সনেট অর্থাৎ বাংলায় যাকে চতুর্দশপদী কবিতা বলা হয় তার প্রথম উদ্ভব হয় মধ্যযুগে ইতালিতে। সনেট (sonnet ) শব্দটি ইংরেজী শব্দ যা ইতালীয় শব্দ সনেটো ( sonetto ) থেকে এসেছে
যার অর্থ সামন্য শব্দ বা গান ( Little sound or song ).
অনেকের ধারনা সিসিলীয় কবিগোষ্ঠী ট্রুবাদুরদের প্রভেসাল গীতি কবিতা অবলম্বনে সনেট রচিত হয় , তবে ত্রয়োদশ শতকে ইটালিয়ান কবি পিয়ারো ভিনের রচনায় প্রথম সার্থক সনেটের ব্যবহার দেখা যায় । কিন্তু সনেট বলতে আমরা যা বুঝি তার যথার্থ জনক হলেন ইতালীয় কবি পেত্রার্ক । চতুর্দশ শতাব্দীতে যখন সমগ্র ইউরোপে নবজাগরণের জোয়ার বইছিল ঠিক তখনই ইতলীতে কবি পেত্রার্কের হাতে স্বার্থক সনেট কবিতার জন্ম হয় , তাই সনেটের প্রথম প্রবর্তক হিসাবে কবি পিয়ারভানের নামও পাওয়া গেলেও পেত্রার্ক কেই সনেটের জনক বলা হয় । সিসিলীয় কবি সুইডেন প্রথম সনেটের নিয়ম কানুন প্রবর্তন করেন , তিনি সনেট কে অষ্টক ও ষষ্টক নামে দুই ভাগে ভাগ করেন ; বিখ্যাত সনেট রচয়িতা কবি দান্ত্যে ও ট্যাসো ছিলেন পেতার্কের অনুসারী ।
ইংরেজি সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা প্রথম পরিচিতি পেয়েছিল খ্রীষ্টীয় ১৬শ (ষোড়শ) শতাব্দীতে 'টমাস ওয়াট' এর প্রয়োগের মাধ্যমে। কিন্তু এর প্রচলন প্রবল হয়ে ওঠে স্যার ফিলিপ সিডনি এর Astrophel and Stella (১৫৯১) প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে। তার পরের দুই শতক উইলিয়াম শেকসপিয়র, এডমন্ড স্পেন্সার, মাইকেল ড্রায়টন ইত্যাদি ব্যক্তিত্ত্বরা চতুর্দশপদী কবিতাকে নতুন নতুন ধাপে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। এরুপ কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল নারীর প্রতি ভালবাসা।
পেত্রার্কীয় রীতির সনেট অধিকতর ইম্প্রেসিভ, অন্যপক্ষে শেক্সপীয়রীয় রীতির সনেট অধিকতর এক্সপ্রেসিভ। তবে Joseph Angus, M. A, D.D. (Examiner in English Language, Literature and History to the University of London) শেক্সপীয়রীয় রীতি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন - The worst form for the Sonnet. যে-রীতি পেত্রার্কীয় রীতি নামে কথিত, তা পেত্রার্কার আবির্ভাবের পূর্বেও প্রচলিত ছিল; কিন্তু পেত্রার্কার কৃতিত্ব হলো তিনি সেই ক্লাসিক্যাল ছন্দোবন্ধের আকারের সাথে তাঁর স্ব-অনুভূত ব্যক্তিগত বিশিষ্ট ভাব-প্রেরণা সম্পূর্ণ সুসমঞ্জস করে আশ্চর্য সুন্দররূপে মূর্ত করতে সমর্থ হোন, ফলে তা পেত্রার্কীয় রীতি নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। তদ্রূপ, শেক্সপীয়রের পূর্বে তথাকথিত শেক্সপীয়রীয় পদ্ধতি প্রচলিত ছিল, কিন্তু শেক্সপীয়রের সুদক্ষ লেখনিগুণেই তা অনবদ্য ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে এবং কালক্রমে ইংরেজি রীতি নামে অভিহিত হয়। পেত্রার্কীয় সনেটে অষ্টকের ৮ পঙ্ক্তির জন্য দুই প্রকার রাইম-এর প্রয়োজন, এবং ইতালীয় ভাষায় রাইমিং সিলেবল্স প্রচুর বিধায় তাঁর পক্ষে এ পদ্ধতি খুবই উপযোগী ছিল। কিন্তু ইংরেজি ভাষায় রাইমের এরূপ প্রাচুর্য নেই, তাতে একই রাইম-এর চারটি শব্দযোজনা সর্বদা সহজসাধ্য নয়, সেজন্যই ইংরেজি ভাষায় পেত্রার্কীয়, উইয়াটীয় বা স্পেনসারীয় পদ্ধতি সুপ্রশস্থ বিবেচিত হয় নি,- শেক্সপীয়রীয় রীতিই সে-ভাষার প্রকৃতির অধিকতর উপযোগী।
ফরাসী ভাষায় প্রথম সনেট রচনা করেন ক্লেমেন্ট ম্যারট (১৪৯৬-১৫৪৪)। তিনি পেত্রার্কার ৬টি সনেট অনুবাদ করেন। তাঁর দুই অনুবর্তী Pierre de Ronsard (১৫২৪-৮৫) এবং Joachim Du Bellay (১৫২৫-৬০) ইতালীয় রীতির ভিত্তিতে ফরাসী ভাষায় সনেট রচনার নুতন ধারার প্রবর্তন করেন। স্ববনামখ্যাত ফরাসী কবি Paul Verlaine (১৮৪৪-৯৬) তাঁর অনেক সনেটে মিলের পদ্ধতিতে অনিয়মতন্ত্রতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। তাঁর কয়েকটি সনেটে ষটকের পরে অষ্টকের অবস্থান বৈশিষ্ট্য জ্ঞাপক।
বাংলা ভাষায় প্রথম সনেট রচনার কৃতিত্ব মাইকেল মধুসূদন দত্তের, সনেটকে বাংলায় চতুর্দশপদী নাম মহাকবি মাইকেল মধুসূদনই দিয়েছিলেন। বাংলা সনেট (চতুর্দশপদী) এর সার্থক স্রষ্টা কবি মধুসূদন দত্ত ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে অবস্থানকালেই ইতালির কবি পেত্রার্কের সনেট থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রথম বাংলা সনেটের দিগন্ত উন্মোচন করেন। ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দে কবির চতুর্দশপদী কবিতাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এই কবিতাগুলিতে কবি চিত্তের ব্যকুলতা, স্বদেশ প্রেম ও আবেগ ধ্বনিত হয়েছে।
খাঁটি সনেটের আদর্শ রূপবন্ধন সম্বন্ধে স্বনামখ্যাত ইংরেজ কবি ও সমালোচক Theodore Watts-Dunton (১৮৩২-১৯১৪) বলেছেন :
সমুদ্রতরঙ্গের উচ্ছ্বাস ও পতন যেমন তাল-লয় ব্যবচ্ছিন্ন, সনেটের ভাবতরঙ্গের উচ্ছ্বাস ও পতনও সেরূপ তাল-লয় ব্যবচ্ছিন্ন। ফেনিলোচ্ছল সাগরতরঙ্গ যেমন ক্রমশ স্ফীত ও বর্ধিতকায় হয়ে বেলাভূমির উপর উৎপতিত হয়, এবং নিমেষমাত্র স্থির থেকে আবার উজান বেগে সাগরগর্ভে অপসারিত হয়, সেরূপ ভাবের তরঙ্গ ছন্দোময়ী শব্দধারায় অষ্টকে উচ্ছলিত হয়ে বিপরীত আবর্তনে ষটকে অবসানপ্রাপ্ত হয়।
এর বৈশিষ্ট হল যে এই কবিতাগুলো ১৪টি চরণে সংগঠিত এবং প্রতিটি চরণে সাধারণভাবে মোট ১৪টি করে অক্ষর থাকবে। এর প্রথম আট চরণের স্তবককে অষ্টক এবং পরবর্তী ছয় চরণের স্তবককে ষষ্টক বলে। অষ্টকে মূলত ভাবের প্রবর্তনা এবং ষষ্টকে ভাবের পরিণতি থাকে।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত,অন্ত্যমিল বিন্যাসের বিশিষ্ট আদর্শে গঠিত, ১৪ মাত্রার বা ১৮ মাত্রার চরণের যে বিশেষ ছন্দ বন্ধের মধ্যে প্রথম ৮ চরণে একটা ভাব প্রকাশিত হয় এবং পরের ৬ চরণে তার বিশ্লেষণ থাকে অর্থাৎ মিলের একটা আদর্শ অনুসরণ করা হয় তাকে সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা বলা হয়।
২.ইংরেজ কবি কোলরিজ সনেট সম্বন্ধে বলেছেন— ‘A small poem, in which some lonely feelings is developed’.
৩.সমদৈর্ঘ্যের চোদ্দটি পংক্তিতে ও একটি বিশেষ ছন্দরীতিতে যখন কবিমনের একটি অখণ্ড ভাবকল্পনা কাব্যরূপ লাভ করে তখন তাকে সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা বলা যেতে পারে।
সনেটের সাধারন বৈশিষ্ট্য
১. সনেট অক্ষরবৃত্ত রীতিতে রচিত পয়ার ও মহাপয়ারের উপর স্থাপিত।
২. সনেটে থাকে ১৪ টি চরণ।
৩. পয়ারের উপর প্রতিষ্ঠিত সনেটে প্রতিটি চরণে থাকে ১৪ টি মাত্রা যার প্রবর্তক হলেন মধুসূদন দত্ত । যথা– ‘বঙ্গভাষা’।
৪. মহাপয়ারের উপর প্রতিষ্ঠিত সনেটে প্রতিটি চরণে থাকে ১৮ টি মাত্রা যার প্রবর্তক হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যথা ‘রাত্রি’।
৫. সনেটের প্রথম ৮ চরণকে বলে ‘অষ্টক’, শেষের ৬ চরণকে বলে ‘ষটক’।
৬. অষ্টকে একটা ভাব ঘণীভূত হয়ে প্রকাশ পায় আর ষটকে তা ব্যাখ্যা থাকে।
৭. সনেটে অষ্টক মূল,ষটক উপসংহার।
৮. মিলবিন্যাসের দিক দিয়ে সনেটকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়—-
ক.পেত্রার্কীয় সনেট:– অষ্টকের মিলবিন্যাস– কখ খক, কখ খক। ষটকের মিলবিন্যাস– গঘঙ,গঘঙ / গঘগ,ঘগঘ / গঘঙ,ঘগঙ।
খ.শেক্সপীরীয় সনেট:– তিনটি চতুষ্ক ও একটি সমিল দ্বিপদিকা এই সনেটে বিদ্যমান। মিলবিন্যাস — কখ কখ,গঘ গঘ,ঙচ ঙচ,ছছ।
গ.ফরাসী সনেট :– অষ্টকের মিলবিন্যাস– কখ কখ, কখ কখ। ষটকের মিলবিন্যাস– গঘ, কগ খঘ।
৯. সনেটে ভাব প্রকাশের মধ্য দিয়েই কবি হৃদয়ের গভীর আনন্দ বা বেদনা বা বিশেষ অনুভূতি ব্যক্ত হয়।
১০. সনেট গাঢ় বদ্ধ রচনা, তার দেহ সংহত এবং মিতায়তন।
১১. সনেটে একটি মাত্র ভাবের দ্যোতনা লক্ষ করা যায়।
১২. সনেট রচয়িতার কঠিন পরিমিতি বোধ কাম্য।
১৩. সনেটের ভাষা হবে স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল যাতে কোনো দুর্বোধ্যতা থাকবেনা।
১৪. সনেট অক্ষরবৃত্তে রচিত বলে এর যাবতীয় লক্ষণ সনেটে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।
সনেটের শ্রেণীবিভাগ ও গঠন
সনেট মূলত দু’ প্রকারের। ১.পেত্রার্কীয় সনেট। ২.শেক্সপীরীয় সনেট। তবে এডমান্ড স্পেনসার শেক্সপীরীয় সনেটে নতুনত্ব এনেছেন। তাঁর প্রবর্তিত সনেটকে বলে-৩.স্পেনসারের সনেট। এছাড়া ফ্রান্সে নতুন রীতির একটি সনেট গড়ে উঠেছে, সেটি হল– ৪.ফরাসী সনেট।
১. পেত্রার্কীয় সনেটের গঠন
ক. পেত্রার্কীয় সনেট১৪ পংক্তির হয়। প্রথম ৮ পংক্তিকে ‘অষ্টক’ এবং পরবর্তী ৬ পংক্তিকে ‘ষটক’ বলে। অষ্টক দুটি চতুষ্ক এবং ষটক দুটি ত্রিপদিকা নিয়ে গঠিত।
খ.অষ্টক অংশে প্রশ্ন কিংবা বিবরণের মাধ্যমে কবিতার মূল ভাববস্তুর আভাস দেওয়া হয় আর ষটক পর্বে সে প্রশ্নের বা অবতারণার উত্তর বা সমাপ্তি সূচিত হয়।
গ. এই সনেটে কখনও অষ্টক ও ষটক পৃথকভাবে অবস্থান করে আবার কখনও এক অবিভক্ত কবিতারূপে সনেটের সমগ্র গঠনটি পরিস্ফূট হয়।
ঘ. এই রীতির সনেটের মিলবিন্যাস রীতি :– অষ্টক অংশের মিল বিন্যাস হল কখ কখ, কখ কখ। ষটক অংশের মিলবিন্যাসে বৈচিত্র লক্ষ্য করা যায়– গঘঙ গঘঙ / গঘগ ঘগঘ / গঘঙ ঘগঙ।
ঙ. পেত্রার্কীয় সনেটের উদাহরণ:–
‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’– জীবনানন্দ দাশ।
এই কবিতার প্রতি চরণের মাত্রা বিন্যাস ৮+৬। অষ্টকের ও ষটকের মিলবিন্যাস পেত্রার্কীয় সনেটের অনুরূপ।
২. শেক্সপীরীয় সনেটের গঠন
ক.শেক্সপীরীয় সনেট ১৪ পংক্তির তিনটি চতুষ্ক ও একটি সমিল দ্বিপদিকা নিয়ে গঠিত।
খ.এই সনেটে মেজাজবদল ঘটে শেষের সমিল দ্বিপদিকায়।
গ. মিলবিন্যাস রীতি হল - কখ কখ, গঘ গঘ : ঙচ ঙচ, ছছ।
শেক্সপীয়ারের সনেটগুলি একটি কঠোর কাব্যিক আকারে লিখিত হয় যা তার জীবদ্দশায় খুব জনপ্রিয় ছিল। ব্যাপকভাবে বলছে, প্রতিটি সোনার ছবি এবং শব্দগুলি যুক্ত করে রিডারকে একটি আর্গুমেন্ট উপস্থাপন করতে।
সনেট বৈশিষ্ট্য
একটি সনেট কেবল একটি নির্দিষ্ট বিন্যাসে লেখা একটি কবিতা। একটি সনেটকে চারটি বিভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে যা চতুর্ভুজকে বলা হয়। প্রথম তিনটি চতুর্ভুজ চারটি লাইন থাকে এবং একটি বিকল্প ছড়া স্কিম ব্যবহার করে। চূড়ান্ত quatrain উভয় ছড়া উভয় যা শুধু দুটি লাইন গঠিত।
একটি শেক্সপীরীয় সনেটের উদাহরণ:–
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ' কেন '
৩. স্পেনসারের সনেট : এডমান্ড স্পেনসারের সনেট শেক্সপীয়ারের সনেটগুলির অনুসারী তিনি শুধু মিলবিন্যাসে নতুনত্ব এনে সনেট লেখায় এক ভিন্ন ধারা সৃষ্টি করেন, যা স্পেনসারের সনেট নামে আলাদা ভাবে মর্যাদা লাভ করে ;তিনি তর Amorctti কাব্যে তিনটি চতুস্কের মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্র স্থাপন করেন
এ ধরনের সনেটের মিলবন্যাস ক খ ক খ : খ গ খ গ : গ ঘ গ ঘ : ঙ ঙ
৪. ফরাসী সনেট : এছাড়া ফ্রান্সে নতুন রীতির একটি সনেট গড়ে উঠেছে যার নাম ফরাসী সনেট। ইতালীয় রীতির ভিত্তিতে ফরাসী ভাষায় সনেট রচনার নুতন ধারার প্রবর্তন করেন।
স্বনামখ্যাত ফরাসী কবিগন তাঁদের অনেক সনেটে মিলের পদ্ধতিতে অনিয়মতন্ত্রতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। তাঁদের কয়েকটি সনেটে ষটকের পরে অষ্টকের অবস্থান বৈশিষ্ট্য জ্ঞাপক। তবে মূলত মিলবিন্যাসে পেতর্কীয় ও শেক্সপীরীয় রীতি অমান্য করে বিভিন্ন রূপকল্পে কবিতাকে অন্ত্যমিলের আওতায় আনা হয় । এই রীতির সনেট খুব লেখা হয়নি । এই সনেট সাধারণত আয়রণ ও স্যাটায়ার প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে । দ্যুবেল এই রীতিতে সনেট রচনা করেছেন । এর মিল বিন্যাসের রীতি হল –১, কখ কখ ,কখ কখ , গগ , চছ,চছ ।
২. কখ কখ, কখ কখ। : গঘ, কগ , খঘ।
৩. ক খ খ ক ,গ ঘ ঘ গ : ছ ছ ,ঙ চ চ ঙ,
৪. ক খ ক খ , গ ঘ গ ঘ : ছ ছ , ঙ চ ঙ চ,
ফরাসী কবিগন সনেটের মুলকাঠামো ঠিক রেখে গঠনশৈলী ও মিলবিন্যাসে ভিন্নতা এনে সনেট রচনা করেন, যেমন তারা পেত্রর্কীয় ও শেক্সপীরীয় রীতির বাইরে যেয়ে অষ্টক দুটি চতুস্পদী স্তবকে ষষ্টকে প্রথমে সমিল দ্ধীপদী আর শেষে চতুস্পদী স্তবকে সাজিয়ে সনেট রচনা করেন ।
বাংলা ভাষায় প্রথম সনেট রচনা করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বাংলায় উল্লেগযোগ্য সনেট রচয়িতা –মাইকেল মধুসূদন দত্ত,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,জীবনানন্দ দাশ,প্রমথ চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদার,ফররুখ আহমদ,কামিনী রায়।
বাংলা সনেট ১৪, ১৮,২২,২৬,৩০ মাত্রার হয়।
সাধারণত দুই স্তবকে যথাক্রমে ৮ টি ও ৬ টি চরণ থাকে।( চরণ বিন্যাসে ব্যতিক্রম থাকতে পারে)
প্রথম ৮ টি চরণের স্তবককে অষ্টক ও ৬ টি চরণের স্তবককে ষষ্টক বলে।
নির্দিষ্ট নিয়মে অন্ত্যমিল থাকে।
সনেটের ভাষা মার্জিত এবং ভাব গভীর ও গম্ভীর হতে হয়।
বাংলা ভাষায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত , জীবনানন্দ দাস পেত্রার্কীয় গঠন পদ্বতিতে সনেট রচনা করেছেন, যেমন কবি , আবার আসিব ফিরে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেক্সপীরিয় রীতি অনুযায়ী সনেট লেখেন , যেমন- প্রাণ, হৃদয়ের ভাষা, স্মৃতি, হদয়-আসন, কেন, পবিত্র প্রেম, অস্তাচলের পরপারে, স্বপ্নরুদ্ধ, অক্ষমতা, জাগিবার চেষ্টা, কবির অহঙ্কার, বিজনে, সত্য, ক্ষুদ্র আমি, প্রভৃতি
প্রমথ চৌধুরীর ফরাসী রীতিতে সনেট লিখেছেন , তার লেখা অনেক সনেট ফরাসী ভাবাবয়ব ত্রিধা-বিভক্ত, তাতে অষ্টক ও শেষ চতুষ্কটির মধ্যে সেতুবন্ধ-স্বরূপ স্বতন্ত্রভাবে একটি সমিল শ্লোক অবস্থিত।
সবশেষ কথা
১৪ পঙ্ক্তিযুক্ত এবং সনেটীয় অন্ত্যমিল সম্পন্ন কবিতামাত্রই সনেট নয়।
কাহ্নপাদ হতে ঈশ্বরগুপ্ত পর্যন্ত বহু কবি বাংলা ভাষায় চতুর্দশ-পঙ্ক্তি কবিতা রচনা করেছেন, যেগুলো আসলে ৭টি সমিল পয়ার-শ্লোকের সমষ্টি, তাতে সনেটের গুরুগম্ভীর ভাব ও সংহত গঠনশৈলি দৃষ্ট হয় না । রবীন্দ্রনাথের অমর সৃষ্টি তাঁর 'চৈতালি', 'স্মরণ' ও 'নৈবেদ্য' কাব্যের চতুর্দশ-পঙ্ক্তি কবিতাগুলি সনাতন প্রণালীতেই অন্ত্যমিলযুক্ত যুগ্ম-পঙ্ক্তিতে রচিত, তাতে সনেটের সুব্যবস্থিত মিলবৈচিত্র্য নেই, কিন্তু রোমান্টিক সনেটের অনেক লক্ষণই বহুলাংশে বিদ্যমান। ফলে রবীন্দ্রনাথের এই রচনাগুলি বিশ্বকাব্যধারায় নিঃসন্দেহে এক নতুন সংযোজন। একটি কবিতাকে আদর্শ সনেট বলা যাবে তখনই, যখন এর ভাব-প্রবাহ সনেটীয় রীতিতে প্রবহমান থাকবে, এবং এর অন্ত্যমিলও সনেটীয় রীতি দ্বারা বিরচিত হবে। এর ব্যতিক্রম হলে তা একটা সাধারণ গীতিকবিতার মর্যাদা প্রাপ্ত হবে।
অর্থাৎ কবিতাগুলো ১৪টি চরণে সংগঠিত এবং প্রতিটি চরণে সাধারণভাবে মোট ১৪টি করে অক্ষর থাকবে। এর প্রথম আট চরণের স্তবককে অষ্টক এবং পরবর্তী ছয় চরণের স্তবককে ষষ্টক বলে। অষ্টকে মূলত ভাবের প্রবর্তনা এবং ষষ্টকে ভাবের পরিণতি থাকতে হবে।সুবিন্যস্ত অন্ত্যমিল থাকতে হবে ।তবেই পাব আমরা সার্থক সনেট ।