আমরা সকলেই নজরুলের জীবনের কিছু না কিছু অধ্যায় পড়েছি কিংবা শুনেছি। কখনও নজরুলকে আমরা দুখু হিসেবে চিনেছি কিংবা কখনও সাহসী সৈনিক। আবার কখনও দেখেছি চায়ের দোকানের মিসিয়ার কিংবা আবার কখনও দেখেছি সাহসী বিদ্রোহী লেখক। কাজী নজরুলের সাহিত্যের বিচক্ষণতার কথা তো বলাই বাহুল্য। এছাড় কবি নজরুল শিশুদের নিয়ে লিখেছেন অনেক মজার মজার গল্প, উপন্যাসসহ কবিতা। যা এখন শিশুশ্রেণি থেকে শুরু করে অনার্স/ মাস্টার্স পর্যায়ে বড়দের জন্য বিভিন্ন আঙ্গিকের লেখা পাঠ্যবইয়ে লিপিবদ্ধ রয়েছে। কবির জীবনের কিছু অংশ যদি আমরা ঘাটাঘাটি করি তাহলে দেখতে পাই, কবি মূলত শিশুদেরই কবি। সমালোচকদের দৃষ্টিকোণ থেকে কবিকে বিদ্রোহী কবির পাশাপাশি তারুণ্যের কবি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। যদিও অনেক সাহিত্যপ্রেমিকরা কবিকে যৌবনের কিংবা সময়ের সাহসী খুঁড়ো দার কলম সৈনিক হিসেবে চিনে। সেই মহান কবির জীবনাচরণের কিছু অধ্যায় নিয়ে আলোচনা করলে বেরিয়ে আসে অনেক না জানা কিছু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি বাংলা আধুনিক সাহিত্যের পটভূমি রচনায় একেবারেই নিজ ধারা গড়ে তোলেন-মধুসূদন,রামমোহন,ঈশ্বরচন্দ্র,বিহারীলাল এবং বঙ্কিমচন্দ্রসহ সে অনেক কবি সাহিত্যিকরা। তাদের মাঝে আবার মধুসূদন এবং বঙ্কিমের সাহিত্যিক প্রভাব এতটাই পরিব্যপ্ত ছিল যে- স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্রও তাতে সমৃদ্ধ করেছেন নিজেদের পরিসর। পরে মধুসূদন এবং বঙ্কিমের মত নিজ সাহিত্য বিনির্মাণে সার্থক হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। পরবর্তী যত সাহিত্যিক এসেছেন তারা প্রায় সবাই কম বেশি সেসময়ের লেখক-কবিদের দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত। একমাত্র উজ্জ্বল ব্যতিক্রম-মহাপ্রতিভাধর কাজী নজরুল ইসলাম। সাহিত্যের যে কয়টি ধারায় তার সার্থক বিচরণ ঘটেছে,তার সবগুলিতেই ঠিকরে পড়েছে-অপরিসীম স্বকীয়তা। যে কালে রবীন্দ্রনাথের সর্বপ্লাবী প্রভাব অতিক্রম করাই ছিল রীতিমত অসম্ভব,সেই কালে এমন মৌলিক সাহিত্য প্রতিভার উন্মেষ-এক আশ্চর্য অধ্যায়। কিন্তু তার চেয়েও বড় আশ্চর্যের বিষয় হল-সাহিত্যের মূল ধারা থেকে পরিকল্পিতভাবে- তাকে নির্বাসিত করবার চেষ্টা করা হয়েছিল। যার কমতি হয়নি-নজরুলের জীবনকালে,এমনকি বর্তমানেও সেই অপপ্রয়াস সদর্পে পরিলক্ষিত হয়। অনেক সময় তাকে কবি হিসেবেই স্বীকৃতি হয়নি,আবার কখনো তাকে ফেলে দেয়া হয়েছে-নিতান্ত সাধারণের দলে। ১৯২১ হতে ১৯৬০ পর্যন্ত যত প্রতাপশালী সাহিত্য পত্রিকা নেতৃত্ব দিয়েছে উপমহাদেশের সাহিত্যকে তার বৃহদাংশই তার বিরুদ্ধে করেছে অবিরাম বিষোদ্গার। কল্লোল যুগের পত্রিকাগুলোও তার অন্যতম।
আধুনিক কবিতার স্বঘোষিত পথিকৃৎরা সকলেই-তার সম্পর্কে এক প্রকার ঈর্ষামিশ্রিত সংকীর্ণতায় আবদ্ধ ছিলেন। যেন রবীন্দ্রনাথ ব্যতিত আর কারো কাছেই তাদের কোনো ঋণ নেই। বুদ্ধদেব বসু তাকে অভিহিত করলেন ‘প্রতিভাবান বালক’। কিন্তু তথাকথিত প্রতিভাবান বয়োজৈষ্ঠরা বাংলা সাহিত্য আর শিল্প-সংস্কৃতিতে প্রতিভাবান বালকের নিকটেই পরাস্ত হলেন বারবার। সামাজিক আন্দোলন আর বিদ্রোহের বাণী নিয়ে আরো অনেক কবি কাজ করেছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়,সুকান্ত ভট্টাচার্য এর মত অনেকেই সুপ্তভাবে তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েও তা স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করেছেন আজীবন। নির্জনতা আর ধূসরতার কবি জীবনানন্দও তার প্রারম্ভিক পর্যায়ে নজরুল দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন সচেতনভাবে। অন্তত তার শব্দচয়ন-থেকে সহজেই তা অনুমেয়। বিষ্ণু দে,সুধীন্দ্রণাথ প্রমুখ নজরুলকে নিয়ে-একপ্রকার নিরুচ্চারিত-নীরব ভূমিকায় অবগাহন করেছেন। শক্সখ ঘোষ,ফররুখ আহমদ,সৈয়দ আলী আহসান,তালিম হোসেন,অমিয় চক্রবর্তী,অচিন্ত্য সেন সহ আরো বহু কবির পশ্চাতে-নজরুলের নিভৃত উপস্থিতি অনস্বীকার্য। তিরিশ,চল্লিশ,পঞ্চাশের দশক সহ পরবর্তী বহু যুগের আবর্তন পেরিয়ে নজরুল আজো সমান প্রভাবে প্রাসঙ্কিক। যখনই দ্রোহের প্রয়োজন,অথবা সাম্য-শান্তির জাতিগত উপলব্ধি,তখনই তিনি হাজির হন-তার চিরদিনের বিজয় উল্লাস নিয়ে। কিন্তু তার এই বিস্ময়কর উত্থান যেন সকলের ঈর্ষার বস্তু,যা পরম ভক্তির যোগ্য-তা পরিশেষে সামান্য স্বীকৃতিও পায়না।
আর এখন সূচিত হয়েছে-তাকে নির্বাসিত করার প্রয়াস। জাতিগতভাবে,তাকে উপেক্ষা এক সংকীর্ণ চেষ্টা ঘিরে রেখেছে দিক-বিদিক। জন্ম-জয়ন্তী আর মৃত্যু-জয়ন্তীর সামান্য পরিসরে অর্গল পরেছে, যেন মহাবিদ্রোহী এই মহাসৈনিক। তার সমগ্র সাহিত্য আজ বিশ্লেষণ,ব্যাপক গবেষণা,নিত্যদিনের যুক্তিনিষ্ঠ পাঠ আর অনুশীলনের অভাবে নতুন প্রজন্মের থেকে রয়ে গেছে দূরে। কালের অমোঘ আক্রমণে সংগীতের সুবিশাল সংগ্রহ-ক্রমে ক্ষীয়মাণ। আর একাডেমি-ইন্সটিটিউটগুলো চির পুরাতনের নিয়ম পরিগ্রহ করে, মুখ থুবড়ে পড়েছে কবির সঠিক সময়নিষ্ঠ মূল্যায়ণ করতে। জাতীয়ভাবে তার আজীবনের কর্ম ও সাধনার যে বস্তুনিষ্ঠ চর্চার প্রয়োজন ছিল, তা একেবারেই এখন অনুপস্থিত বলে দৃশ্যমান হয়। অন্যদিকে নজরুলের চেয়ে অনুল্লেখ্য কবি-সাহিত্যিকরা এখন চেতনার জোর পূর্বক ধ্বজাধারী হয়ে মূলধারা গ্রাস করবার অপচেষ্টায় লিপ্ত। এমন পরিস্থিতিতে তার উপর আরো কার্যকর গবেষণা অপরিহার্য। প্রয়োজন তার সৃষ্টিকর্মের প্রযুক্তিগত বিন্যাস। ইন্টারনেটে কবির শিল্প-সাহিত্য-গানের আরো ব্যাপক প্রসার করা যেতে পারে। কবির প্রচলিত-অপ্রচলিত গানগুলি স্বরলিপি সহকারে সংরক্ষণ ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে তার শুদ্ধতাসহ অনুশীলন একান্তই প্রয়োজন। এর পাশাপাশি রিয়েলিটি শো আয়োজন করে কবির গান-কবিতাকে,প্রজন্মের আরো কাছে আনা সম্ভব। এছাড়া বড় শহরগুলিতে কবিকে নিয়ে বড় আকারের উৎসব এবং বইমেলা আয়োজন করা যেতে পারে।
কারন কাজী নজরুল ইসলাম এমনই এক বিস্ময়কর প্রতিভা যিনি তার সময়ের চিন্তা-চেতনাকে সবচেয়ে বেশি ধারণ করার পাশাপাশি,প্রভাবিত করেছেন-পরবর্তী এক সুদীর্ঘ সময়কে। ঔপনিবেশিক শাসনকে মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ করেছেন নিঃশেষে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তার থেকে সরব কণ্ঠ,১৯২০-৪০ অবধি দুর্লভ। তিনি সাহিত্য-সংগীতকে ব্যক্তিকেন্দ্রীক না করে,স্পষ্টবাদি- জাতিসত্তা করেছেন। প্রয়োজনে পরিভ্রমণ করেছেন পারস্য,আরব,ইউরোপ,প্রাচীন ভারত আর মিথলজীর সাহিত্যিক উপাদানে। সুর সংগ্রহ করেছেন একেবারে বিশ্বজনীনভাবে।
সাহিত্যরস আর সংগীতের অনিবার্যতায় সম্ভাব্য সকল উৎস থেকেই তিনি অকাতরে নিয়েছেন বৈচিত্রের অবকাঠামো। এতখনি বিশ্বজনীনতা তৎকালীন সময়ে তো বটেই বর্তমানেও বিরল। বোদলেয়ার,র্যাঁ বো,মালার্মে,ইলিয়টের উপর নির্ভরতা-তার ছিল না। অনায়াসে সবকিছু থেকে উপাদান নিয়ে নিজ কাঠামো তৈরীতে তার দক্ষতা ছিল জন্মগত। এজন্য তার কবিতা-সংগীত কারো নিকটবর্তী নয়,নয় কারো অনুসরণের ফলাফল।
ব্রিটিশ শাসনের নির্দয় কষাঘাতে জর্জরিত জাতির প্রয়োজন ছিল-দুর্দান্ত গতি,বজ্রপাতের মত প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর,বিভেদ ভুলে সীসা ঢালা ঐক্য আর অগ্রসরতার বিপুল উদ্যম। নজরুল সবই দিয়েছিলেন-অমৃতের মত। জাতির পাল্স,তিনি অনুধাবন করেছিলেন ঠিকমতই। তাই তার মত বজ্র ধ্বনির অধিকারী আর কেউ হতে পারেননি সেসময়।
অন্যরা যখন নিরাপদ দূরত্বে থেকে- ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ,পরাবাস্তববাদ,আধুনিকতাবাদ আর প্রেম-প্রকৃতির পূজায় মগ্ন;তখন জাতিগত মহান দায়িত্ব পালনে যুদ্ধরত ছিলেন-শুধু একজন মহাকবি। মানবিক প্রে-ভাব তারল্য তার সাহিত্যেও প্রচুর;তবে তার থিম বড় স্পষ্ট আর মানুষের কাছাকাছি। কবির জাতীয় আন্দোলন চিন্তা-অতিক্রম করে প্রেম-বিরহের আলোড়ন। দেশ আর মানুষ বাঁচাতে-এত সহমর্মী সাহিত্য পাওয়া সুকঠিন-এই উপমহাদেশে। আর কেউ এভাবে সরব হলেননা-মানবিকতা,সামাজিক সাম্য,¯অধিকার এবং সব পেরিয়ে নিখিল ভারত মাতার স্বাধীনতা অর্জন নিয়ে। তাই আর সবাইকে পেরিয়ে গেল তার আকাশছোঁয়া- জনপ্রিয়তা। একজন কবি,গায়ক,সংগীত পরিচালককে যে মানুষ-এত আপন করে নিতে পারে,তা কেবল নজরুলের উদাহরণেই প্রযোজ্য।
তার ঘটন-অঘটন পটিয়সী প্রতিভার দিব্য স্পর্শ যেখানেই দিয়েছেন-সোনা ফলেছে সেখানেই। বিচিত্র তার নির্মাণ কৌশল; বর্ণাঢ্য তার সৃষ্টিসম্ভার। এত অল্প সময়ে,কী করে এত বিপুল দ্ক্ষতা অর্জন করেছিলেন সাহিত্য-সংগীতে,আলাদাভাবে সেটাই হতে পারে এক গবেষণার বিষয়। যেখানে কেবল কবি হতেই প্রয়োজন হয় সুদীর্ঘ প্রস্তুতির। সেখানে মাত্র দুই দশকের মধ্যেই তিনি ছাড়িয়ে গিয়েছেন-সমকালীন সকল কবি সাহিত্যকদের।
কবি মানেই যে- জনবিচ্ছিন্ন এক ব্যক্তিসত্ত্বা;সেই ধারনাকে বিচূর্ণ করে, তিনি নেমে এলেন সব শ্রেণীর মানুষের কাছাকাছি। দূর থেকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত লক্ষ্য করলেন-তার অসীম প্রাণশক্তির জয়জয়াকার। স্থবির,প্রশান্ত বাংলা সাহিত্য পেল এক অভিনব গতি,যার সীমাহীন দুঃসাহস স্তম্ভিত করল-পরবর্তী অনুজ সাহিত্যিকদের। নিয়তির অমোঘ বিধানে বাকরুদ্ধ না হলে,নজরুল এই দুঃসাহসী ধারাকে-কোথায় নিয়ে যেতেন-তা অনুমান করা দুঃসাধ্য।
মূলত নজরুল নিজে কখনো পরাশক্তির কাছে মাথানত করেননি। নিজের প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন তাঁর সাহসী লেখনির দ্বারা। যা যুগে যুগে সাহিত্য অঙ্গনে একটি কালজয়ী অধ্যায় হয়ে রয়েছে। যা চিরন্তন অবিনশ্বর ভূমিকায় বলবদ হয়ে থাকবে।