ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলাসাহিত্যে সত্তাদীপি কণ্ঠ নিয়ে জাগ্রত হয়েছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্র। তিনি বাংলাসাহিত্যের অনন্য ব্যক্তিত্ব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখেও পরম শ্রদ্ধার মানুষ ছিলেন; রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রজ্ঞাবান জীবনে, উক্ত সাহিত্যিককে লক্ষ্য করে অনেক লেখাও লিখেছিলেন। জীবনবাদের এই অমর সাহিত্যিক শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের পরিচয় স্পষ্ট করতে ছোট একটি ঘটনা সংযোজন করছি।
শ্রীশ্রীঠাকুরের বয়স তখন মাত্র বাইশ বছর। তিনি একবার অতুলচন্দ্র ভট্টাচার্যের বিনম্র অনুরোধে এক রাতে লিখেছিলেন 'সত্যানুসরণ' নামক একটি জীবনবাদী গ্রন্থ, যা সারাবিশ্বে ত্রিশটিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
একবার স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত পদার্থবিজ্ঞানী কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য (বিজ্ঞানী সি ভি রমণের সহকারী সাইনটিস্ট) এই সত্যানুসরণ বইটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাতে যান। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পড়তে দেওয়া হলো 'সত্যানুসরণ'; রবীন্দ্রনাথ বইটি পাওয়ামাত্রই পড়তে শুরু করেন। দার্শনিকদৃষ্টির অতলে হারিয়ে যেতে শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভাবের গভীরে থেকেই প্রশ্ন তুললেন, "এই বইয়ের লেখক কে, বয়সটা কত?
বিজ্ঞানী কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য ক্রমাগত উত্তর করলেন, " এঁর নাম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্র, তাঁর বয়স বাইশ বছর। "
পড়ার মাঝেই হারিয়ে যাচ্ছিলেন আরোতর ; হঠাৎ আবার সেই একই প্রশ্নের পুনরাবির্ভাব, " কী নামটা বললে যেন! বয়সটা কত বললে?
বিজ্ঞানী কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য আগের বলা উত্তরটিই আবার বলে চলছেন, "এঁর নাম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্র, বয়স হবে বাইশ"।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পড়ার মাঝে যেন আরও ডুবে গেলেন, আবার, হঠাৎ সেই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি, কী নাম বললে, বয়সটা কত যেন?
বিজ্ঞানী উত্তর দিলেন আবার- এঁর নাম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্র, বয়স তাঁর বাইশ বছর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবার বইয়ের থেকে চোখ ওপরে তুললেন; বললেন, কে বলল এঁর বয়স বাইশ বছর! এঁর বয়স বাইশ হাজার বছরেরও বেশি। আর এ গ্রন্থ সকল সাহিত্য ও দর্শনের গুরু, কী নেই এতে!
সেই গুণময় মানুষটির জন্ম ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসের ১৪ তারিখে অবিভক্ত ভারতের অধুনা পাবনা জেলার হিমায়েতপুর গ্রামে। জন্ম থেকে তাঁর প্রজ্ঞার প্রকাশ! স্কুলে পড়াকালীন সময়েই তাঁর শ্রেণিশিক্ষক শ্রদ্ধার কণ্ঠে ডাকেন 'শ্রীশ্রীঠাকুর' উপাধিতে। সেই থেকে তাঁর নামের শুরুতে বলা হয়ে থাকে শ্রীশ্রীঠাকুর। তিনি তাঁর অভিনবত্বের মহান বিজয়সহ বাংলাসাহিত্যকে ভরে দিয়েছেন অস্তিত্বের ছন্দবাক্য দিয়ে। তাঁর সেই বিবেকপ্রসূ ছাড়াসাহিত্য আজ গবেষণার এক বিস্তৃর্ণ বিষয়।
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের শতাধিক গ্রন্থের মধ্যে অন্যতম মহাগ্রন্থ 'অনুশ্রুতি'; যা এক পরমসাত্ত্বিক ছড়াগ্রন্থ। এটি সাতটি খন্ডে বিভক্ত। এত বড় সৃষ্টি তাঁর, তা যেন আজকের যুগে মানুষের বেঁচে থাকার এক সুন্দরতম আশ্রয়।
শ্রীশ্রীঠাকুরের সাহিত্যে যেন জীবনের জ্যামিতিক সমাধান লুকান রয়েছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার তিনি মহাদ্যোতক! তিনি লিখেছেন,
"অন্যে বাঁচায় নিজে থাকে
ধর্ম্মে ব’লে জানিস্ তা’কে । "
তিনি তাঁর এই দ্বিপদ-স্বরবৃত্তে সমগ্র জীবনবৃত্তই যেন নতুন করে আঁকলেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন মানুষের ধর্ম হবে : অন্যের বেঁচে থাকাকে কেন্দ্র করে। সত্যি বলতে, আমাদের সবার ধর্মের মূলকথা যদি অন্যকে বাঁচিয়ে রাখার আদর্শ নিয়েই চলে পৃথিবীর মানুষ কত না নান্দনিক জীবনে বিচরণ করার সুযোগ পেত! শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের ছড়াসাহিত্য এজন্য প্রোজ্জ্বল, তাঁর সাহিত্য যেন মানুষের মাথা থেকে সাম্প্রদায়িক চেতনা নিঃশেষে দূর করে দেয়। শ্রীশ্রীঠাকুর 'অনুশ্রুতি'তে বললেন-
"ধর্ম্মে সবাই বাঁচে-বাড়ে
সম্প্রদায়টা ধর্ম্ম না রে।"
তিনি এই ছড়াবাণীটির মাধ্যমে মানুষকে জানালেন ধর্মের অন্তর্নিহিত অর্থ- বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠারই সাদুপথ। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-জৈন-বৌদ্ধ এগুলো ধর্ম নয়, এগুলো সম্প্রদায়মাত্র। ধর্ম মানে নিজ ও অপরের জীবন-বর্ধনা। তিনি সেই এক ও অদ্বিতীয় সূত্রকেই ধর্মের নামকরণে দেখতে চান। যেখনে নেই কোনও সহিংসতা, নেই কোনও সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতি। তাই ধর্ম মানে জীবনের বেঁচে থাকার বিজ্ঞান। তাই ধর্ম একই। শ্রীশ্রীঠাকুরের এপ্রসঙ্গে লেখা আছে,
"ধর্ম্মে জীবন দীপ্ত রয়
ধর্ম্ম জানিস্ একই হয়।"
ধর্ম মানুষের জীবনকে কেন অন্ধকার দেখাবে, মৃত্যুভয় বাড়াবে, ধর্ম তো জীবনকে দীপ্তিময় করবে।পানি যেমন বৃষ্টির হোক, নদীর হোক, কুয়োর হোক সবই একরকম হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের সৃষ্ট যৌগ। রাসায়নিক গুণের বিচারে একই। শ্রীশ্রীঠাকুরের দৃষ্টিতে সকল প্রেরিত পুরুষই অভিন্ন। তাই তিনি কবিতায় আঁকলেন অভিন্নতার প্রকৃতি,
কৃষ্ণ-রসুল বিভেদ করে
বুদ্ধ-ঈশায় প্রভেদ গণিস,
আরে ওরে ধর্ম্মকসাই
কুটিল দোজখ মনেই রাখিস্;
এক বাপেরই পাঁচটি ছেলে
দেখলি না তুই চোখটি মেলে,
কাউকে বাপের করলি স্বীকার
কাউকে বললি নয়,
কা’রে রে তুই দিলি ধিক্কার
গাইলি কাহার জয় ?"
একথা অকাট্য সত্য যে, মানসিক বিভেদ-ই বাস্তবিক জীবনকে চরমভাবে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যায়।
শ্রীশ্রীঠাকুরের এ সাহিত্যধারা মানুষের অস্তিত্বকে বিষময় পরিণতি থেকে ফিরিয়ে আনবে, এতে কোনও সন্দেহ নেই।
"প্রেরিতে বিভেদ নাই যাহাদের
রসুল ব’লে মানে,
উপকারীর স্বতঃই গোলাম
মরেও যদি প্রাণে,
শান্তিবাদী শান্তি-সন্ত্রী
দীপ্ত-পূরণপ্রীতি,
সন্ধ্যা পাঁচে উপবাসে
গায় ঈশত্বের গীতি;
সব প্রেরিতের পূরণ-মতের
সেবক-সাধক প্রাণ,
পূর্ব্বপুরুষ সূত্র-ছেঁড়া
নয়কো ইতর টান;
একেশ্বরে হৃদয় ঢালা
তা’রাই মুসলমান;
এমনতর রেশও যেথায়
নয়কো বিদ্যমান,
রসুল-প্রেমের মুখোসপরা
শঠকপটী প্রাণ।"
শ্রীশ্রীঠাকুরের এই ছড়াটিতে ইসলাম যে শান্তির ধর্ম তা প্রকাশিত হয়েছে ঠিক, তবে, শান্তির ধারাটিও যেন তিন ছন্দেই গেঁথেছেন। তিনি তাঁর সত্যময় উপলব্ধি নিয়ে যে কথাগুলো বলে গেছেন, তা আজ অসাম্প্রদায়িক চেতনা আলোকবীজ। তাঁর এই আদর্শিক চেতনায় আজকের এই যুগের সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প দূরে যাক্। ভাসুক জগৎ প্রেমের সৌরভে!
▪শ্যামলকুমার সরকার : কবি ও প্রাবন্ধিক।
ইমেইল- writershyamalsarker@gmail.com