গতকাল বোলপুরের টাউন হলে হলে হয়ে গেল কালের খবর পাক্ষিক পত্রিকার উদ্যোগে, "বিশ্ববঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি উৎসব ২০১৯"। শুক্রবার কাঞ্চনকন্যা ট্রেনে বোলপুরের টিকিট কেটে রওনা দি। ট্রেন সকাল পাঁচ টায় বোলপুরে পৌঁছুবে আর তিন চার ঘন্টা স্টেশনে কাটাতে হবে ভাবতেই খারাপ লাগছিল আর তাই ভোর চার টায় রামপুরহাটে ট্রেন পৌঁছুলে সেখানে নেমে পরি। উদ্দেশ্য তারাপিঠে পূজো দেওয়া। তাতে সময়টা সহজেই কেটে যাবে আবার তারা মায়ের পূজা দেয়াও হয়ে যাবে এই ভেবে। সকাল পাঁচটার আগেই তারাপিঠ পৌঁছে যাই। চা খেয়ে মন্দিরে যাই। সময় কাটাতে হবে তাই টাকার লাইনে না গিয়ে বিনে পয়সার লাইনেই দাঁড়াই। তারপর যারপরনাই ভোগান্তি। লাইন আর এগোয় না। আমার আগে অন্তত তিন শো'র ওপর লোক। সবাই অতিষ্ঠ। অনেক প্যাঁচ ঘুরে যখন শেষ গেটের কাছে পৌঁছুলাম তখন ৯।৩০ টা বেজে গেছে। দশ বারো জন সামনে থাকা অবস্থায় গেট বন্ধ হয়ে গেল। এ অসহ্য যন্ত্রনা থেকে বাঁচতে সবাই জয় তারা, জয় তারা বলে চিৎকার করছে। আমিও বাঁচবার জন্য তাদের সাথে সুর মিলিয়ে চিৎকার করতে থাকলাম জয় তারা জয় তারা বলে। অনুভব করতে পারলাম কেন এই মন্দিরে সবাই চিৎকার করে জয় তারা , জয় তারা বলে আর সারাদিন এই গুঞ্জনে ভরে থাকে এই মন্দির। তবে এখানে একটি অলৌকিক ব্যাপার ঘটে গেল আমার সাথে। ঠাণ্ডা লেগে রাত থেকেই নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছিল আর তাই একটি রুমাল কিনতে হয়েছিল আমাকে। লাইনে দাঁড়িয়ে এক দুবার এমন হতেই আমি মনে মনে মা'কে স্মরণ করে এ যন্ত্রনা থেকে মুক্তি চাইছিলাম কারণ আমার একহাতে আমার ব্যাগ আর অন্য হাতে পূজো দেবার সামগ্রী ধরা ছিল। অবাক হয়ে গেলাম তৎক্ষণাৎ আমার সে ব্যামো দূর হয়ে গেল। আর কখনই আমাকে রুমাল ব্যবহার করতে হয় নাই। এটা যে একটা অলৌকিক ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয় বিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে যথেষ্ট বুঝতে পারলাম। এ সকল অসুখ এত দ্রুত হটাত করে মিলিয়ে যেতে পারে না। যাইহোক তারপর ট্রেন ধরে বোলপুর। আগেই বোলপুর অবধি টিকিট কাটা ছিল আর বেশ কয়েকজন আলাপচারিতায় বলেছিল যে আমাকে টিকিট কাটতে হবে না। পূর্বে অনেক অনেক দুর্ভোগের সম্মুখীন অভিজ্ঞতা আমাকে যেন বলছিল এটা কনফার্ম করতে হবে। তাই এনকোয়ারি কাউন্টারে সে টিকিট দেখিয়ে প্রশ্ন করি তাকে, সে বলে, এটা ফেলে দিন আর নতুন টিকিট কেটে নিন। যাক একটা ফাড়ার হাত থেকে মুক্তি পেলাম। বোলপুর পৌঁছে প্রিয় কবি বিমল মন্ডলকে ফোন করলাম কোন হোটেলে আমাদের রুম বুকিং আছে তা জেনে নিলাম। হোটেলের নাম নিরালা লজ। সেখানে পৌঁছুলে কবিসকল আমার নাম আর ধাম জানাতেই উষ্ণ অভ্যর্থনা করলেন। রুম ও পেয়ে গেলাম। যদিও নিদ্রক্লৃষ্ট অবসন্ন ছিলাম তবুও একটু ফ্রেস হয়ে একটা কাফের খোঁজ করে একটি লেখা প্রকাশ দিলাম। দু এক ঘন্টা আসরে থাকতাম তবে তখনই বিমল বাবুর ফোন চলে এলো। তারাও এসে গেছেন। প্রকৃত পক্ষে তার আমন্ত্রণেই সেখানে যাওয়া। তাই হোটেলে ফিরে এলাম। কুপন পেলাম দুপুরের আর রাত্রে খাবারের। একটু বাদেই হোটেলেই দুপুরের খাবার সবাই খেয়ে নিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলি ঘুরে দেখবার। বিমল বাবুকে ফোন করলাম, তিনি বললেন তিনি কাল্ত অবসন্ন তাই এখন একটু ঘুমাবেন। আমি তার চেয়েও অনেক বেশি অবসন্ন ছিলাম কিন্তু সময় যে নেই। এখানে এসেও সে সব না দেখে চলে যাব! তাও কী আবার হয় নাকী। একটা টোটো নিলাম বললাম রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ব বিদ্যালয়ে নিয়ে চলুন। তিনি বললেন ওখানে তো ১০-১৫ টা গেট, কোন গেটে আপনি যাবেন। তাকে বলি, আমি এখানে প্রথমবার এসেছি আর লেখালেখি করি মানে কবি! কাজেই আমাকে সে গেটেই নিয়ে চলুন যেখানে গেলে রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত স্থানসকল আমি দেখতে পারবো। তিনি বললেন আমরা তো গাইড হিসাবে এমন ঘুরিয়ে দেখিয়ে থাকি। বললাম কত নেবেন। তিনি বললেন, তিন চার শ টাকা নেই তবে আপনি একা তাই ১৫০ টাকা দিলেই হবে। আমি বললাম ডান। দু টো থেকে বিকাল চারটা অবধি তিনি অটোতে , আবার কোথোও পায়ে হেঁটে সেখানকার সব কিছু দেখালেন আমাকে। আমি চাক্ষুষ করলাম আমার প্রিয় রবি ঠাকুরের গৃহ, তার স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর সেই গৃহ, যা কীনা তার মৃত্যুর পর থেকে সিল করে রাখা আছে। দেখলাম সেই তালপুকুর যেখানে কবি নজরুল একবার বেড়াতে এসে এই পুকুরের ধারে বসেই, "বাবুদের তালপুকুরে...।। লেখাটি লিখেছিলেন, আম্র কুঞ্জ যেখানে ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস টেন অবধি গাছের নিচে মাটিতে বসে ক্লাস হয়। বকুল কুঞ্জ, আরও অনেক অনেক মানে সব কিছু আর সে গাইড ইতিহাসের মতই সব বলে যাচ্ছিলেন। জানলাম কী ভাবে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এত বড় জায়গাটি পেয়েছিলেন, সে জমিদারের কথা আর তার দেওয়া শর্ত। এটা জানতে পেরেছিলাম আমার করা প্রশ্নের উত্তরে। চলতে চলতেই তাকে আমার বেশ কয়েকটি লেখা শুনিয়েছিলাম। তিনি বিকাল চার টায় আমাকে হোটেলে নামিয়ে দিলে অনেক বেশি পয়সা দিয়েছিলাম। পরে বিমল বাবু এসব শুনে অনেক আফশোস করছিলেন।অম্ত্যন্ত খুশি ছিলাম আমি। তারপর একটি টোটোতে সবাই মিলে টাউন হল।
বিকাল সোয়া চার টা নাগাদ অনুষ্ঠান চালু হয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। তারপর আয়োজক কবিসকল সবাই কবিতা ও সাহিত্য নিয়ে বক্তব্য রাখেন। সবারই বক্তব্যে আজকের দিনের সমাজ অবক্ষয়ের ভাব প্রকাশ ছিল আর তা থেকে উত্তীর্ণ হতে কবি সকলকে এ ব্যাপারে শক্ত হাতে লেখনী ধরবার আহ্বান ছিল। তার পর শুরু হয়ে যায় কবিতা পাঠের মনোজ্ঞ অনুষ্টান। সবাইকেই দু তিনটি করে কবিতা বলবার সুজোগ দেওয়া হয়। আর সাথে সাথে সংবর্ধনা। মানপত্র, পদক আর স্মৃতি ফলক সেখানে দেওয়া হয়। আমিও আমার লেখা একটি দেশভক্তির আর একটি বিদ্রোহী লেখা পাঠ করি। এভাবেই চলে রাত সারে আট টা অবধি। তারপর শুরু হয় লোকগীতি। বিমলবাবু কিছু কেনাকাটা করবেন তাই অনুষ্টানের শেষের দিকে আয়োজক কবিসকলের থেকে বিদায় নিয়ে মার্কেটে যাই। তারা সেখানে একটি শপিং মলে ঢুকে গেলে আমি আমার রসদের সন্ধানে বেড়িয়ে পরি। আগের দিনও হয় নি, আজও না হলে তো চলবে না। যদিও বিমলবাবু অনেক না করেছিল।
যাই হোক, সেখানে থাকা অবস্থাতেই আবার বিমল বাবুর ফোন আসে। কোঠা পুরো করে হোটেলে চলে আসি। কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে ঘুমের দেশে চলে যাই। সকালে বিমলবাবুই আমায় ডেকে তোলেন। তারা চলে গেলে আমিও ফ্রেস হয়ে আর কবিসকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দেই আর ৯।১০ মিনিটে কাঞ্চনজঙ্গা ট্রেনটি পেয়ে শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেই।
এবার ট্যুরে বিশেষ কিছু দুর্ঘটনা ঘটে নাই। হবার মধ্যে শুধু একটা রিডিং গ্লাস যেটা সেখানে কিনেছিলাম সেটা হারিয়ে ফেলেছি আর চেম্বারের চাবি না পেয়ে তালাটা ভেঙে ফেলে ঢুকতে হলো।
বিনীত আপনাদের প্রিয় সঞ্জয় কর্মকার।