রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আলোচনা করতে বসে নিজের চারপাশ যেন একেবারে শূন্য । কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখি তাঁকে নিয়ে । আমি যেন নিজে এক ভয়ঙ্কর মহাসমুদ্রের মধ্যে একবিন্দু জলরাশি । ছোটবেলা থেকে আমরা রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধে কোন রচনা , প্রশ্নের উত্তর লিখতে গেলেই প্রথমেই তাঁকে ‘বিশ্বকবি’ বলে সম্মানের শিখরে তুলে ধরি । আর একটু বড় হয়ে জানতে পারি তিনি কেবল ‘বিশ্বকবি’ নন , তিনি ঔপন্যাসিক , ছোটোগল্পাকার , গীতিকার , শিক্ষাবিদ , প্রাবন্ধিক , নাট্যকার , গায়ক , অভিনেতা , চিত্রশিল্পী , বিশ্বপর্যটক , দেশপ্রেমিক এবং আরও অনেক কিছু । রবীন্দ্রনাথকে যত দেখি , যতভাবি – আমি রবীন্দ্রনাথের প্রেমে পড়ি । তিনি আমার ‘শয়নে–স্বপনে-জাগরণে’ বিরাজ করেন । ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে হয়ে ওঠে বিশ্বমানব সত্ত্বার এক দেবতা ।

রবীন্দ্রনাথ একাধারে যেমন দার্শনিক , ঔপন্যাসিক , কবি প্রভৃতি ছিলেন তেমনি তাঁর মধ্যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির সার্থকতা লক্ষ্যনীয় । সাধারণ মাপকাঠিতে তিনি বৈজ্ঞানিক নন , কিন্তু বিজ্ঞানমনস্কতাই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য । রবীন্দ্রপ্রতিভার মাপকাঠি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে সাধ্যাতীত । তাই রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানমনস্কতা সম্পর্কে যতই আলোচনা করা হোক না কেন তার কিছুনা কিছু অভাববোধ থাকবেই ।

রবীন্দ্রনাথ ছোটবেলা থেকে শ্রেণীগত ভাবে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করেন নি ঠিকই কিন্তু তিনি আজীবন বিজ্ঞানের জ্ঞান রসস্বাদন করেছেন । ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থে তিনি নিজেই বলেছিলেন যে , বিজ্ঞান বই পড়তে তাঁর মধ্যে ক্রমাগত “বৈজ্ঞানিক একটা মেজাজ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল” ।  

ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর একটা লোভ লালসা জন্মেছিল । শিক্ষক সীতানাথ দত্তের কাছে বিজ্ঞানের ছোটো ছোটো ঘটনা শুনে তাঁর এই বিজ্ঞানের প্রতি লোভ মাথাচড়া দিয়ে উঠেছিল – একথা তিনি ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থে নিজেই স্বীকার করেছেন । তিনি এক জায়গায় লিখেছেন – “মাঝে মাঝে রবিবার হঠাৎ আসতেন সীতানাথ দত্ত (ঘোষ) মহাশয় । আজ জানি তাঁর পুঁজি বেশি ছিল না , কিন্তু বিজ্ঞানের অতি সাধারণ দুই-একটি তত্ত্ব যখন দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিতেন আমার মন বিস্ফারিত হয়ে যেত । মনে আছে আগুনে বসালে তলার জল গরমে হালকা হয়ে উপরে ওঠে আর উপরের ঠাণ্ডা ভারী জল নিচে নামতে থাকে , জল গরম হওয়ার এই কারণটা যখন তিনি কাঠের গুঁড়োর যোগে স্পষ্ট করে দিলেন , তখন অনবচ্ছিন্ন জলে একই কালে যে উপরে নিচে নিরন্তর ভেদ ঘটতে পারে তারই বিস্ময়ের স্মৃতি আজও মনে আছে ।”  ৭৬ বছর বয়সে পৌঁছে রবীন্দ্রনাথ ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থে শৈশবের এমন নিখুঁত বিজ্ঞান শিক্ষার যে প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন তা বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি ছাড়া সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে এ কখনো সম্ভব নয় ।

১৮৭৩ সাল । রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ১২ বছর । গরাদের বন্ধন ভেঙে এই প্রথম তাঁর পিতার সঙ্গে হিমালয় যাত্রা । ডালহৌসিতে থাকার সময় তাঁর প্রথম জ্যোর্তিবিজ্ঞানের ধারনা হয় । একথা তিনি স্বয়ং তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন – “ডাকবাংলায় পৌঁছিলে পিতৃদেব বাংলার বাহিরে চৌকি লইয়া বসিতেন । সন্ধ্যা হইয়া আসিলে পর্বতের স্বচ্ছ আকাশে তারাগুলি আশ্চর্য সুস্পষ্ট হইয়া উচিত এবং পিতা আমাকে গ্রহতারকা চিনাইয়া দিয়া জ্যোতিষ্ক সম্বন্ধে আলোচনা করিতেন ।”  একথা স্বীকার্য যে কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সন্তান রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানে সুপণ্ডিত । দ্বিজেন্দ্রনাথ , জ্যোতিরিন্দ্রনাথ , স্বর্ণকুমারী দেবী প্রমুখ জ্যোতির্বিজ্ঞান ও প্রাণীবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করতেন এবং প্রবন্ধ লিখতেন । অর্থাৎ ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে বিজ্ঞান ছিল একেবারে মর্জাগত । এদিক থেকে রবীন্দ্রনাথও বৈজ্ঞানিক মানসের অধিকারী হবেন , এটাই স্বাভাবিক ।

১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সম্পাদনায় ‘বালক’ পত্রিকা বের হয় । রবীন্দ্রনাথ এই পত্রিকায় ছোটোদের উপযোগী করে বিজ্ঞান বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতেন । ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সাধনা’ পত্রিকা । এতে ‘বৈজ্ঞানিক সংবাদ সংগ্রহ’ নামে একটি নিয়মিত বিভাগ ছিল । রবীন্দ্রনাথকে জীববিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে হত । ১৯১১ থেকে ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক । জনসাধারণকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলাই ছিল এই পত্রিকার অন্যতম উদ্দেশ্য । এগুলি ছাড়াও ‘বঙ্গদর্শন’ , ‘ভারতী’ , ‘ভাণ্ডার’ , ‘শান্তিনিকেতন’ প্রভৃতি পত্রিকাতেও রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন । প্রবন্ধগুলির মধ্যে সামুদ্রিক জীব (প্রথম প্রস্তাব) কীটাণু , বৈজ্ঞানিক সংবাদ , গতি নির্ণয়ের ইন্দ্রিয় , রোগশত্রু ও দেহরক্ষক সৈন্য , উদয়াস্তের চন্দ্রসূর্য , ঈথর , ভূগর্ভস্থ জল এবং বায়ুপ্রবাহ প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য । রবীন্দ্রনাথের জীবনের একেবারে শেষ পর্বে এসে বিজ্ঞান বিষয়ক একটি পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ রচনা করলেন – যার নাম ‘বিশ্বপরিচয়’ । আধুনিক বিজ্ঞানে তিনি যে কতখানি অগ্রগতি হয়েছিলেন তার প্রমাণ স্বরূপ এই গ্রন্থ ।

কেবলমাত্র প্রবন্ধে নয় – কবিতা , গল্প , নাটক , উপন্যাস , ছোটগল্প , গান প্রভৃতি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় রেখেছেন । ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে মে মাসে ইন্ডিয়ান প্রেস থেকে প্রকাশিত ‘বলাকা’ কাব্যগ্রন্থে তিনি এক বিজ্ঞানমনস্কের পরিচয়  দিয়েছেন ।  এই গ্রন্থে ৩৬ নং কবিতায় তিনি গতিবাদের এক চিত্র অঙ্কন করেছেন । যা পড়ে সুদূর বিদেশ থেকে আইনস্টাইন শান্তিনিকেতনে ছুটে এসেছিল রবীন্দ্রনাথের কাছে –

“মনে হল এ পাখার বাণী
দিল আনি
শুধু পলকের তরে
পুলকিত নিশ্চলের অন্তরে অন্তরে
বেগের আবেগ ।”

অথবা

“    তৃণদল
মাটির আকাশ-’পরে ঝাপটিছে ডানা ;
মাটির আধার-নীচে , কে জানে ঠিকানা ,
মেলিতেছে অঙ্কুরের পাখা
লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকা ।”

১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে আনন্দবাজার পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে রচিত রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ছোটোগল্প ‘ল্যাবরেটরি’ । এই গল্পেও বিজ্ঞানের প্রভাবকে অটুট বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন । সোহিনীর স্বামী বিজ্ঞান সাধনার যে ল্যাবরেটরি তৈরী করেছিল তা সোহিনীর কোনদিন নষ্ঠ হতে দেয়নি । নিজের মেয়ের কু-নজরে এটি পড়লেও তাকে হত্যা করবার হুমকি দিতে সোহিনীর মুখে একবারও আটকায়নি – “মানব না আপনার অদৃষ্ট , মানব না আপনার কার্যকারনের অমোঘ বিধান , যদি আমার ল্যাবরেটরির’পরে কারও হাত পড়ে । ......................আমার হাতে ছুরি খেলে সহজে । আমি খুন করতে পারি তা সে আমার নিজের মেয়ে হোক , আমার জামাই পদের উমেদার হোক ।”   এখানেই রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান সাধনার প্রতিভা লক্ষ্যনীয় ।

গ্রামোন্নয়ন ও কৃষির উন্নতির দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের জুরিমেলা ভার । কৃষি নিয়ে সারাজীবন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন । একটি চিঠিতে তিনি জগদীশচন্দ্র বসুকে লিখেছেন – “আমার চাষ-বাসের কাজও মন্দ চলিতেছে না । আমেরিকান ভুট্টার বীজ আনইছিলাম – তাহার গাছগুলা দ্রুতবেগে বাড়িয়া উঠিতেছে । মান্দ্রাজি সরু ধান রোপণ করিয়াছি , তাহাতেও কোন অংশে নিরাশ হইবার কারণ দেখিতেছি না ।” (২৪-শে জুন ,১৮৯৯)  তিনি বোলপুরে শ্রীনিকেতনের কাছে কৃষি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন । নিজের স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও বন্ধু শ্রীশচন্দ্রের পুত্র সন্তোষচন্দ্রকে আমেরিকায় পাঠিয়েছিলেন কৃষি ও গো-পালন পদ্ধতি শেখবার জন্য । আবার গ্রামোন্নয়নের জন্য তিনিই প্রথম সমবায় ব্যাঙ্ক চালু করেন । ভাবলে অবাক লাগে একজন নোবেল জয়ী কবি গ্রামবাংলার ছোটছোট সমস্যা নিখুঁত বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনায় তা সমাধান করেছে – সত্যিই আমি হলফ করে বলতে পারি রবীন্দ্রনাথ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন কবি , ঔপন্যাসিকের পক্ষে এ পরিকল্পনা অসম্ভব ।

আজ সারা পৃথিবী জুরে যে যন্ত্রসভ্যতার অট্টহাসি আমাদের কানে আসে , সেই যন্ত্রসভ্যতার অশুভ দিকটি রবীন্দ্রনাথ ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ‘মুক্তধারা’ নাটকের মধ্যে দেখিয়েছেন । আশ্চর্যের বিষয় এর সমাধানের পথও তিনি আমাদের দিয়েছেনঃ “সে থামা কী যন্ত্রকে থামিয়ে দিয়ে ? আমি তা বলিনে । থামাতে হবে লোভ । সে কি ধর্ম উপদেশ দিয়ে হবে ? তাও সম্পূর্ণ হবে না । তার সঙ্গে বিজ্ঞানেরও যোগ চাই । যে সাধনায় লোভকে ভিতরের দিক থেকে দমন করে সে সাধনা ধর্মের কিন্তু যে সাধনায় লোভের কারণকে বাইরের দিক থেকে দূর করে সে সাধনা বিজ্ঞানের । দুইয়ের সম্মিলনে সাধনা সিদ্ধ হয় । বিজ্ঞান বুদ্ধির সঙ্গে ধর্মবুদ্ধির আজ মিলন অপেক্ষা আছে ।”

“বিজ্ঞান মানুষকে মহাশক্তি দিয়েছে । সেই শক্তি যখন সমস্ত সমাজের হয়ে কাজ ক্রবে তখনি সত্যযুগ আসবে ।”  বাঙালি কবির মুখ থেকে এমন উদ্ধৃত্তি শুনে নিজেকে বাঙালি বলে গর্ভবোধ করি । যে মানুষটি শৈশব থেকে ধারাবাহিক গতানুগতী বাঁধাধরার মধ্যে বিজ্ঞান বিষয়টিকে অধ্যায়ন না করে ; নিজের মনের জোরে কবিতা , উপন্যাস , প্রবন্ধ , কাজকর্ম ও ব্যক্তিগত অধ্যায়নের মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞানকে এক বৃহৎ পরিবেশে আবদ্ধ করেছেন – তিনিই রবীন্দ্রনাথ । তাই আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর সম্পর্কে যথার্থই বলেছিলেন – “তুমি যদি কবি না হইতে তো শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক হইতে পারিতে ।”   আমিও এই মতে এক মত ।

তথ্যসূত্রঃ –

১। ‘বিশ্বপরিচয়’ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২। ‘জীবনস্মৃতি’ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩। ‘বলাকা’ কাব্যগ্রন্থ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪। ‘ল্যাবরেটরি’(ছোটোগল্প) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৫। ‘মুক্তধারা’(নাটক) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৬।  রবীন্দ্রসংখ্যা (১৪০২) – পঃবঃ তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ
৭। ‘রবীন্দ্রনাথের বৈজ্ঞানিক মানস’ – অমিয়কুমার মজুমদার
৮। বসুমতী মাসিক পত্রিকা (মে,২০১২)