এক ধর্মীয় মহাদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হইল, এক শিল্পপতির বিস্তৃত উঠান জুড়িয়া। শুনিয়াছি, ইদানীং শিল্পপতির সুপ্ত খায়েশ জাগিয়াছে রাজনীতি করিবেক। আমিও এই মহতি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হইলাম সখ্যতার খাতিরে নহে, তাহাকে ভবিষ্যতে সহায়তা না করিলেও, আবোল তাবোল যেন কিছুু না বলি বা না লিখি, তাহা ভাবিয়া বোধহয় আমন্ত্রণ জানাইয়াছেক।
পূর্বেকার সময়ে ছাত্রাবস্থায় দেশের মানুষের দুঃখ দুর্দশার বিষয় ভাবিয়া অন্যায় অবিচার রুখিবার দৃঢ় প্রত্যয় লইয়া তরুণ বয়স হইতে মেধাবী, সাহসী ও তুখোর বক্তা এবং ক্ষুরধার লেখায় পাকা ছাত্রদের রাজনৈতিক অধ্যায় শুরু হইত। এখন রাজনীতি মধ্যবয়সী বণিক, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, চোরাকারবারি, মজুদদার, ড্রাগ ব্যবসায়ীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হইয়াছে।
অগণিত সংখ্যক পুরোহিতগণ সারিবদ্ধভাবে সুরম্য আসনে উপবেশন করিলেক। প্রথমে দানকর্ম সংগঠিত হইল। পুরোহিতবৃন্দের সম্মুখে উনাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীসহ সংবৎসরকালের পরিধেয় বস্ত্র ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী স্থাপন করা হইল। অনুমিত হইল, পুরোহিতগণ এবং সাধারণ মানুষ্যগণের মধ্যকার স্থানে স্বর্গের কল্পতরুর শাখায় শাখায় ফলস্বরূপ নানাবিধ কল্পিত, ঈপ্সিত দ্রব্যরাজি ঝুলিতেছে এবং এই নান্দনিক কল্পিত বৃক্ষরাজিতে পরিপূর্ণ দীর্ঘ সুরম্য পর্বতশ্রেণী রচিত হইয়াছে। গুরুগম্ভীর পুরোহিতগণ অত্যধিক সামগ্রী প্রপ্তি নিশ্চিত হইয়াও বিচলিতভাব প্রদর্শন না করিয়া ভরাট ও দর্পিত কণ্ঠে বলিতে লাগিলেক, এই দানবীর পূর্বজন্মে পুণ্যবান, নীতিবান এইরূপ যোগ্য এবং সুপাত্র পুরোহিতগণদের দান করিয়াছেক বিধায় তিনি বর্তমান জন্মে অঢেল সম্পত্তির অধিকারী হইয়াছেক। পুরোহিতগণ দৃঢ়কণ্ঠে দানের অসীম ও অত্যাশ্চর্য গুণ বর্ণনা করিয়া চলিলেক। কোন নারী যদি শ্রদ্ধাচিত্তে অঢেল ধনসম্পদ এইরূপ সুপাত্রে দান করে, তাহারা অবশ্যই আগামী জন্মে পুরুষ হইবেক। এই বক্তব্য শ্রবণ করিয়া কতিপয় পুরুষ অতিথি শঙ্কিত হইয়া উঠিল মনে হইয়াছে। তাহারা অস্ফুট স্বরে বলাবলি করিলেক, যদি এইভাবে সব নারী স্বামীদেবের ঘর্মাক্ত দেহে উপার্জিত অর্থের বারোটা বাজাইয়া সমুদয় অর্থ পুরোহিতগণের চরণ সমীপে জলাঞ্জলি দেয়, তাহা হইলে অচিরেই এই পৃথিবী পুরুষ শূণ্য হইয়া মহা মানবিক সংকট সৃজিত হইবেক। তাহাহইলে পুরুষদেরকে বৈজ্ঞানিক পন্থায় প্রজনন অঙ্গ সৃজন করিয়া সন্তান প্রসব করিতে হইবেক, রান্নাবান্নাসহ যাবতীয় গৃহস্থালি কর্ম পুরুষদের সম্পন্ন করিতে হইবেক।
পুরোহিতবৃন্দ বক্তব্যে দানবীরের এই অভাবনীয় ও অভূতপূর্ব দানের ফলশ্রুতিতে বর্তমান জন্মে এবং ভবিষ্যৎ জন্মের কোটি কল্প কালের দিনগুলি কী অভানয়ীয় মসৃণ এবং সুখময় হইবেক তাহা ভাষিত হইল। এই মহা দানবীরের দানবীরত্বের মহিমা আমরা নাখান্দা আমজনতা যাহাতে অনুধাবন করিতে সচেষ্ট হইয়া আমাদের কৃপণ মনে দানচিত্ত জাগরিত করিয়া বিশ্বকে দানের একছত্র সাম্রাজ্যে পরিণত করিয়া সবাই কল্প কল্প কাল যাবৎ সুখশান্তি ভোগ করিতে থাকি তাহার লাগিয়া পুরোহিতগণ বারংবার দৃঢ় কণ্ঠে বয়ান করিলেক।
পুরোহিতগণের উচ্ছ্বসিত, প্রশংসিত বক্তব্যে আমন্ত্রিত অতিথিবর্গ নিজেদেরকে কৃপণ, স্বার্থপর, হীনজীব ভাবিয়া মনে মনে নিজেদেরকে ধিক্কার প্রদান করিয়া, বাকরুদ্ধ হইয়া জলজ মৎস্যের বিষফল ভক্ষণ করিবার ফলস্বরূপ হা করিয়া যেইরূপ অর্ধমৃত হইয়া পানিতে ভাসমান অবস্থায় চিৎ হইয়া থাকে, সেইরূপ উপস্থিত অতিথিবৃন্ধের সিংহভাগ মধুর ধর্মসুধা পান করিয়া কিংকর্তব্য বিমূঢ় হইয়া পড়িলেক।
বাঙালীর সহজাত পরশ্রীকাতরতা প্রবৃত্তি ধারণ করতঃ কিছু বাঁকা মনের অতিথি কানাঘুষা করিতে লাগিলেক। উনারা ফিসফাস করিয়া বলিতে লাগিলেক, এই মহাশ্রেষ্ঠ দানে গলদ বিরাজমান। আজিকার এই মহা দানবীর নাকি বাংলাদেশের শেয়ার ব্যবসা লইয়া শেয়ালবাজি কাণ্ডের সময়কালে অন্যতম মহা খলনায়কও বটে। সেই সময়কালে শিল্পপতিগণ স্টক এক্সচেঞ্জ এর ধূর্ত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহিত গোপন সলাপরামর্শ করিয়া জনগণের পকেট কাটিবার নিমিত্তে ফন্দি আঁটিয়া তাহাদের কোম্পানীর শেয়ার নাই নাই রব তুলিয়া ১০০ টাকার শেয়ারের মূল্য পাঁচ হাজার হইতে সাত হাজার টাকায় মূল্য উত্তোলন করিয়া তাহাদের সকল অচল শেয়ার অকল্পনীয় উচ্চমূল্যে বিক্রয় করিয়া জনগণের সর্বস্ব হরণ করিয়াছেক। ইহার ফলশ্রুতিতে কত মানুষ সর্বস্ব হারাইয়া আত্মহত্যা করিয়াছেক, কত মানুষ শোকে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া স্তব্ধ হইয়া পটল তুলিয়াছেক, কতশত মানুষ পাগল হইয়া রাস্তায় নগ্ন হইয়া বিরবির করিয়া দিন নিপাত করিয়াছেক, কত মানুষের সংসার ভঙ্গুর কাঁচের মতোন শতছিন্ন হইয়া ঝরঝরে হইয়া পৃথিবীর জনারণ্যে বিলীন হইয়াছে, কত শিশু আর তরুণ তরুণীর অধ্যায়ন অকালে পরিসমাপ্তি ঘটাইতে হইয়াছে ---- তাহার ইয়ত্তা নাহি।
এই শেয়ালেমি পন্থায় শেয়ার বিক্রয় করিয়া রাতারাতি আঙুল ফুলিয়া কলাগাছ বনিয়া যাওয়া দেশদ্রোহীরূপ স্বার্থপর, ঘৃণিত এইরূপ নরকের কীটদিগকে মহা দানবীর রূপে কতিপয় জ্ঞানপাপী কর্তৃক বিশেষিত করিয়া, প্রতিষ্ঠিত করিয়া, রাজনৈতিক দলের টিকেট কারবারিদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করিয়া জঘন্য অমানবিক কর্ম করিতেছেক। এই বলিয়া বলিয়া ঐসব বাঁকাচোখা মানুষগুলি গোখরোর লাহান ফোঁসফাঁস করিলেক। তাহারা ক্ষোভে চাপাকণ্ঠে বলিয়া চলিলেক, অন্তঃসারশূন্য উচ্চবিলাসী ফিটফাট পরিচ্ছদ সর্বস্ব এবং বাকপটু কতিপয় ধান্ধাবাজ মানুষের দ্বারা চালিত এই সমাজ চলিতেছে উন্মাদ কুকুরের মতো অর্থের পিছনে পিছনে ধাবমান হইয়া, তোষামোদি করিয়া, মিথ্যাকে সত্য বলিয়া প্রতিষ্ঠিত করিয়া, সত্যকে টুঁটি চাপাইয়া দিয়া কবরস্থ করিয়া নির্বিঘ্নে সমগ্র সমাজের কর্তৃত্ব করায়ত্ত করিয়া নিয়াছেক ঐসব ধান্ধাবাজ কাউয়াগুলি।
পাশ্ববর্তী অতিথিবৃন্দ পুরোহিতবৃন্দের বয়ান ছাড়াও বাঁকাচোখা মনুষ্যদের এই বাঁকা কথাও শুনিয়া বিশ্বাস করিল বলিয়া মনে হইল। আমার অনুমিত হইল, সাধারণ মানুষ সকল পক্ষের কথা নিয়মিত শুনিতেছে। তাহারা নির্জীব জড় নহে, বোবাকালাও নহে, অজ্ঞানীও নহে। কিন্তু বাংলাদেশের অজ্ঞানী ভুঁইফোড় এইরূপ দানবীয় দানবীর রাজনৈতিক নেতারা, আমলারা এবং উহাদের ক্রয়কৃত চামচবৃন্দরা জনগণকে তাদের পৈতৃক ছাপোষা মূর্খ চাকর জ্ঞান করিয়া থাকে। যদি আমজনতা সন্ত্রাসমুক্ত ও বাধাহীন পরিবেশে গোপনে ভোট প্রক্ষেপণের সুযোগ পায় তাহাহইলে তাহারা তখনই এইসব গজাইয়া উঠা অজ্ঞানী, স্বার্থপর নেতা কর্তৃক সৃজিত মানুষের শুভ্র দুধেল অধিকার খেকো গণেশ উল্টাইয়া কৃষ্ণকায় পয়ঃ নর্দমায় নিক্ষেপ করিবেক। এই আমজনতাকে অতিব গোবেচারি বোধ হইলেও তাহারা একদা ভয়ংকর রূপ পরিগ্রহ করিয়া বৃটিশ আর পাকিস্তানিদের দশা ঘটাইতে দ্বিধা করিবেকনা।