উনুনের পাশে বসে চোখ মুছে যাচ্ছে মমতাময়ী মা
ঘেমে গেছে তার সরু ললাট,
সংসারের ঘানি টানা শির্ণ দেহখানী!
সংসারের যাবতীয় কাজ করে ক'জনের জন্য
রান্না করতে গিয়ে তাকে ক্লান্ত হলে চলে না!
আজ কতদিন খোকা বাড়ি আসে না!
সেই পৌষের শেষে এক অবেলায় চিঠি দিয়ে গেল পোস্ট মাস্টার সাহেব!
পাশের বাড়ির নছিমনের স্কুল পড়ুয়া নাতিকে দিয়ে
চিঠি পড়িয়ে নিল অস্থির মা!
ছেলে আসবে তার মাঘের শেষে!
চিঠিতে তার সে কত বায়না!
নানান রকম পিঠা খাবে!
পিঠা পেলে তার আর কিছু খেতে লাগে না!
মা পিঠা বানিয়ে রেখছে একটু একটু করে!
অথচ আজ ফাল্গুনের কেটে গেল কতগুলো দিন!
কিন্তু খোকা আসছে না!
তার কোন চিঠিও মাস্টার সাহেব আর আনছে না!
সকাল থেকে মনটা খচখচ করছে খোকার মায়ের!
কি যেনো এক দুর্বার দুর্ঘটনার আশানি ইঙ্গীত
মনে আচড় কেটে চলেছে থেকে থেকে!
সেদিন কমলার মা বলছিল বাংলায় নাকি আর কথা বলা যাবে না!
ওমা! এ কেমন কথা?
বাংলা তো মায়ের বুলি! জীবনভর বলে আসছে সকলে!
এখন কেন পারবে না? আইন করে নাকি বন্ধ করে দিবে!
এ নিয়ে ছাত্ররা নাকি খুব বিরোধ করছে!
তারা মানবে না, মায়ের ভাষার জন্য তারা আন্দোলন করবে!
সবাই একজোট হয়ে মিটিং মিছিল করবে!
ওসব কি হয় গ্রামের সহজ সরল মা বোঝে না!
আচ্ছা! খোকাও কি ওদের সাথে যোগ দিয়েছে?
নইলে আসছে না কেন তার আদরের খোকা?
প্রতিবার সে আসে ভাঙ্গা চেহারা আর দুর্বল গা নিয়ে!
তাজা শাক সবজি, পুকুরের মাছ, ডিম দুধ খাইয়ে
শরীর ঠিক করিয়ে তবে মা খোকাকে যেতে দেয়!
এবারও তার খোকা মলিন মুখে ফিরে আসবে
না! এবার আচ্ছামতো তাকে বকে দিবে!
কান মলে দেবে আর চুল টেনে কষে দুটো থাপ্পর দিবে!
কিন্তু খোকারই বা কি দোষ!
একদিন দুপুরে ক্ষুধার্ত খোকা গোগ্রাসে খাচ্ছে দেখে
মমতাজড়ানো কণ্ঠে মা জিজ্ঞেস করে
"কিরে খোকা? অমন করে খাচ্ছিস কেন রে?"
খোকা তখন বলেছিল "ওখানে অত ভালো খেতে পারি না মা!
কোথায় তোমার হাতের আদর মাখানো রান্না আর কোথায়..."
মা তখন মুখ ঘুরিয়ে আঁচলে চোখের পানি ফেলেছিলো!
না এবার সে যেতে দিবেনা তার সোনার টুকরো মানিককে!
কিন্তু খোকার বাবা দরদ দেখিয়ে ছেলের ভবিষ্যত খারাপ না করতে মাকে শাসিয়ে দেয়!
স্নেহের আঁচল ছেড়ে খোকা আবারও শহরে পড়তে চলে যায়!
মা কয়দিন মনমরা হয়ে পড়ে থাকে জীর্ণ কুটিরে!
এবার খোকা এলে খোকাকে জিজ্ঞেস করবে
আর কতদিন তাকে থাকতে হবে মায়ের আদর থেকে দূরে।
আর তো তাকে ছাড়া থাকতে পারে না মা!
উনুনের যোগান ফুরিয়ে যায়
আগুনের তেজ শেষ হয়ে যায়!
খোকার জীবনের প্রদীপও নিভে যায়!
একদল মূর্খ, স্বার্থান্বেষী অমানুষের
নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের বলি হয় খোকা!
দুরন্ত খোকা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে
নিথর হয়ে পড়ে থাকে বাংলা মায়ের বুকে!
অবশেষে মায়ের খোকা বাড়ি আসে!
কিন্তু আসে কয়েকজনের কাধে চেপে!
না! এবার আর সে আর মলিন মুখে, ভাঙ্গা শরীর নিয়ে আসেনি
সে এসেছে নিশ্চুপ মুখে, রক্তমাখা শরীরে!
বিবেকহীন হায়েনাদের অবোধ বুলেট ছিদ্র করে দিয়েছে
সোনার ছেলে হৃদপিন্ড আর ললাট!
যে ললাটে শৈশব থেকে স্নেহময়ী মা চুমু খেতো!
খোকার চেহারায় যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট!
শেষ নিঃশ্বাসেও সে দেখতে চেয়েছিল প্রিয় মায়ের মুখখানি!
মায়ের কোলে মাথা রেখে বলতে চেয়েছিল
"মাগো! আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে মা!।
আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে চাইনা মা!
আমাকে ধরো মা! আমাকে জড়িয়ে রাখো!"
স্তম্ভিত পিতা উঠানে বসে হিসেব মিলাতে থাকে
খোকাকে বড় মানুষ করতে শহরে পাঠানো কি ভুলটাই না তার ছিলো!
খোকার মায়ের দিকে সে তাকাবার সাহস পায় না!
দুর্বার অপরাধবোধ আড়ষ্ট করে মাথাটা তার ঝুকিয়ে দেয়!
পিঠা, খেজুরের রস, বাসি হয়ে যায়!
যত্নে ভালোবাসায় পাকানো খাবারে বিড়াল মুখ দেয়!
খোকার মায়ের বিলাপ থামে না!
ফাল্গুনের ঝিরিঝিরি বাতাস হঠাৎ করে ভারী হয়ে যায় পুত্র হারানো শোকের আবহে!
গ্রামের প্রতিটি ঘরে খোকার মায়ের বুকফাটা দুঃসহ আর্তনাদ পৌছে যায়!
কিস্তু পৌছায় না বিবেকবর্জিত বেজন্মা দুঃ শাসকদের কানে !
সিফাত আহমেদ
২১/০২/২০২০
নারায়ণগঞ্জ