সৌমেন বাবু একেবারে নির্ভেজাল বাঙালী!
একদম সাধাসিধে জীবন যাপন, সরকারি মাইনে আর ধর্মকম্ম করে
স্ত্রী - সন্তান নিয়ে বাপ -দাদার ভিটেতে তার জীবন বেশ সুখময়ই কাটছে!
প্রাত্যহিক জীবনে বাড়িতে সাদা ধুতি পড়তে তিনি বেশি পছন্দ করেন।
যদিও এটা শতাব্দী একুশ চলছে,
কিন্তু সেটা অন্যদের জন্যে হতে পারে,
কিন্তু তিনি বাপ -দাদার ঐতিহ্য নিয়ে একটু পুরানো গোছের!
তবে তিনি কিন্তু সেকেলে হয়ে আছেন এটা শুনতে নারাজ!
তিনি বিশ্বাস করেন বাঙালীয়ানাতেই জীবনের আসল সুখ লুকিয়ে আছে!
বাঙালী জীবনের মতো আর কোন সরল জীবন
পৃথিবীর আর কোন জাতির থাকতেই পারে না!

প্রভাতে দেবতাকে প্রণাম না করলে সে আবার কিসের শুদ্ধ লোক!
তাই গোসল সেরে তিনি সকাল সকাল ঠাকুরকে প্রনাম করেন,
আর স্বর্গীয় পিতা- মাতাকে শ্রদ্ধাঞ্জলী দেন!
পিতামহের চশমাটা মুছে তিনি প্রতিদিন তার বর লাভ করেন!
তারপর সকাল সকাল গিন্নির হাতে রঙ চা নিয়ে পত্রিকার পাতা না উল্টালে
তার দিনটি সুন্দরভাবে শুরু হয়েছে মনেই হয় না!
আগে দুধ চা চলতো,
কিন্তু পাড়ার মোহনবাবু তার কাছে
রঙ চায়ের মাহাত্ন্য বিশ্লেষণ করার পর
তিনি রঙ চায়ে নিজেকে অভ্যস্ত করে তুলেছেন!

পত্রিকার পাতা উল্টে ধীরে ধীরে শুদ্ধ উচ্চারণে পত্রিকা পড়াটা
তার শুদ্ধ চর্চার একটি বড় দিক!
অথচ কোথায় কি হচ্ছে, কে কাকে মারলো, কোন দল কার কি দোষ বের করলো
প্রধানমন্ত্রী রাত আটটায় কি বললেন তাতে এক প্রকার তার কিসসু আসে যায় না!
তবুও তিনি ভালো করে পত্রিকা পড়েন!
আসলে সচেতন বাঙালীর পরিচয় হলো রোজ সকালে পত্রিকা পড়া!  
আর তার শুদ্ধ উচ্চারণটা সবার কাছে খুব প্রশংসনীয়!
একালের বাঙালী ছেলেমেয়েদের তো প্রাশ্চাত্য বেপোরোয়া হাওয়া লেগেছে!
তাই তারা পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যের তোয়াক্কা তো করেইনা
উপরন্তু বাংলাটাও শুদ্ধ করে বলতে পারে না!

কোন শিক্ষার্থী ভালো ফল করেছে অথচ ভুল উচ্চারণ করছে শুনলে
তিনি তার সাথে কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন!
`এ বাঙালী বৎস দিয়ে জাতি রক্ষা হবে না‘ তিনি প্রথমেই বুঝে ফেলেন!
নাস্তার টেবিলে তিনি প্রায়ই এ প্রসঙ্গটা তোলেন!
বোধ থেকে ভাষা, ভাষা থেকে যোগাযোগ, তারপর হয় সম্পর্ক এরপর সব শেষে আসে দায়িত্ব!
অথচ ভাষারই যদি কদর না থাকে তবে লোকে সম্পর্কের কদর কোত্থেকে থাকবে বাপু?
আর তাই তো বাল্যবন্ধুদের একজনের সাথেও তার সম্পর্কও টিকে নি!
তার দুই পুত্র আর একমাত্র কন্যাকে তিনি খুব দায়িত্ব নিয়ে বাংলা ভাষার কদর শেখান।
ভাষার জন্য প্রাণ দিতে পারাটা যে কত বড় বীরত্বের আর সম্মানের কাজ
তা তিনি বাচ্চাদের সব সময় বোঝান।

তবে গিন্নিকে তিনি শুদ্ধ উচ্চারণ শিখিয়ে উঠতে পারেননি বিগত আঠারো বছরেও!
এতবছর শিখিয়ে দেবার পরেও তার প্রায়শই ভুল হয়!
নাহ! আগ্রহের কমতি থাকলে কোন কালে কি কেউ কিছু রপ্ত করতে পারে?
বিরস মুখে সৌমেন বাবু টিফিন ক্যারিয়ারটা নিয়ে অফিসে রওনা করেন!
তিনি জানেন তার গিন্নি সুকমলা দেবী তার শুদ্ধভাষা চর্চা করাটাকে বাড়াবাড়ি মনে করেন!
পরিণয়ের সময় তার বাপ- দাদার পছন্দ না হলেও তার স্বর্গীয় মাতার খুব পছন্দ হয় তার গিন্নিকে
তার মাতা বলেছিলেন `এ মেয়ের চেহারা তো সাক্ষাৎ দেবী প্রতীমার মতো‘!
তাই শেষ পর্যন্ত আঞ্চলিক টান থাকলেও মাতার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে তিনি অমত করেননি।


বাসে সবসময় ধীরে ওঠেন তিনি।
একদম তাড়াহুড়ো করাটা তার মোটেও পছন্দ নয়।
কিন্তু তিনি খুব অপছন্দ করেন কেউ যখন তাকে ধাক্কা দিয়ে
বিজয়ের হাসি দিয়ে সামনে এগিয়ে সীটখানা দখল করে!
বাঙালী পড়ছে, শিখছে, কিন্তু ভদ্রতা আয়ত্ত্ব করতে পেরছে না কিছুতেই!
শিষ্টাচার যে এ জাতি কবে শিখবে তা ঈশ্বর ভালো জানেন!

অফিসে পৌছে প্রতিদিন তিনি একই চিত্র দেখেন।
নতুন ছেলেগুলো কাজ ফাঁকি দিয়ে
সারাটে দিন কম্পিউটারের সামনে বসে হাসতে থাকে!
আর একটু পর পর সামনের বুতাম যন্ত্রটা টিপাটিপি করে!
আর মধ্যাহ্ন ভোজের সময় হলে মোবাইলে কি যে কথা বলতে শুরু করে
বাব্বা! ঘন্টা পেরিয়ে যায়….
অথচ তাদের কথা ফুরায় না!
মানুষ বিরক্ত হলেও তাদের যেমন গায়েই বাঁধে না!
এ প্রজন্মটা পড়ালেখা শিখলেও ভদ্রতা সর্বাংশে শিখতে পারেনি!

মাঝে মাঝে তিনি ভাবেন!
আচ্ছা! ওদের না হয় কাজ- কাম নেই তাই রাজ্যের আলাপ জুড়ে বসেছে!
কিন্তু অত কথা শোনার সময় কার আছে- তিনি ভেবে পাননা!
নাকি কোলকেতে শহরে সবাই আস্তে আস্তে বেকার হয়ে পড়ছে!
কি জানি বাবা! তার তো ঢের কাজ আছে!

এই মোবাইল যন্ত্রটা একদিকে ভালো!
দূরের মানুষের সাথে ‘তার‘ ছাড়া কথা বলা যায়।
তবে এর ক্ষতিকারক দিকটিই বেশি।
ছেলেমেয়েরা মোবাইল পেয়ে উচ্ছন্নে যাচ্ছে দিন দিন!
কোথায় কি ঘটে যাচ্ছে তার খেয়াল না রেখে সবাই
ঐ হতচ্ছড়া যন্ত্রটাতে বুঁদ হয়ে থাকে সারাক্ষণ!
সেদিন রাজারহাটে এক ছেলে বাসায় একা ছিলো,
তার মা বলেছিলো তরকারি হলে নামিয়ে খেয়ে নিতে।
ছেলেটা মোবাইল টিপতে টিপতে বেমালুম ভুলে গেলো!
তারপর তরকারি পুড়ে কয়লা হয়ে ঘরে যখন ধোঁয়া হলো শেষে ছোকড়ার হুশ হলো!
আগুন- আগুন বলে চ্যাঁচালে তার প্রতিবেশীরা দমকল বাহিনীকে ফোন দেয়,
তারপর তারা এসে অজ্ঞান অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে!
আগুন বাড়লে পাশে ফ্যাক্টরী ছিলো, সব কিছু তছনছ হয়ে যেতো!
ওদিকে পানিহাঁটিতে, এক প্রবাসীর স্ত্রীর লাশ উদ্ধার হয়েছে।
তার সাথে নাকি কার অবৈধ প্রণয় ছিলো!
ছিঃ ছিঃ
সৌমেন বাবু তার সস্তা মোবাইলখানাকে টেবিলে রাখেন।

তবে অফিসের ছেলেগুলো তাকে দেখে মিটমিটিয়ে হাসে!
বড়কর্তা রুদ্রবাবু ওনাকে কম্পিউটার শিখতে বলেছিলেন কিছুদিন আগে।
ছাই! এ শেষ বয়সে আর এ মেশিনটা শিখে কি হবে?
তার চেয়ে ঢের সহজে তিনি ছোকড়াদের চেয়েও
ভালো করে হিসেব কষতে পারেন!
নতুন ছেলেগুলো ব্যবসায় গণিতে পাশ করে এলে কি হবে,
তারা যন্ত্র ছাড়া হাতে- কলমে কাজই করতে পারে না!
একদিন বসুক দেখি তার সাথে পাল্লা দিতে!
একটাও তার হাতের দক্ষতার সাথে কুলোতে পারবে না!

দিনভর নাকের ডগায় চশমা এনে কাজ সেরে সৌমের বাবু
ভাবলেশহীন মুখে অফিস থেকে বের হয়ে আসেন।
পথে একটু হেঁটে গেলেই দেখতে পান হট্টগোল চলছে।

দাঁড়ি টুপি জুব্বাওয়ালা এক লোক অন্য আরেকজনের শার্টের কলার ধরে টানছে!
মুসলমান এতো অসহিষ্ণু হয় কি করে তিনি বুঝতে পারেননা!
আর লোকটাও পাল্টা আক্রমণ হিসেবে টুপিওয়ালার টুপি ফেলে দিয়ে তার চুলের মুঠি ধরলো!
কথায় বুঝা গেলো অন্য লোকটা হিন্দু!
এদেশের হিন্দু- মুসলিমরাও পারে ভাই!
ধর্মের দোহাই দিয়ে কাটাকাটি, হানাহানি, কেউ- কাউকে একটুও ছাড় দেয় না!
অথচ মুসলমানকে বললে বলবে, তারা পরম ধৈর্য্যশীল,
আর হিন্দুকে বললে বলবে, তারা শান্তির দেবতার অখন্ড ভক্ত!
আদতে এরা ধর্ম কি বোঝেই নি!
ধর্মগ্রন্থ কখনও হৃদয়ের চক্ষু দিয়ে অনুধাবনও করেনি!
কেবল পরকে দেখে চর্চা করে কিছু শিখেছে মাত্র!
সে শিক্ষায় আর ধর্মগ্রন্থে, আছে যোজন যোজন দূরত্ব!
তাছাড়া গুরুর সহচর্য না থাকলে
কেবল কিছু কেতাবী বিদ্যে শিখলে
ভরা রাস্তায় এমনতর অভদ্রতাই আসে ভেতর থেকে!

আশেপাশের লোকেরা অবশ্য তাদের ছাড়িয়ে মিটমাট করানোর চেষ্টা করছে!
কিন্তু কেউ কাউকে ছাড়ে না!
কিন্তু বাবু কোন ঝুট -ঝামেলা কুতর্কে জড়ান না কখনও!
তাই, সামনে দেখে পাশ কাটিয়ে হেঁটে চলে আসলেন।

পাড়ার মোড়ে চা খেতে কখনও তাকে দেখা গেছে
ছেলে বুড়োরা হলফ করে বলতে পারবে না!
এ তো আসলে পরনিন্দা -পরচর্চার বাজে আড্ডাখানা!
সব পরের কেচ্ছা- কেলেংকারী!
এতে সুস্থ্য মানুষের থাকা উচিত নয়!
তাই সৌমেন বাবুর পেট মোটা টাক অবয়বের ছায়াটিও সেখানে মাড়ায়নি কখনও!
আর বিড়ি সিগারেটের আসর তো তার কাছে চির পরিত্যাজ্য!
তার তিন পুরুষকে তিনি কখনও এ দুর্গন্ধযুক্ত অপচয় করতে দেখেননি!
একই ব্যাপার মদ্যপানের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য!
মূলত তারা মগভর্তি দুগ্ধ পানে অভ্যস্ত গোষ্ঠী!
আর তাই তো তিনি এখনও সুস্থ্য সবল সিদ্ধ পুরুষ!

বাসায় ফিরতেই তিনি দেখতে পান
তার ছোট ছেলে তাকে দেখে পড়িমড়ি করে বাসায় ফিরছে!
সন্ধ্যে বেলা তার বাড়ি ফেরার আগে সবাইকে গৃহে "প্রত্যাবর্তন" করতে হবে।
নইলে সৌমেন বাবু অন্যরকম মূর্তি ধারণ করেন!

শান্ত স্বর অথচ কঠিন বাচন ভঙ্গী আর অগ্নীশর্মা চক্ষু
তার ছেলেপেলের নেত্র কোণা ভিজিয়ে দিতে সক্ষম!
এসময় কোন কোন দিন তিনি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা সংস্কৃত লিখতে দেন ছেলেমেয়েদের !
তার কাছে মনে হয় বাচ্চাদের শাসন করলে এমনভাবে শাসন করা উচিত
যেনো ভালো কিছু তারা শিখতে পারে!
তার গিন্নিও এতে বাঁধা দেন না।

তারপর রঙ চা ও সন্ধ্যের নাস্তা নিয়ে গিন্নি এসে তাকে কুশল জিজ্ঞাসা করেন।
তখন অফিসে ঘটে যাওয়া ছোটখাটো ঘটনা তিনি গিন্নিকে বলেন।
কখনও কখনো কোন সাংঘাতিক কান্ড ঘটলে
সেটাও তিনি খুব মজা করে বলতে পারেন!
বাঙালী কর্তাবাবুরা তো গিন্নিদের সাথে সেভাবে সুন্দর করে কথাই বলে না!
কিন্তু আমাদের সৌমেন বাবু এদিক থেকে ব্যতিক্রম!

এখনকার দিনে ছেলেমেয়েরা মোবাইল পেয়ে পড়াশুনা চুলোয় চড়িয়েছে।
অনেকের মুখে শোনেন,
তাদের ছেলে -মেয়েরা রাত জেগে মোবাইল চালিয়ে ফল খারাপ করছে।
তখন তিনি বলেন, মশায়! যদি ছেলে-মেয়েদের অত্যাধিক ছাড় দেন তবে এ দশা তো হবেই!
তার ছেলে-মেয়েরা অবশ্য তার মতই ব্যতিক্রম বা বলতে হয়
তার কঠোর সাংসারিক শৃঙ্খলার জন্য ব্যতিক্রম!
ফি বছর তারা ক্লাসে ফার্স্ট হচ্ছে, খেলাধূলায় ও কবিতা আবৃত্তিতে তারা সবার চেয়ে এগিয়ে!
নিজের শিষ্টাচার ও পারিবারিক শৃঙ্খলাকে নিয়ে যে সঠিক পথে তিনি এগুচ্ছেন
তা বেশ ভালোই বুঝতে পারেন।

এরপর তিনি বেডরুমে গিয়ে আয়েশ করে সোফায় গা এলিয়ে বই পড়তে শুরু করেন।
এই বই পড়ার নেশাটা তার বাল্যকাল থেকেই।
খেলাধূলায়ও তার যথেষ্ট ঝোঁক ছিলো।
তবে সৌমেন বাবুর সবকিছুই যেনো শৈশব থেকে দারুণ ভারসাম্যের মধ্যে দিয়ে গড়ে তোলা!
তাই, যৌবনে মগজধোলাইয়ের রাজনীতি আর প্রেম ভালোবাসার মোহে না ডুবে
সাহিত্য সমিতিতে নাম লিখিয়েছিলেন।
লেখালেখি করতেন, আবৃত্তি করতেন প্রধানত রবীন্দ্র রচনাবলী।
তার লেখা কয়েকবার দৈনিক আনন্দবাজার ও দৈনিক বর্তমানে ছাপা হয়েছিলো।
মনে আছে, একবার আনন্দবাজারে তার "আসানসোলের দুঃখী ছেলে"
কবিতাটা ছাপা হলে তার দাদু তাকে খুশি হয়ে সে সময় ৫ টাকা দিয়েছিলেন!
তার দাদুও এ পত্রিকায় লিখতেন, তার বাবাও লিখতেন
বংশ পরম্পরা অব্যাহত থাকায় দাদু বেজায় খুশি হয়েছিলেন সেদিন!
দিনটি ছিল তার কাছেও পরম আনন্দের দিন!
সেদিন বন্ধুমহলে কবি হিসেবে খ্যাতি পাওয়া হয়ে ওঠে তার!
তারপর সবসময় কম -বেশি লিখেই গেছেন।

আসানসোলের সে দুঃখী ছেলে নজরুলের সৃষ্টিকর্মের প্রতি তার অগাধ টান!
এ লোকটিকে নিয়ে যতটুকু আলোচনা হওয়া দরকার
তা কোনকালেও খুব একটা হয় নি এটাই তার বিশ্বাস!
এ পরগনার সন্তান, এখানে জন্ম
অথচ শেষটা হয়েছে কন্যাতুল্য দেশে!
ভারত মাতার মাতৃক্রোড়ে তার শেষ জায়গা হয়নি
এটা নিয়ে তার বেশ আক্ষেপ!

এছাড়া তার লেখক বন্ধু আছেন দু' চার জন।
তারা প্রায়শই নিত্য নতুন বইয়ের যোগান দেন তাকে!
এছাড়া দুবার সেরা কর্মকর্তার পুরষ্কার হিসেবে অফিস থেকে দুটো রবীন্দ্র সমগ্র দেয়া হয়েছিলো তাকে
এই দুটো, বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাপ পর্যন্ত পুরষ্কার হিসেবে ঢের বই তার কাছে আছে।
এগুলো তিনি যক্ষের ধনের মতো সাজিয়ে রেখেছেন সেগুন কাঠের কারুকাজ করা পৃথক সেলফে!
বইগুলো তিনি কাউকে পড়তে দেননা।

কারণ, বাঙালীরা বইয়ের কদর করতে পারে না!
তবুও কিভাবে যেনো বাঙালীর ঔরসে জগৎসেরা কিছু সাহিত্যিক এলো!
ভাবতে ভাবতে সত্যজিৎ রায়ের "যখন ছোট ছিলেম" বইটার উপরে নজর পড়ে।
এ মহান ব্যক্তিটির সবকিছু ভালো তবে একটি জিনিস বাদে!

সত্যজিৎ রায়ের সিগারেট খাওয়া তিনি পছন্দ করেন না!
উপরন্তু তিনি নাকি আবার জুয়ার আসরে যেতেন, তাও নাকি বিলেতে!
আচ্ছা সিগারেট কি খেতেই হয় খ্যাতিমান মানুষদের?
সৌমেন বাবু প্রার্থনা করেন এটা যাতে ভুল তথ্য হয়!

এরপর তিনি টেপ রেকর্ডারে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজান।
এই একটি জিনিসই সুখে- দু:খে তার চিরসঙ্গী ছিল।
হোক মন ভালো কিংবা খারাপ
তিনি প্রতিদিন রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনবেনই।
রাতে ঘুমাতে যাবার আগে রবীন্দ্র সঙ্গীত না শুনলে তার ঘুমই আসে না!
“মন মোর মেঘের সঙ্গী“ -গানটি বেজে চলেছে আর সৌমেন বাবু মূর্ছনায় মিশে যাচ্ছেন!
এ যুগের ছেলে-মেয়েরা রবীন্দ্র নজরুল শোনে না,
শোনে বিজাতীয় আজে বাজে সঙ্গীত!
ছোটবেলায় মহানায়কের ছবিতে কত্ত সুন্দর গান থাকতো!
অথচ এখন কি সব খোকাবাবুদের সিনেমা চলছে!
তাতে না আছে শৈল্পিক ছোঁয়া না আছে জীবন বোধের অপূর্ব চিত্রায়ন!
অথচ সেগুলোই পাড়ার মোড়ে তান্ডবের মতো বাক্স ছেড়ে ছেলে ছোকড়ারা পাড়া গরম করে শোনায়!
তখন কি যে অসহ্য লাগে তার, তা বলে বোঝানো যাবে না!

কিছুক্ষণ পর তিনি বেতের আরাম কেদারা ছেড়ে উঠে গিয়ে টেপ রেকর্ডারটি বন্ধ করেন।
তারপর বাইরে বারান্দায় গিয়ে আকাশের পানে তাকান!
আজ চান্নি পসর রাত!
ওপার বাংলার প্রবাদ প্রতীম সাহিত্যিক হুমায়ূনের এক জনপ্রিয় গান
তারা সহজ- সাবলীল লিখা তাকে মুগ্ধ করতো!
কারণ তিনি নিজেও অত জটিল করে লিখতে পারেন না।
হুমায়ূন চেয়েছিলেন চান্নি পসর রাতে যেনো তার মরণ হয়।
অথচ তার মরণ হয়েছিলো ঝড় ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ বৃষ্টি বিধুর রাতে!
স্বদেশ থেকে বহুদূরে পরবাসে ঘুমের ঘোরে অচেতন অবস্থায়!
গৃহত্যাগী জোছনা আর তাঁর দেখা হয়নি!
প্রকৃতি সাহিত্যিকদের প্রতি চিরকাল বিরূপ!

সেবার তার সাথে হুমায়ূনের দেখা হয়েই যেতো কোলকাতার বইমেলায়!
কিন্তু পরম শ্রদ্ধেয় সমরেশ মজুমদারের জন্য সেটা হলো না!
উনি এসে উপস্থিত হওয়ায় সোনার বাংলার সোনার ছেলে হুমায়ূন
অগ্রজের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে যে দৃশ্যের অবতাড়না করলেন
তাতে হুমায়ূনের প্রতি সৌমেন বাবুর শ্রদ্ধা বাড়লেও
সাথে সাথে হুমায়ূনকে ঘিরে পাঠকবৃন্দ এমন ভাবে হামলে পড়লো যে
অগত্যা তাকে অটোগ্রাফ না নিয়েই চলে আসতে হলো!

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সমরেশ মজুমদারও সেদিন
ঠিক তার উপন্যাসের নায়কের মতো,
অনুজের খ্যাতির বিড়ম্বনাটা বিষ্ময়ে দেখলেন!
সমরেশ মজুমদার পরে একদিন যখন বললেন তাকে, সুনীলকে, শংকর, বুদ্ধদেবকে নিয়ে
এতো মাতামাতি কখনও হয়নি, যা এ লোকটিকে নিয়ে হয়,
সেদিনই তিনি বুঝেছিলেন রসায়নের এ বহুমুখী মেধাবী অধ্যাপকটি
বাংলা সাহিত্যকে পাঠকের মাঝে আবারও পুনর্জীবিত করে দেবে!
আর তাই হয়েছে শেষ পর্যন্ত!
সাহিত্য যুদ্ধবিধ্বস্ত এক দেশের জীর্ণ শির্ণ দেহের, পাঞ্জাবী পড়া এক যুবককে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে
সেটা সৌমেন বাবু দেখলেন আর বিস্মিত হলেন!

হঠাৎ, দেয়াল ঘড়িটা দায়িত্ব নিয়ে দম করে বেজে ওঠে
সৌমেন বাবুকে তার ঘুমানোর সময়টা জানান দিলো!
নাহ! আজ আর কিছু লিখতে মন চাইছে না তার!
তাই ঠাকুর দেবতাকে আরেক দফা প্রণাম করে তার নিত্য সঙ্গী চশমাটা রেখে
তার প্রবল সাদামাটা অথচ শুদ্ধ বাঙালীয়ানা ধাঁচটা মননে নিয়ে
দখিনা বাতাসে গা এলিয়ে শুয়ে পড়লেন!
খুব দ্রুতই তাঁর চুয়ান্ন বছরের নিত্যদিনের কর্মক্লান্ত শরীরটা ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করলো!
অত:পর তার গিন্নি কখন কর্তার পা ছুয়ে প্রণাম করে
তার পাশে এসে শুয়ে পড়লেন তা তিনি টেরও পেলেন না!

উৎসর্গ : অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য