কবিতার উপায় থেকে কবিতার স্থান ও তার শক্তির যে আকর্ষণ শক্তি তার মূল খোঁজ করতে গিয়ে আমায় পুরাণ...বিশেষত কৃষ্ণের গীতায় ঠাই নিতে হয়েছে। এরপর যীশু বা অন্য মহাপুরুষের কথাও প্রসঙ্গে আসতেই পারে। আসলে শক্তির খোঁজ থেকেই কল্পনা শক্তির জন্ম। আর সেই শক্তির থেকেই কবিতা ও কবিতার উপত্যকা। তবু বলতেই পারেন এসব গুজব। বলতে পারেন মানবধর্ম শ্রেষ্ঠ। আমি এসব মানি না। তবু বলি....কবিতাও তো অনেক কিছু মানে না। তাই আসুন আমরা উপত্যকাময় কবিতার খোঁজে চলার পথে গীতার মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানকে বুঝে তারপর এগিয়ে চলি।
.
গীতায় কৃষ্ণ বললেন – তিনি নিখিল জগতের স্থিতি ও প্রলয়ের কারণ...অর্থাৎ পরমেশ্বর স্বরূপ এক স্থির ব্রহ্ম থেকে সকলের উৎপত্তি। আবার কালক্রমে তাতেই লয় প্রাপ্তি। যোগসাধনার দ্বারা যোগীর প্রাণের চঞ্চল প্রকৃতি যখন স্থির হয়, তখন মনও স্থির। মন জ্যোতিতে লয় হয়, জ্যোতি ধ্বানির মধ্যে বিলীন হয়। সাধনার উত্তরণে এই ধ্বনি অনন্ত চিদাকাশে এবং চিদাকাশ পরমপুরুষ (পরমাত্মা বা পরম শক্তি) এর সাথে সংলীন হয়। দেহবোধ ও বিশ্ববোধ চলে যাওয়ায় আত্মবিস্মৃত হন যোগী। এটাই হল আমা হতে উৎপত্তি ও আমাতেই লয়।
.
দেহবোধ ও বিশ্ববোধ সম্মিলীত অবস্থান এক সূক্ষ্ম ও বৃহত্তর অবস্থান। একক শক্তি চরম বৃহত্তর শক্তি -- বিশ্ববোধ শক্তির এক অংশে আকর্ষণ শক্তি মানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তিতে পরিণত হয়। আমরা যে বলি না, লেখার মধ্যে একটা টান রয়েছে। এই আকর্ষণের মূলে তো মাধ্যাকর্ষণ। আর কর্ষণ মানে ঘুরে ফিরে সেই কৃষ্ণ...যিনি কর্ষণ করেন। যাইহোক আমি ঘেটে ঘ করতে চাইছি না। আসলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সমগ্র বিশ্বকে চালনা করে। কিন্তু আইনস্টাইনের মতামত অনুসারে মাধ্যাকর্ষণ বল নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে না। যুক্তির মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠিত। স্থান কালের মাঝে সুবিধাজনক পদযাত্রার মধ্যেই এই অপরিহার্য যুক্তিগুলি আত্মগোপন করে রূপক কবিতার মতো। মাধ্যাকর্ষণ সময়কে মন্থর করে দেয়, নিউটনের তত্ত্ব সেখানে আপেক্ষিকতা বাদের কোয়ান্টাম ফিজিক্সের কাছে পরাজিত। এই যে লেখককূল তাদের মনে অনন্ত প্রশ্নের উদয় হবে, লেখকের অভিজ্ঞতায় এইসব প্রশ্নগুলিই আপেক্ষিকতাবাদ বোঝার পথে বাঁধা। ইঞ্জিন কিভাবে কাজ করে তা বুঝতে যদি পরিবেশ দূষণ মাথায় আসে তাহলে আলোচনাটি বিঘ্নিত হয়। আসলে চৈতন্য (পরা) শক্তি দ্বারা শক্তির অবস্থান নিরীক্ষণ করা হয়। স্থির বৃহত্তর অসীম শক্তির অবস্থান অন্ধকার ও ঠান্ডার মতো, চঞ্চলতা শক্তি (মাধ্যাকর্ষণ) তাপ ও আলোর অবস্থানের মতো মনে হয়। তাই ঠান্ডা ও অন্ধকারের মতো বৃহত্তর অসীম, অনন্ত শক্তি থাকে অজ্ঞাত। তাপ ও আলোর মতো বৃহত্তর অকল্পনীয় আকর্ষিত বল শক্তিতে অনুপস্থিত তাই এই মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অনুভব। তাই তো নিজের আত্মশক্তির মধ্যে অসীম অনন্ত শক্তি অনুভূত হলে যোগী বলেন আমি অনন্ত শক্তি। যেমন ২০০০০ হার্জের উপরের শব্দ আমাদের সাধারণের শ্রুতি গ্রাহ্য নয়, কিন্তু সারমেয়রা শুনতে পায়। তাই বিপদ আসলে তারা আগে বুঝতে পারে। সে মৃত্যুই হোক বা ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
.
ঠিক এখান থেকেই কবিতার আসল খোঁজ। কবিতাও তেমনই। সকলে কি সেই সময়ে কবিতা বুঝতে পারে। কালজয়ী লেখা তো সময় উত্তীর্ণ হলেই বহুল চর্চিত হয়। সুকান্ত ভট্টাচার্য বা জীবনানন্দ দাশ-কে নিয়ে আজও কত উৎসাহ লক্ষণীয়। কবিতার এই ঘরাণার খোঁজ করতেই তো আশ্রয় নিতে হচ্ছে পুরাণের কাছে। আর পুরাণেই লুকিয়ে আছে বিশ্বজনীন বিজ্ঞানের অমোঘ রহস্য। আসলে কবিতার পিছনে থাকে বাস্তব ও কল্পনার মেলবন্ধন। তাই তো বীজের মধ্যে আত্মা সুপ্ত থাকে বলেই চারাগাছ একদিন পূর্ণ রূপ পায়। নিশ্চয়ই এই প্রাণ পূর্বেই রোপিত থাকে। ঠিক যেমন ভাষা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নোয়াম চমস্কি বলেছেন ভাষা জ্ঞান নিয়েই শিশু জন্মাই। ভাষা শিশুর জিনের অংশ। আর কালক্রমে সেই ভাষাই প্রকাশিত হয় কবিতায়। তার শুরু মা শব্দের ছন্দময় কান্নার মধ্য দিয়ে...আর শেষ ওহম(ওঁ) -এর মধ্য দিয়ে। প্রতিটি বীজ বিশাল বট বৃক্ষের চেতনা। প্রত্যেকের ভিতর যে রিপয়েটার থাকে তাই পরবর্তীতে তাকে লিখতে, পড়তে, বলতে শেখায়। আর আমরা জানি বাংলা ভাষা তো অর্জিত চেতনা। সেই চেতনা নিয়েই আমাদের কবিতার উপত্যকায় পৌঁছাতেই হবে।
.
বিখ্যাত বিজ্ঞানের ইতিহাস রচয়িতা হলটনের মতে বিজ্ঞানীদের কল্পনা শক্তি জীবনের শুরুতেই পরিপূর্ণতা লাভ করে। অ্যারিস্টটলের ভাষায় কৌতুহল যে কোন দর্শনের বুনিয়াদ। আর বুনিয়াদি জীবন মসৃণ করে প্রাত্যহিক কাজ। প্রতি দিনের ভিতর লুকিয়ে থাকে কবিতা। তাই কবিতাময় চেতনের মাঝেই আমাদের অবস্থান। তাহলে বিশ্ব ব্রহ্মান্ডই কি কবিতার উপত্যকা...নাকি ঐ ৯৯ শতাংশ শক্তি যার খোঁজ মানুষের অগোচর সেখানেই লুকিয়ে আছে সেই উপত্যকা। আপনাদের সাথে আমিও খোঁজ করব সেই উত্তর। আপনাদের কবিতার উপত্যকা সম্বন্ধে কিছু জানা থাকলে জানাবেন...অপেক্ষায় রইলাম। (ক্রমশ)
.