হিসেবে এবং ১২০০ বছর পর্যন্ত তার প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ ছিল। এই জন্য ‘টাংকা’ আর ‘ওয়াকা’কে সমার্থক মনে করা হয়। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের পর ‘টাংকা’ ‘ওয়াকা’র ৩১ সিলেবলের কবিতার স্থান অধিকার করে নেয় হাইকু বা হাইকি ।

রেঙ্গা -
রেনগা, যার অর্থ "সংযুক্ত কবিতা", সাতশো বছর আগে জাপানে শুরু হয়েছিল কবিতার সহযোগী রচনাকে উৎসাহিত করার জন্য। কবিরা জোড়ায় বা ছোট দলে কাজ করেছেন, পালাক্রমে তিন-লাইন এবং দুই-লাইন স্তবক রচনা করেছেন। একসঙ্গে সংযুক্ত, রেঙ্গা প্রায়শই শত শত লাইন দীর্ঘ ছিল, যদিও পছন্দসই দৈর্ঘ্য ছিল ৩৬ লাইন ফর্ম যা একটি ক্যাসেন নামে পরিচিত।
রেঙ্গার "উৎপত্তি" ঐতিহ্যগতভাবে কোজিকির একটি প্যাসেজের সাথে যুক্ত,  যেখানে প্রিন্স ইয়ামাতো তাকেরু একজন বৃদ্ধের সাথে কথা বলেন এবং একটি কাটৌটা কবিতার মাধ্যমে জিজ্ঞাসা করেন, নবারি এবং সুকুবা পার হওয়ার পর তিনি কত রাত ঘুমিয়েছিলেন, যা বুড়ো আরেকটি কাটা-উতা কবিতার মাধ্যমে সাড়া দেয়, যা একক সেডাকে একত্রিত করে।  পরবর্তীকালে মধ্যযুগীয় রেঙ্গা কবিরা, এই বিনিময়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে, তাদের শিল্পকে "সুকুবার পথ" হিসাবে উল্লেখ করবেন,  এবং প্রথম সাম্রাজ্যিক রেঙ্গা কাব্যগ্রন্থ, Tsukubashū, শিরোনামে এটিকে নির্দেশ করে।
কাব্যগ্রন্থ ম্যানিওশু -এ প্রথমত বিদ্যমান রেঙ্গা দেখা যায়, যার ৫-৭-৫  মোরা জুকু ( প্রথম স্তবক)  Writtentomo no Yakamochi নামের একজন বৌদ্ধ নান কবিতার বিনময়ে পরের দুই লাইন ৭- ৭ মাত্রায় সংযুক্ত করেন মোরা গেকু ( Buddh ・ শেষ স্তবক) । আর  এই দুই স্তবকের ফর্মটিকে এখন তেরেঙ্গা (短 連 歌) বলা হয় যাকে ইংরেজীতে টানকা  নামে পরিচিতি লাভ করে । পরবর্তিতে এর সাথে নতুন নতুন তেরেঙ্গা বা তানকা রচনা ও সংযুক্ত করে রেঙ্গা কবিতা তৈরী করা হয় ।
হাইকু
হাইকু ( একবচনে হাইকি)  এক ধরণের সংক্ষিপ্ত জাপানি কবিতা। বলা যায় হাইকু পৃথিবীর ছোট কাব্য। জাপানি বড় কবিতার ক্ষুদ্রতম রূপ। হাইকু লিখিয়ে কবিদের বলা হয় হাইজিন
ইনেনগু সাবুরো নামে জাপানের বিখ্যাত একজন “History  of Japanese  Cultural  1959″ বইটিতে লিখেন যে হাইকু লেখার নিয়ম বেশ সিম্পল।  এখানে ১৭ টি অক্ষরের সিলেবল থাকে। এবং তিন ভাগে বিভক্ত থাকে। আমরা জানি যে, সিলেবল মানে জিহবার গতি না বদলিয়ে একেবারে উচ্চারণ সক্ষম শব্দ বা শব্দাংশ ; একস্তর বিশিষ্ট শব্দ বা শব্দাংশ। ছন্দ কবিতায় একস্তর বিশিষ্ট সিলেবল দেখা যায়। জাপানের বর্তমান জেনারেশন হিরাগানা অক্ষরে ৫-৭-৫ গুণেই লিখেন। আর এই হিরাগানা শব্দকেই ” অনজি ” বলে। তারা বলেন শব্দের rhythm মিলিয়ে লিখলেই চলবে।
উইকিপিডিয়া বর্ণনা অনুযায়ী -
হাইকু (একবচনে "হাইকি") একধরনের সংক্ষিপ্ত জাপানি কবিতা। তিনটি পংক্তিতে যথাক্রমে ৫, ৭ এবং ৫ জাপানি শ্বাসাঘাত মোরাস মিলে মোট ১৭ মোরাসের সংক্ষিপ্ত পরিসরে একটি মুহূর্তে ঘটিত মনের ভাব প্রকাশ করা হয়। জাপানি হাইকু একটি লাইনে লিখিত হয়। সেই বাক্যটিতে ১৭টি মোরাস থাকে। সাধারণত একটি ছবি বর্ণনা করার জন্য হাইকু লিখিত হয়। মোরাস ও মাত্রা একই ব্যাপার নয়। ইউরোপিয়গণ ১৭ মোরাসকে ১৭ দল মনে করে হাইকু লেখার সূত্রপাত করে। তাদের দেখাদেখি বাংলা ভাষায় ১৭ মাত্রার হাইকু লেখার প্রচলন হয়। মোরাস, দল ও মাত্রা এক-একটি ভাষার নিজস্ব শ্বাস অনুসারী। সেই অনুজায়ী ১২ মোরাসে ১৭ সিলেবল হয়। ইউরোপে ইমেজিস্ট আন্দোলনের পর ১৭ সিলেবলের পরিবর্তে আরো বেশি সিলেবলের হাইকু লেখা শুরু হয়েছে। জ্যাক কেরুয়াক প্রমুখ মার্কিন কবিগণ স্বীকার করেছেন যে মার্কিন উচ্চারণ জাপানি উচ্চারণ হইতে সম্পূর্ণ পৃথক। তারা ১৭ দল ও তিন বাক্য্ বন্ধন অস্বীকার করে হাইকু লিখেছেন।
হাইকুর ক্ষেত্রে শব্দের “ভগ্নাংশ”, “স্বর” এবং “কিগো” সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ।
বাশাও এর পাঁচ-সাত-পাঁচ স্বরের একটি হাইকু ইংরেজি অক্ষরে উদাহরণ দিলে স্বরের বিষয়টি পরিষ্কার হবে। একটি কবিতায় বাশাও লিখেছেন এভাবে :
“ha-tsu shi-gu-re (5)
sa-ru mo ko-mi-no o (7)
ho-shi-ge na-ri” (5)

এর বঙ্গানুবাদ এরকম :
“প্রথম বৃষ্টির ঠান্ডায়
বানরও চায় গায়ে জড়াতে
কিছুটা শুষ্ক খড়’’

এবার ‘কিগো’র প্রসঙ্গে আসি। ওয়াকা বা জাপানি পদ্যে স্বরগণনার প্রচলিত রীতি যেমন অবশ্যপালনীয়, তেমনি আর একটি অলঙ্ঘনীয় নিয়ম আছে। সেটা হল ‘কিগো’ ব্যবহার করা। ‘কিগো’ হলো জাপানি কবিতায় ব্যবহৃত ঋতুসূচক বা ঋতুনির্দেশক শব্দ। জাপানি কবিরা সব সময়েই প্রত্যেক কবিতাতেই ‘কিগো’ ব্যবহার করেন। কোন শব্দটি কোন ঋতুর প্রতীক তা জাপানি সাহিত্যের সুদীর্ঘ পরম্পরায় ক্রমে ক্রমে গৃহীত হয়ে গিয়েছে। যেমন ‘চাঁদ’ হেমন্তকালের ‘কিগো’। যদিও সমস্ত ঋতুতেই চাঁদ দেখা যায়, তবু এই ঋতুর চাঁদকেই পরম্পরাগতভাবে সবচেয়ে সুন্দর মনে করা হয়ে থাকে। বাশাও-এর ‘ওকু নো হেসোমিচি’ গ্রন্থের শেষ পর্যায়ে ‘সুরুগা’ অংশে চাঁদ নিয়ে একটি হাইকু আছে, যেটি হেমন্তেই লেখা। জাপানের সর্বত্রই চার ঋতু—বসন্ত, গ্রীষ্ম, হেমন্ত এবং শীত। সুতরাং সেখানে বর্ষা ও শরতের কোন ‘কিগো’ নেই। এবারে একটি ‘কিগো’ ব্যবহারের দৃষ্টান্ত দেব:
“কী গভীর সে নৈঃশব্দ্য
মনে হয় যেন ঝিঁ ঝিঁ’র ডাককেও
ধীরে ধীরে শুষে নিচ্ছে শিলাখণ্ডগুলি”

এটিও বাশাও-এর একটি হাইকু। এখানে “ঝিঁ ঝিঁ” এই কবিতার ‘কিগো’। এই কিগো থেকে বোঝা যায় এটি গ্রীষ্মের কবিতা। হাইকু তথা সমস্ত জাপানি সাহিত্যে “কিগো” পাওয়া যাবে। যেমন  “পুতুলের উৎসব” বসন্ত কালের, “চন্দ্রমল্লিকা” হেমন্তের কিগো। জাপানি কবিতায় “কিগো” একটি প্রধান উপাদান। গত এক হাজার বছর ধরে জাপানি কবিতার বিষয়বস্তু ও শৈলীতে অনেক পরিবর্তন এসেছে কিন্তু “কিগো” ব্যবহারের রীতি অপরিবর্তিত রয়েছে। যে কারণে শুধু হাইকু নয়, সমগ্র জাপানি কবিতা বুঝতে গেলে “কিগো” বোঝাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সুতরাং, এককথায় রেনকুর প্রথম অংশ ‘হোক্কু’ আর রেনকু না লিখে তাকে স্বতন্ত্র করে লিখলে যে ‘হোক্কু’ হলো তাইই ‘হাইকু’। বাশাও যখন স্বয়ংসম্পূর্ণ ‘হোক্কু’ লিখতেন তখন তাকে আলাদা করে ‘হাইকু’ বলা হতো না। ‘হাইকু’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় আরও পরে, উনিশ শতকের শেষের দিকে। নামকরণ করেন শক্তিশালী জাপানি কবি মাশোকা শিকি। মাসোকা সিকি শুধুমাত্র হোক্কুর নাম হাইকু নাম দিয়েই থামেননি। নতুন স্টাইলে হাইকু লিখেও দেখিয়েছেন। তার আগে  হাইকু মোট ১৭ স্বরে অর্থাৎ পাঁচ-সাত-পাঁচে লেখা হতো। তিনি দেখিয়েছেন ১১ স্বরেও (তিন-পাঁচ-তিন) হাইকু লেখা যায়। এছাড়া তিনি জাপানি কবিতায়, কবিতা লেখার নতুন একটি ধারার প্রবর্তন করেছিলেন। এই ধারার নাম হল তানকা। সেই ধারায় বর্তমান জাপানি কবিরাও কবিতা লিখে থাকেন।

    কোবায়িশি ইশার হাইকু: জোনাকি উড়ে যায়/এত দ্রুত এত নিঃশব্দে/আলোটুকু ফেলে যায়
    মাৎসু বাসো'র হাইকু: প্রজাপতি আতর মাখছে/নিজের ডানায়/অর্কিডের সুবাস
    য়োসা বুসন-এর হাইকু: কুঠারের এক ঘা/পাইনগাছের গন্ধ/শীতের বনানীতে

আধুনিককালে জাপানে হাইকুচর্চা অব্যাহত রয়েছে যদিও বিভিন্ন ধরনের কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে এবং ভিন্নধারার কবিদের সংখ্যা কম নয়। বেশ কিছু কবি এখনো ট্রাডিশনাল ‘টাংকা’ (দুটি হাইকু কবিতার চেয়ে আকারে ছোট) কবিতা লিখছে। এই ‘টাংকা’ই ছিল সপ্তম শতাব্দী থেকে লেখা জাপানি সাহিত্যে প্রধান লিরিক কবিতা। ইউরোপ-আমেরিকার মতো জাপানেও লিমেরিক জাতীয় কবিতা লেখা হয়। লোকসংগীতভিত্তিক কবিতাও লেখেন কেউ কেউ। গত দেড়শো বছরে গদ্য কবিতা লেখার চর্চা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একেই মূলধারা মনে করা হয়। এসব সত্ত্বেও হাইকু শুধু টিকে নেই, বেশ সাবলীল গতিতে এগিয়ে চলেছে। এর কারণ কী? একটা উত্তর হলো, হাইকুতে যে বাক-চাতুর্য তা সকলের কৌতূহলের বিষয়। দ্বিতীয় কারণ হলো, এর সংক্ষিপ্ততা, যা অনেকের কাছে আকর্ষণীয়। সংক্ষিপ্ততার মধ্যে যে নিগূঢ় অর্থ নিহিত তার উপলব্ধি লাভ অনেককেই মানসিক তৃপ্তি দেয়, মননকেও সন্তুষ্ট করে। আরেকটি কারণ হলো, হাইকু কথোপকথনের সময় উল্লেখ করা যায় অনায়াসে সামাজিকতা ক্ষুণ্ণ না করে।
সময়ের সঙ্গে হাইকুরও পরিবর্তন হয়েছে। আধুনিক জীবনের জটিলতা এর মধ্যে এখন প্রতিফলিত। হাইকু কেবল প্রকৃতির অবলোকন ও পর্যবেক্ষণ নয় এবং সেই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতেই সৌন্দর্য উপলব্ধি অথবা তার বিশেষ অভিব্যক্তির অর্থোদ্ধার করা নয়। আগেও অবশ্য হাইকু প্রকৃতিসর্বস্ব ছিল না। আধুনিক জীবন যতই ব্যাপ্তি পেয়েছে অভিজ্ঞতার পরিধি ও চরিত্রও প্রসারিত হয়েছে। মানুষের সংবেদনশীলতার সীমা বিস্তৃত হওয়ার পাশাপাশি হাইকুর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ঘটনা, দৃশ্য ও কল্পনা ধারণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক জীবনের সঙ্গে সংগতি রেখে হাইকুও আধুনিক হয়েছে। কিন্তু এই পরিবর্তনে হাইকুর নান্দনিকতার বৈশিষ্ট্য এবং সৌন্দর্যবোধের ভিত্তির সংশোধন হয়নি। হাইকু লেখার পদ্ধতি, অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যবোধ এবং অগভীর অর্থময়তা এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। হাইকুর মূল্যায়নে তাই তার সনাতন নান্দনিকতা এবং সৌন্দর্যবোধ এখনো প্রাসঙ্গিক।
রবীন্দ্রনাথ হাইকুর সঙ্গে বাংলা ভাষার পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন “জাপানযাত্রী” গ্রন্থের মাধ্যমে। “জাপানযাত্রী” গ্রন্থে হাইকুর সঙ্গে পরিচয় করাতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন, “তিন লাইনের কাব্য জগতের আর কোথাও নাই”। এই প্রসঙ্গে জাপানি যে দুইটি হাইকুর অনুবাদ তিনি পেশ করেছিলেন তা হয়তো অনেক বাঙালির মনে আছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ জাপান ভ্রমণে এসে এই হাইকু কবিতাতে বেশ প্রভাবিত ও মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর জাপান যাত্রী গ্রন্থে তিনি লিখেছেন – “জাপানি বাজে চেঁচামেচি ঝগড়াঝাঁটি করে নিজের বলক্ষয় করে না। প্রাণশক্তির বাজে খরচ নেই বলে প্রয়োজনের সময় টানাটানি পড়ে না। শরীর-মনের এই শান্তি ও সহিষ্ণুতা ওদের স্বজাতীয় এই যে নিজের প্রকাশকে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত করতে থাকা, এ ওদের কবিতাতেও দেখা যায়। তিন লাইনের কাব্য জগতের আর কোথাও নেই। এই তিন লাইনই ওদের কবি, পাঠক, উভয়ের পক্ষেই যথেষ্ট… এই কবিতাগুলির মধ্যে কেবল যে বাক্‌সংযম তা নয়, এর মধ্যে ভাবের সংযম। এই ভাবের সংযমকে হৃদয়ের চাঞ্চল্য কোথাও ক্ষুব্ধ করছে না। আমাদের মনে মানুষের একটা ইন্দ্রিয়শক্তিকে খর্ব করে আর-একটাকে বাড়ানো চলে, এ আমরা দেখেছি। সৌন্দর্যবোধ এবং হৃদয়াবেগ, এ দুটোই হৃদয়বৃত্তি। আবেগের বোধ এবং প্রকাশকে খর্ব করে সৌন্দর্যের বোধ এবং প্রকাশকে প্রভূত পরিমাণে বাড়িয়ে তোলা যেতে পারে–এখানে এসে অবধি এই কথাটা আমার মনে হয়েছে”।  
রবীন্দ্রনাথের ‘লেখন’ ও ‘স্ফুলিঙ্গ’ এই দুইটি কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কবিতাগুলো ছোট কবিতা – কিন্তু ঠিক আইন মাফিক হাইকু নয়। এই কবিতাগুলো সম্বন্ধে কবি বলেছেন – “এই লেখনগুলি সুরু হয়েছিল চীনে জাপানে। পাখায় কাগজে রুমালে কিছু লিখে দেবার জন্যে লোকের অনুরোধে এর উৎপত্তি”। অর্থাৎ এই কবিতাগুলি আসলে অটোগ্রাফ , কবি নিজেও কোথাও হাইকু বলে দাবী করেন নি ।
যদিও সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত হাইজিন মাৎসুও বাশোও-র বিখ্যাত
ফুরু ইকে ইয়া
কাওয়াজু তোবিকোমু
মিজু নো ওতো  
হাইকুটিকে – রবীন্দ্রনাথ এই কবিতাটি বাংলায় অনুবাদ করে এর বিশেষত্ব সম্বন্ধে লিখেছেন –  
                “পুরোনো পুকুর,
                    জলের শব্দ,
                        ব্যাঙের লাফ।
বাস! আর দরকার নেই। জাপানি পাঠকের মনটা চোখে ভরা। পুরোনো পুকুর মানুষের পরিত্যক্ত, নিস্তব্ধ, অন্ধকার। তার মধ্যে একটা ব্যাঙ লাফিয়ে পড়তেই শব্দ শোনা গেল। শোনা গেল – এতে বোঝা যাবে পুকুরটা কী রকম স্তব্ধ। এই পুরোনো পুকুরের ছবিটা কী ভাবে মনের মধ্যে এঁকে নিতে হবে সেইটুকু কেবল কবি ইশারা করে দিলে; তার বেশি একেবারে অনাবশ্যক”।
রবীন্দ্রনাথের ‘লেখন’ ও ‘স্ফুলিঙ্গ ’ কাব্যগন্থের কয়েকটি কবিতা হাইকুর মতন তিন লাইনের কিন্তু প্রথাগতভাবে বিশুদ্ধ হাইকু নয় অর্থাৎ ৫-৭-৫ মাত্রার নয় এবং প্রকৃতির ছোঁয়া দু-একটা বাদ দিলে অধিকাংশতে অনুপস্থিত। বেশ কয়েকটি কবিতায় প্রথম ও তৃতীয় লাইনে অন্ত্যমিল আছে আর আছে ছবির বদলে এক মহান দর্শন যা কবিতা পাঠের পরে হৃদয়ে সৃষ্টি করে নিঃশব্দ অনুরনণ। যেমন –
আলো যবে ভালবেসে
       মালা দেয় আঁধারের গলে
                      সৃষ্টি তারে বলে ।।
অথবা,
আমার প্রেম রবি-কিরন-হেন
          জ্যোতির্ময় মুক্তি দিয়ে
                     তোমারে ঘেরে যেন।।
হাইকু কবিতা সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইংরেজী, ফরাসি ও অন্যান্য ভাষাতেও হাইকু লেখার প্রচেষ্টা অনেকদিন আগে থেকেই চলে আসছে। প্রখ্যাত আমেরিকান কবি এজরা পাউন্ড এই হাইকু কবিতার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কাব্যে ইমেজিসম বা চিত্রকল্পবাদ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। জাপানি ছাড়া অন্যান্য ভাষায় প্রথাগত হাইকু লেখা অসম্ভব না হলেও দুরূহ। কারণ প্রত্যেক ভাষার কবিতার নিজস্ব ছন্দ ও মাত্রা আছে। এক ভাষার কোন বিশেষ ছন্দ বা মাত্রার কবিতা ভাব অক্ষুণ্ণ রেখে অন্য ভাষায় হুবহু অনুবাদ করা বা রচনা করা একপ্রকার দুঃসাধ্য। তাই অন্যান্য ভাষায় বিশুদ্ধ হাইকুর সংখ্যা খুবই কম।