আমি এখন জানালার পাশে বসে আছি,
জানালাটা আমার খুব প্রিয়।
কৈশরের অনেক স্মৃতি চিহ্ন আঁকা আছে,
এর প্রত্যেকটি মরিচা পড়া রন্ধ্রে।
পনের বছর আগে এই জানালাটা ছিলো না,
তখন আমরা টালির ঘরে থাকতাম।
মাটির মেঝে,
আর টালির ছাউনি।
বৃষ্টির সময় টালির ফাঁক দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তো,
মা- বাবা আর আমি,
হাত দিয়ে জল বাইয়ে দিতাম,
কখনো কখনো তো থালা গামলা পেতে রাখতাম।
যাতে বৃষ্টির ফোঁটায় মায়ের তৈরী বিছানাটা না ভেঁজে।
অসুস্থ মা-এর সুন্দর করে লেপা মাটির মেঝেটা যেন নষ্ট না হয়।।
ছোট থেকেই দেখছি মা ভীষণ অসুস্থ,
ওনার হার্টে ছিদ্র আছে।
মাঝে মাঝে এমন দম আটকে যায় যে,
মনে হয় মা বুঝি আর বাঁচলেন না।
তবুও হাজার শক্তি এক করে কত কিছু করতেন,
পরার একেবারেই অনুপযুক্ত শাড়ি গুলো দিয়ে,
কাথা সেলাই করতেন,
টালির ফাঁক দিয়ে ধুলো না আসার জন্য,
সেলাই মেশিন দিয়ে দারুণ সুন্দর চাঁদোয়া বানাতেন।
আমাদের একটা সেলাই মেশিন ছিল,
মা চালাতেন মাঝে মাঝে,
খুব বেশিক্ষন সেলাই করতে পারতেন না,
হাঁপিয়ে যেতেন একটুতেই।
বাবা সারাদিন রোদে পুড়ে স্বল্প কিছু রোজগার করতেন,
সন্ধায় যখন ঘরে ফিরতেন,
তখন তার ঘাম টপটপ করে ঝরে পড়তো বারান্দার কোণটায় ।
আমি তাকিয়ে দেখেছি,
মা হাতপাখা দিয়ে বাবাকে বাতাস করতেন।
আমি তখন অনেক ছোট্ট,
চোঁখে অনেক স্বপ্ন,
একদিন বড়ো হবো।
বাবার কস্ট ঘুচাবো,
সুন্দর একটা বাড়ি করবো।
সন্তুুদের বাড়ির মতো বাড়ি,
সামনে একটা পুকুর কাটবো,
সন্ধায় উঠানের বাগানে বসে সবাই মিলে অনেক আনন্দ করবো।
সন্তুু আমার খুব ভালো বন্ধু,
কিন্তু ওদের বাড়ি কখনো যেতাম না আমি,
লজ্জা করতো,
ভয় করতো।
আমরা তো গরীব,
ওদের পাঁকা বাড়িতে গেলে যদি ওর ঠাকুমা বকে,
বলে -তোর পায়ে ছেড়া চটি,
নোংরা জামা।
তখন খুব কস্ট হবে ভেবে,
ওদের বাড়ি কখনো যাওয়া হতো না।
তবে সন্তুু খুব করে বলতো,
ওদের বাড়ি যাওয়ার জন্য।
কিন্তু কখনো যেতে পারিনি,
আজও যাওয়া হলো না।
একটা মেয়েকে আমার দারুণ ভালো লাগতো,
ওর নাম সুপর্ণা।
দারুণ দুরন্ত,
খুব মজা করতো।
ভীষণ ইচ্ছে করতো,
ওকে বলি;
সুপর্ণা তোকে আমার খুব ভালো লাগে।
কখনো বলতে পারিনি,
ওরা যে অনেক বড়ো লোক।
একটা প্যান্ট আর দুটো জামা অদলবদল করে,
বছরের পর বছর কাটিয়ে দেওয়া এই আমি,
কোন যোগ্যতায় ভালোবাসার কথা বলি!
বলা হয়নি।
অনেক বছর হলো সুপর্ণার বিয়ে হয়ে গেছে,
ওর দুটো বাচ্চা আছে,
দারুণ মিস্টি দেখতে হয়েছে,
ওর মতোই।
বাবা অনেক কষ্ট করে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে,
এই বাড়িটা তৈরী করেছিলেন।
যখন বাবা বলেছিলেন,
এবার সরকার থেকে কিছু টাকা পাওয়া যাবে বাড়ি বানানোর জন্য,
আর কিছু টাকা দিয়ে একটা পাঁকা বাড়ি বানাবেন।
শুনে কি যে খুঁশী হয়েছিলাম,
এখনো মনে পড়ে।
মনে পড়ে তিন দিন ঘুমাতে পারিনি,
রোজ সকালে উঠতাম,
কতটা ইট গাথা হলো!!
ইটের সারি গুনে গুনে দেখতাম।
বাবাকে জিজ্ঞেস করতাম,
আর কত দিন লাগবে বাবা?
বাবা হেসে বলতেন,
এই তো আর বেশি দিন না।
তার পর প্রায় এক বছর পরে,
আমরা নতুন বাড়ি আসি।
আমার জন্য এই ঘরটা ছিল,
আমি বেছে নিয়েছিলাম।
পিছনে আর সামনে দুটি জানালা,
পিছনের জানালার পাশে টেবিল পেতেছিলাম,
পড়ার টেবিল।
আর জানালার পাশে চেয়ার।
খুব পড়তাম,
মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে দেখতাম,
অনেক কিছু দেখা যেত,
সবে পিছনে তখন অনেকটা জমিতে আমের চারা গাছ লাগিয়েছে,
আমের চারা বাগানের পরেই মাঠ,
খোলা চাষের মাঠ,
ধান -পাট-গম-সবজি-ফুল আরো কতো কি।
দারুণ ভালো লাগতো আমার,
আমার যখন পড়তে ইচ্ছে করতোনা,
তখন গাছগুলোকে দেখতাম,
ওদের বড় হওয়ার পরিমাণ চোখের আন্দাজে মাপার চেষ্টা করতাম।
ভাবতাম আমাকেও এভাবেই একদিন বড় হতে হবে,
একটু একটু করে।
সেই তখন থেকেই জানলাটার সাথে আমার সখ্যতা,
খুব আনন্দ পেলে জানালার ধারে দাড়িয়ে গাছগুলোকে দেখতাম,
আর খুব দুঃখ পেলে গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে আঁকাশটাকে দেখতাম।
আম গাছ গুলো এখন অনেক বড়ো হয়েছে,
জানলার পাশে বসলে,
পাতার ফাঁকে এখন আঁকাশটা দেখা যায়না,
দূরের সবুজ মাঠটাও ঝাঁপসা দেখায়।
আমিও অনেক বড় হয়েছি,
আমগাছ গুলোর মতোই,
শুধু গায়ে-পায়ে।
এমে পাশ দিয়েছি,
বিএড করেছি।
বাবা এখন বুড়ো হয়ে গেছেন,
মা এখন সুইয়ে সুতো গাথতে পারেন না।
পুরানো কাথা গুলিই সম্বল,
মার মাথায় এখন আর তেমন চুল নেই,
মনে পড়ে মা-এর মাথায় অনেক চুল ছিলো।
মাথা আচড়ানোর পর উঠে যাওয়া চুল,
জমিয়ে জমিয়ে কত কিছু কিনতো।
মা এখনো চুল জমায়,
কিন্তু বিনিময়ে কিছু কেনার মতো চুল আর এখন জমে না।
শুধু শুধু ফেরিওয়ালাকে ডাকে,
আর ফেরিওয়ালা প্রতিবার মাকে ফিরিয়ে দেয়,
"এই কটা চুলে কিছু হয়না কাকিমা"।
মা কে আমি কিছুই বলতে পারিনা।
বুড়ো বাপটা এখনো মাঠে যায়,
ঠিক করে ঠাওর করতে পারেনা,
ঘাস নিড়াতে গিয়ে গাছই মেরে দেয়।
লোকে যাচ্ছে তাই গালি দেয়,
এখনতো কেউ কাজেই নিতে চায়না।
বাবাকে বারন করতে পারিনি কখনো।
অনেক ইচ্ছে ছিল
বাবাকে এসি ঘরে রাখবো,
গাড়িতে চড়াবো,
একটা স্কুটি কিনে দেব।
কিছুই পূরণ হয়নি,
গরীবের কোনো স্বপ্ন পূরণ হয়না।
দিন সাতেক হলো বাবা বিছানা ধরেছেন,
প্যারালাইসিস হয়েছে,
সেই সাথে ব্রেন স্টোক।
সব আমার জন্যেই,
আমাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে এরকম,
সারটা জীবন দিয়ে দিলো আমাকে হাসি মুখে।
আর অকৃতজ্ঞ আমি,
কিছুই দিতে পারলাম না।
সরকারি হাসপাতালের সস্তা চিকিৎসা চলছে,
ভালো হবেন না বুঝে গেছি।
এর মধ্যে বাবার মাথায় বাস্তব বোধ শেষের পথে,
ছেলের বয়স বত্রিশ,
বউমার মুখ দেখে মরতে চায়।
অবিবাহিত কণ্যার কোনো একটা গতি করে,
দিয়ে যেতে চান।
যে ছেলে তার বাপ মার মুখে দুটো অন্নের যোগান দেওয়ার জন্য,
পথে পথে ঘুরছে,
সেই ছেলের বিয়ে!!!
আমি যে পড়াশোনায় ভালো না,
এটা ঠিক নয়।
অনেক কস্ট করে পড়াশোনা করেছি,
লোকের জমিতে জনখেটে,
রাজমিস্ত্রীর যোগালে দিয়ে,
আর বাবার রক্ত জল করা ঘামদিয়ে।
খুব ভালো না হলেও,
মধ্যম মানের ছাত্র ছিলাম আগাগোড়া,
পড়া শেষের পর একটা স্কুল সার্ভিস দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি,
আর একটা আপার প্রাইমারি।
খুব ভালো পরীক্ষা দেওয়ার পরেও যে কেন ডাক পেলাম না জানি না।
আপার প্রাইমারি তে ফাস্ট ফেসে ডাক পেয়েছিলাম,
ভাইভাতে অনেক কম নম্বর পেয়েছি,
তাই চাকরিটা হওয়ার আশাও নেই।
মাঝে অন্য চাকরির জন্য যে একটুও চেষ্টা করিনি তা নয়,
অনেকটাই করেছি,
কোনটাই হয়নি।
কোনোটায় লিখিততে পাশ করেছি,
আবার কোনোটাতে ভাইভা পর্যন্ত পৌছাতে পারিনি।
যারা স্কুল সার্ভিস নিয়ে পড়ে,
তারা অনেকেই অন্য চাকরি পায়।
এ বিষয়ে আমার নীজের উপর একটা অজুহাত আছে বলতে পারেন;
সারাদিন মাঠে খেটে রাত্রি জেগে,
আমার পক্ষে এত কিছু করা সম্ভব ছিলো না।
আমার তো মনে হয়,
সত্যিকারের অর্থে সম্ভবও না।
দুই একটা টিউশনি করাতাম,
ঠিক ঠাক টাকা দিতোনা বলে,
ছেড়ে দিতে বাধ্য হই।
তার উপরে অভিভাবকদের,
চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে জেরবার হয়ে যেতে হয়।
কোম্পানির কাজ করবো,
তাও পারিনি।
কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি,
কোথাও ৮-১০ হাজারের বেশি মাইনে দিতে চায়না,
যাওয়া আসা করতে সব শেষ,
তার উপরে পড়ার সময়ও পাওয়া যায়না।
আমার একজন প্রেমিকা ছিলো,
হ্যাঁ ছিলো,
আজ নেই।
ও আমার ক্লাস মেট ছিল,
কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে প্রেম হয় ওর সাথে,
বড়লোকের মেয়ে,
অসম্ভব সুন্দরী,
আর খুব মিস্টি,
একদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলো নন্দিতা।
জোর করেই এসেছিল,
আমি ওকে আনতে চাইওনি।
মা দুজনার মাথায় একসাথে হাত রেখে বলেছিলেন,
দুজনকে খুব ভালো মানিয়েছেরে তপন।
আমার দারিদ্রতার অসহায়তার মায়ার,
প্রেমে পড়েছিল নন্দিতা।
অনেক সাহায্য করতে চাইতো,
কিন্তু কখনো ওর সাহায্য নেই নি।
ও ছেড়ে যাওয়ার পিছনে ওর দোষ পাইনা,
আর কত দিন বসে থাকবে আমার জন্য,
ওর বাবা ডাব্লিউ বিসিএস এ গ্রেডেড অফিসারের সাথে ওর বিয়ে দিয়েছে।
শুনেছি অনেক সুখে আছে।
এখন আর ও খোঁজ নেয়না,
আমিও না।
সুখে থাকুক, ভালো থাকুক।
বন্ধু ছিল অনেক,
এখন তারা আর কেউ নেই,
সবাই যে যার কাজে ব্যাস্ত,
অনেকে তো মস্ত অফিসার।
অনেকে তো চেনেই না,
যে দুই একজনের সাথে দেখা হয়,
তাদের কথা সহ্য করতে পারিনা বলে,
আজকাল ঘর থেকে বড্ড কম বের হই।
"কি রে কি খবর? "
কথাটা শুনলেই মনে হয়,
উপহাস করছে।
আজকাল আর এসব কিছু মনে করিনা,
যে অভাগার ভাগ্যটাই তার সাথে উপহাস করে চলেছে,
বন্ধুরা তো যতসামান্য।
বিয়ের বয়স পার হয়ে যাওয়া বোনটার দিকে তাকালে,
বড্ড মায়া হয়,
কয়েক দিনের মধ্যে কেমন শুকিয়ে গেছে,
ভাই বোনের খুনশুটিটা এখন আর হয়না।
এখন আমি প্রিয় জানালাটার পাশে বসেই লিখছি,
মন ভালো নেই,
অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
আমগাছ গুলোকে,
দূরের সবুজ শস্য ক্ষেত,
আর আমার স্বপ্ন গুলোকে।
কিছুই পাচ্ছিনা,
সব হারিয়ে গেছে,
সব মিলিয়ে গেছে,
রাতের অন্ধকারের মত নিঃশেষ অন্ধকারে।
একটা সময় দারুণ দারুণ কবিতা লিখতাম,
প্রেমের কবিতা,
বন্ধুরা কবি বলে ডাকতো,
এখন কলম ধরতে ভয় হয়।
জানিনা আমি আর কতদিন!!
বাবা -মা যত দিন আছেন,
তার পরে!!
আমিও হারিয়ে যাবো।
নিষ্ঠুর ভাগ্যটাকে ফাঁকি দিয়ে,
হারিয়ে যাবো অনেক দূরে।
মাঝে মাঝে মনে হয়,
ঐ তারাদের পিছনে যারা থাকে,
তারা আমাকে ডাকছে,
তারাদের দলে থাকার যোগ্যতা যে আমার নেই।