(আসলে প্রিয় কবি রণজিৎ মাইতির এই কবিতাটির আলোচনায় মন্তব্য দিতে গিয়ে অনেক বড় লেখাটি হয়ে যাওয়াতে কবিতার বিশ্লেষণ হিসাবেই প্রকাশ দিলাম।)
"চলো একটু পালিয়ে বাঁচি"
কবিঃ দেবেশ মহান্তি
চলো না হয় কিছুক্ষণ চাঁদটার নিচে বসি
কয়েকটি মূহুর্ত বাস্তবের রুঢতা ভুলে থাকি।
মাংসল অস্তিত্বের ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলে একটু রূপকথায় বাঁচি।
চলো না দিনের ধুলো ঘাম জোছনার জলে ধুয়ে ফেলি।
কিছুক্ষণ অন্তত রোজকার এই ব্যর্থতাপ,
এই প্রতিদিনের মৃত্যু, ক্ষোভ, হতাশা,
এই জীবনের পরাজয়, রিক্ততা, ভয়
না হয় মিছিমিছি, ভুলে থাকি
শ্রান্ত হৃদয়ে চলো একটু জোছনার আশ্রয় খুঁজি।
সমগ্র কবিতাটিতে বিষন্নতার করুণ সুর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত। বাস্তব কঠিন কঠোর জীবন থেকে এক পল একটু শান্তির জগতে যিনি অতিবাহিত করতে চান, যেখানে থাকবে না কোনও চাহিদা, না দুঃখ না আশাহত পরিবার ও স্ত্রীর মাত্রাধিক কটু কথন যা হৃদয়কে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে যায় প্রতিনিয়ত, না পাওয়ার মর্মব্যথা। যেখানে থাকবে না কোনও বস ও তার ধমকের কচকচানি, পরিশ্রমের সঠিক মূল্য না পাওয়ার পরিবেদনা। থাকবে না ছেলে মেয়েদের বায়না পূরণে অক্ষমতা হেতু মনোবেদনা। যেখানে থাকবে শুধুই প্রশান্তির শীতল স্নিগ্ধ পরশ। কতখানি মনোবেদনা হলে একজন মানুষ এভাবে চিন্তা করে থাকে।
সমাজে তিন শ্রেণীর মানুষ রয়েছে। ধনী , মধ্যবিত্ত ও গরিব সম্প্রদায়। গরিব যারা দরিদ্রতা মেনে নিয়ে যা পায় তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে থাকে। তারা আকাশ কুসুম চিন্তা কখনই পোষণ করে না তাই দরিদ্রতাকে সঙ্গী করে বেশ সুন্দর ভাবেই জীবন অতিবাহিত করে।
অপরদিকে ধনী সম্প্রদায় যাদের অন্তত খাওয়া পড়ার কোনও অভাব নেই যা ইচ্ছে তাই করতে সক্ষম তাদেরও গার্হস্থ জীবনের অনেক জ্বালা যন্ত্রণার মধ্যে দিন অতিবাহিত হয়। পারিবারিক কোন্দল , সম্পত্তির দখলদারি তৎসহ মামলা বিবাদ বিসংবাদ, স্ত্রীর পরকীয়া প্রবৃত্তি, সন্তানের নেশা প্রবৃত্তি ইত্যাদি সহ বিভিন্ন বিষয়ে মাকরসার জ্বালের মতই এসবের পরিবলয়ে জীবন অনেক সময়েই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে সংসারের হাল ধরা , রোজগার করা মানুষটির। কেউ কেউ তো একসময় আত্মহননের পথই বেছে নেন এসব জ্বালা যন্ত্রনা থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য।
আর এক শ্রেণীর মানুষ যারা মধ্যবিত্ত যারা সংখ্যাধিক্য এই সমাজে তাদের হাল সবারই জানা। তবুও কবিতার বিশ্লেষণের খাতিরে না হয় একটু লিখলাম। মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় এমন একটি সম্প্রদায় যারা শিক্ষিত বা অতিশিক্ষিত হয়ে থাকে, খাওয়া পড়ার অভাব থাকে না বললেই চলে তবে ওই টুকুনই। এর বেশি উদ্বৃত্ত ধন তাদের হাতে থাকে না আর যেটা থাকে তা হলো সম্ভ্রম আর লজ্জা যা ধনী সম্প্রদায়ের থাকে না, আর আছে ধনী লোকেদের সাথে নিরন্তর প্রতিযোগিতা। আজ সমাজে শিক্ষা থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বাড়ি গাড়ি সবকিছুই লাগামছাড়া দাম কাজেই যারা মধ্যবিত্ত যাদের হাতে গোনা পয়সায় জীবন ধারণ করতে হয় তাদের পরিবারে নিত্য নৈমিত্তিক অশান্তি লেগেই থাকে।
মধ্যবিত্ত মানুষজন খুবই সৌখিন হয়ে থাকে আর তারা সমাজে একটি স্ট্যাটাস বা কী বলবো! অবস্থান মেইনটেন বা বজায় রাখতে চায় সর্বদাই। ক্ষমতার বাইরে হলেও তারা তাদের সন্তানকে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পাঠাবেই কারণ না হলে তো আর সেই জায়গাটা বজায় রাখা যাবে না। তারা ভাবে লোকে তাদের তাহলে পাত্তাই দিবে না। তাদের একটা বাড়ি বা ফ্লাট লাগবেই আর সেজন্য যেন তেন প্রকারেণ ব্যাঙ্ক থেকে সুদে টাকা নিয়ে তা তারা বাগিয়ে নিবেই আর দশ বছরে ফ্ল্যাটের আসল দামের দ্বিগুণ টাকা তারা ফেরৎ দেবে। গাড়ি কেনার লোন, পর্সোনাল লোন, কনজিউমার লোন , ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি তো আছেই। সমর্থের বাহির এভাবে নিজেকে তারা নিমজ্জিত করে থাকে আর তাই প্রতি একশো জনের মধ্য নব্বই জনই কোথাও না কোথাও ঋণ খেলাপী হয়েই থাকে।
এমন টানাপড়েন লেগেই থাকে মধ্যবিত্ত পরিবারে, বাবুর টিউশন ফিস, ইস্কুলের মাইনা, মামনির নাচের ড্রেস, স্ত্রীর অলঙ্কার, নিত্যনৈমিত্তিক ফ্যাশন আর কেনাকাটা, কাজের মাসির বেতন , নিত্যদিনের বাজার পত্তর, মা বাবার কথা ছেড়েই দিলাম, বউ বাচ্চা কাচ্চার নিত্য নতুন বায়না পূরণ তাদের হাতখরচ, ঔষধ পত্তর-ডাক্তার, ইলেকট্রিক বিল, দুধের বিল জলের বিল, আমোদ প্রমোদ; মধ্যবিত্ত লোকের সংসারে পরিবারের সদস্যরা দামী হোটেল বা রেস্তারা ছাড়া অন্য কোথাও খেতে পছন্দ করে না আর তো আর ৫০ টাকার মিনারেল ওয়াটার আর ওয়েটার কে মন মাখিক টিপস, ঠ্যালা তো বোঝেন বাবু আর তো আর রয়েছেই উপড়ি পাওনা ব্যাঙ্কের টাকা ফেরৎ দেবার নোটিশ, এন পি এ, কনজিউমার লোনের টাকা ফেরৎ, এটা ওটার মানে ফ্রীজ বা ল্যাপটপ বা মোবাইল অন্য কিছুর ই এম আই!! ওরে বাবা রে!! ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।
সব কিছু ছেড়ে ছুঁড়ে দিয়ে দু-দন্ড কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে একটু শান্তির কামনায়। চলো একটু পালিয়ে বাঁচি।
ভারি সুন্দর অর্থবহ একটি কবিতা উপহার দেবার জন্য কবিকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। ভালো থাকুন ভালো লিখুন।