গ্রামের নৈসর্গিক প্রকৃতি মানুষের মনকে কোমল ও উদার করে। নাগরিক জীবনের চুল-ছেঁড়া হিসাব নিকাশ, রূঢ় বাস্তবতার জীবন নির্বাহের বাধ্যবাধকতা এখানে ছিলনা। ছিলনা লুকোচুরি, আন্তরিকতার বিভ্রাট, নিষ্ঠুরতা, ছিলনা স্বার্থপরতা। কারো ন্যায্য অধিকার হরণ করে নিজের সমৃদ্ধির হীন মানসিকতাও ছিলনা গ্রামবাংলায়। স্বাধীনতার উত্তরকালে কালোবাজারি, মজুদদারি, দুর্নীতি, অনৈতিক কাজ, রাজনৈতিক সংঘাত প্রভৃতি নগরে তীব্রতর হলেও গ্রামে এর ছোঁয়া তখনও লাগেনি। নগরের এক শ্রেণীর মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটলেও গ্রামীণ মানুষ এসব নেতিবাচক বিষয়ের কুফল ভোগ করেছে ঈশ্বরের অভিশাপ বিশ্বাসে। তবে স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ের বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছে এবং কোন কার্পণ্য ও হিসাবনিকাশ ছাড়া জীবন বাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে লড়েছিল গ্রামের মানুষ বীরদর্পে। এই দুঃসময়ে পাকসেনাদের ভয়ে পালিয়ে আসা শহরের মানুষদের আশ্রয় দিয়েছিলো নিজের সুখসাচ্ছন্দ্য পরিহার করে। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা লাভের সহজ পরিবেশে অবস্থিত শহর নগরগুলো কোন কালজয়ী তুখোড় রাজনৈতিক নেতৃত্বের, বুদ্ধিজীবীর, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যের ধারক ও বাহকদের জন্ম দিতে পারেনি। মফস্বলের তরুণেরা এসব প্রতিষ্ঠানে জীবনসংগ্রামের মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করে এদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমৃদ্ধির বরমাল্য পরিয়েছে।
গ্রামের সাধারণ মানুষ কোন বাকবিতণ্ডা ও দ্বন্দ্বে না জড়িয়ে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে ভোট দিয়েছে। তবে জাতীয় নির্বাচনে মাঝে মধ্যে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের দ্বারা ভোটের বাক্স চিনতাই, স্থানীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা প্রদান এবং অন্যান্য অনৈতিক কর্মকাণ্ড তারা দেখেছে।
কিন্তু গ্রামের মানুষের মধ্যে দলগতভাবে মতপার্থক্যের জন্য দাঙ্গা ও খুনাখুনির মতো ঘটনা খুবই সামান্যই হয়েছে। তারা গ্রামের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে শিশুর মতো বিরোধ ভুলে আবার হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছে গ্রামীণ জনপদে। বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে স্কুলজীবন থেকে এবং তৃণমূল পর্যায় থেকে উঠে আসা নিবেদিতপ্রাণ কেউ নেই। সাধারণ মানুষের দুঃখে ও সন্তাপে পাশে থাকা ঔদার্য লালনকারী মানুষেরা উপেক্ষিত হচ্ছে নেতৃত্বে। বিপন্ন মানুষের সৃষ্ট লোনা অশ্রুপাতের উপ্তাপ হৃদয়ে স্পর্শ করা মানুষ হতে সৃষ্টি হচ্ছে না নেতৃত্ব। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলছে ক্ষমতা দখলের জন্য অনৈতিক নির্লজ্জ নির্বাচনী টিকিট বিক্রির আলু-মাংস নীতির কালাকানুন। এই গর্হিত অনিয়মের নিয়মে নিশ্চুপ পালিত বুদ্ধিজীবীরা, বণিক প্রচার মাধ্যম, তথ্যপ্রযুক্তির কুফল সেবনকারী নির্জীব তারুণ্য। চলছে মাৎস্যন্যায়। মধ্যবয়সী শেয়ার চোর শেয়াল, ড্রাগ কারবারি, দুর্নীতিবাজ আমলা, মজুদদার, সন্ত্রাসের গডফাদার, চোরাকারবারিরা আর্থিক ও পেশী শক্তির দাপটে আমজনতার মমতায় নির্বাচিত প্রতিনিধির আসন চিনতাই করছে। হাজার বছরের মুক্তির মন্দিরের সোপান তলে নিবেদিত প্রাণে অর্জিত স্বাধীনতার ফসল সম্ভার লুটছে বণিক আর নীতিভ্রষ্ট মানুষেরা। এইসব পঙ্গপাল সাংসদের আসন অলংকৃত করবে। গনবিরোধী আইন প্রণয়ন করবে। বণিকী স্বার্থ হাসিল করবে। প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে করায়ত্ত করবে। মানুষ হবে তাদের গোলাম। দেশের স্বাধীনতার, প্রগতির, চিন্তাচেতনার, উন্নয়নের এবং শিল্প সাহিত্যের পুরোধাদের সূতিকাগার গ্রামকেও তাদের গোলামির রাজত্বে পরিণত করার লক্ষ্যে দলীয় দ্বন্দ্বের বিষবৃক্ষের বীজ বপন করেছে গ্রামে। এই উপ্ত বীজ বিষফল ও বিষবৃক্ষ ছড়াবে অনন্তকাল। জাতীয় নির্বাচন থেকে তৃণমূল পর্যায়ের ক্ষুদ্র গ্রামে প্রসারিত হবে তাদের এই দ্বান্দ্বিক চরিত্রের বিষাক্ত নখরযুক্ত কালো হাত।
প্রতিবাদ করার কোথাও কেউ নেই। দেশপ্রেম ও দেশপ্রেমিকদের নিষ্ক্রিয় নির্জনতায় কবরস্থ করা হয়েছে। তরুণেরা মগ্ন আত্মকেন্দ্রীক মন্ত্রমুগ্ধ আপন বলয়ে। তাই অবাধে বিঁধবে ঘাতককাঁটা বাংলার চির বঞ্চিত মানুষের প্রাণের স্পন্দনে।
প্রগতির রথচক্র গতিময় করতে ফিরিয়ে নাও নৃশংস ঘাতককাঁটা।