প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালে সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশ – আমাদের এই বঙ্গভূমি। এই দেশ জল জঙ্গলে পূর্ণ, আর্দ্রতায় সিক্ত। হিমালয় দাঁড়িয়ে আছে শীর্ষভূমিতে। বঙ্গোপসাগরের জলে ঢেউ খেলে যার চরণতলে। আর নদী নালা খাল বিলে পূর্ণ ছিল এই দেশ – তাই নাম হয়েছে গঙ্গাহৃদি বঙ্গভূমি। এক সংহত নৃগোষ্ঠী এখানে বিদ্যমান ছিল। বিভিন্ন কারণে অন্যান্য প্রান্তের লোক বা আক্রমণকারীরা ঢুকতে পারেনি এই দেশে। তাই বাংলা ছিল স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল। এই স্বাতন্ত্র্যই তাকে অপরের কাছে বিরূপ করেছে। হয়ত এখানকার মানুষদের চিন্তায়-ভাবনায় তেমন কোনো সমুন্নত মহিমা ছিল না। প্রত্যপশালী আভিজাত্য গর্বিত আর্যরা মনে করত বাংলা ছিল অনার্যদের দেশ। ‘দেশোহনার্যনিবাসঃ’। বোধায়ন ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে যে বঙ্গ প্রভৃতি দেশে বাস করলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। নির্বাসিত পান্ডবরাও এই ব্রাত্য দেশে আসতে চাননি। তাই এটা ছিল পাণ্ডববর্জিত দেশ। বাংলা ভাষাও উন্নত ছিল না, বাণভট্ট বলেছেন ‘গৌড়েষু অক্ষরডম্বর’।
.
ক্রমে বাংলার মর্যাদা প্রতিপন্ন হল। বিভিন্ন শাস্ত্রে ধর্মগ্রন্থে রামায়ণ মহাভারতাদি গ্রন্থে গৌড়বঙ্গ সম্মানের আসন লাভ করল। অবহেলা অবজ্ঞার ধূলিমালিন্য অতিক্রম করে বঙ্গভূমি আপন মহিমায় অধিষ্ঠিত হল। কালে কালে বাংলার সীমানা অনেক প্রসারিত হয় এবং তা ভৌগোলিক পরিসরের সঙ্গে ভাষা-সাহিত্যের সমন্বয়ে দূর বিস্তৃত হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গেই প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. নীহাররঞ্জন রায় জানিয়েছেন যে - ‘উত্তরে হিমালয় এবং হিমালয় হইতে নেপাল, সিকিম ও ভোটান রাজ্য; উত্তর-পূর্বদিকে ব্রহ্মপুত্রনদ-উপত্যকা; উত্তর-পশ্চিমদিকে দ্বারবঙ্গ পর্যন্ত ভাগীরথীর উত্তর সমান্তরালবর্তী সমভূমি; পূর্বদিকে গারো-খাসিয়া-জৈন্তিয়া-চট্টগ্রাম শৈলশ্রেণী বাহিয়া দক্ষিণ সমুদ্র পর্যন্ত, পশ্চিমে রাজমহল-সাঁওতাল পরগণা-ছোটনাগপুর-মানভূম-কেওঞ্জর-ময়ূরভঞ্জের শৈলময় অরণ্যময় মালভূমি, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর – এই ভূখন্ডই ঐতিহাসিক কালের বাঙালীর কর্মকৃতির উত্স এবং ধর্ম-কর্ম-নর্মভূমি’ (বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদি পর্ব)।
.
বাংলার যথার্থ ইতিহাস রচিত হয় গুপ্ত যুগ থেকে। এই সময়ে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে বাংলার সভ্যতা-সংস্কৃতি বিশেষভাবে গড়ে ওঠে। হূণ আক্রমণে গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভিত নড়ে যায়। বিভিন্ন রাজ্য ঘোষণা করে স্বাধীনতা। গৌড় এমনই এক রাজ্য। রাজা শশাঙ্কর নেতৃত্বে স্বাধীন গৌড়রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে। শশাঙ্ক ছিলেন কোনো গুপ্ত রাজার সামন্ত। তিনি ‘শ্রীমহাসামন্ত শশাঙ্ক’ রূপে উল্লেখিত হয়েছেন। তিনি ছিলেন শক্তিশালী রাজা। তিনি ছিলেন গৌড়াধিপত্। কর্ণসুবর্ণ ছিল তাঁর রাজধানী। তিনি বাংলাকে ঐতিহাসিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। গৌড়কে কেন্দ্র করে তিনি এক বিরাট রাজ্য গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর (৬৩৭ খ্রীষ্টাব্দ) পর বাংলায় শুরু হয় বিশৃঙ্খলা অরাজকতা। প্রায় একশ বছর ধরে চলে এই নৈরাজ্য। দেশে কোনো নীতি নিয়ম নেই, চলছে মাত্সন্যায় – সবাই রাজা হতে চায়, আবার আজ যে রাজা পরদিনই সে নিহত হচ্ছে।
.
তখন দেশের মানুষরা সমবেতভাবে এক ধীর, বিচক্ষণ যোদ্ধাকে বাংলার রাজারূপে নির্বাচন করলেন। তার নাম গোপালদেব। গোপালদেব সবাইকে নিয়ে কুচক্রী দুষ্কৃতিদের দমন করে, দুর্নীতিপরায়ণ জমিদারদের শাসন করে এক ঐক্যবদ্ধ সুনিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। প্রতিষ্ঠিত হল পালবংশের শাসন। তার মৃত্যুর পর রাজা হন ধর্মপাল, তারপর দেবপাল। পালবংশ প্রায় চারশ বছর রাজত্ব করে ১১৬০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত।
.
পালবংশের পতনের পর বাংলার সিংহাসনে বসলেন সেনবংশের রাজারা যারা সুদূর কর্ণাটক থেকে এসেছিলেন। এই বংশের বিজয়সেন গৌড়ের সেনরাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পুত্র বল্লাল সেন প্রায় কুড়ি বছর রাজত্ব করার পর রাজা হন, লক্ষ্ণণসেন ১১৭৮ খ্রিষ্টাব্দে। সেন বংশের রাজত্বকালে বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রসার ঘটে। লক্ষ্ণণসেনও ছিলেন অত্যন্ত বিদ্যোত্সাহী রাজা। তাঁর রাজসভাকে অলংকৃত করেছিলেন বিশিষ্ট জনেরা – যেমন, হলায়ুধ মিশ্র উমাপতিধর গোবর্ধন আচার্য জয়দেব শরণ ধোয়ী প্রমুখ। তবে সম্ভবত তাঁর সময়ে ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের মানুষ জমিদার বা অর্থবান ব্যক্তিরা যতটা গুরুত্ব পেতেন সাধারণ মানুষরা সেরকমই ছিলেন অবহেলিত ব্রাত্য। তাই ইফতিকার উদ্দিন-বিন-বখতিয়ার খিলজী মাত্র কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে লক্ষ্ণণসেনের রাজধানী নবদ্বীপ আক্রমণ করলে বৃদ্ধ লক্ষ্ণণসেন কোনো প্রতিরোধ করতে পারেননি এবং সপরিবারে পূর্ববঙ্গে পলায়ন করেন ও সেখানে তিনি রাজত্ব করেন কয়েক বছর। ১২০৬ খ্রীষ্টাব্দে তিনি প্রয়াত হন। (চলবে এই বাংলার হৃত ইতিহাসের খোঁজ)
.