চর্যাপদ কি মোটামুটি আমরা সকলেই জানি ।বাংলা ভাষার প্রাচীনতম বা আদি কাব্য সাহিত্য নিদর্শনই হল চর্যাপদ বা চর্যাচর্যাবিনিশ্চয় ।তবে এটি সংক্ষেপে বৌদ্ধগান ও দোহা বা চর্যাপদ নামেই পরিচিত। নব্য ভারতীয় আর্যভাষারও প্রাচীনতম রচনা এটি। খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী মতান্তরে খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত এই গীতিপদাবলি রচয়িতা ছিলেন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যাগণ । চর্যাপদ রচনার পৃষ্টপোষক ছিল পাল রাজারা । ১৯০৭ সালে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে এর পুঁথি আবিষ্কার করেন।হরপ্রসাদ শাস্ত্রী শাস্ত্রী মোট ৪৬ টি পূর্ণাঙ্গ ও একটি খণ্ডিত পদ পেয়েছিলেন ।পুঁথিটির মধ্যে কয়েকটি পাতা ছেঁড়া ছিল । মূল পঁথির পদের সংখ্যা ছিল ৫১ টি আর কবির সংখ্যা ছিল ২৪ জন । কিন্তু পদের সংখ্যা ও কবির সংখ্যা নিয়ে কিছুটা মত বিরোধ রয়েছে , ডঃ মুহাম্মাদ শহীদিল্লাহর মতে চর্যাপদের সংখ্যা ছিল ৫০ টি এবং কবির সংখ্যা ২৩ জন , অন্য দিকে ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মতে চর্যাপদের সংখ্যা ছিল ৫১ এবং কবি ছিল ২৪ জন ।
চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর এর বিষয়, ভাষা ও কাল সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা হয় । আগেই আলোচনা করা হয়েছে চর্যাপদের রচনার সময় কাল খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী মতান্তরে খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে । চর্যাকাররা সহজযান ধর্মেমতে দীক্ষিত ও সিদ্ধাচার্য নামে পরিচিত ছিলেন । তান্ত্রিক যোগসাধনা ছিল তাঁদের ধর্মমতের বৈশিষ্ট্য। চর্যাপদে এ সাধনার কথা হেঁইয়ালিপূর্ণ ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে । ফলে দেশজ ভাষায় রচিত হলেও চর্যাপদের মূল ভাব বোঝা খুবই দুরূহ ব্যাপার। এ কারণে পন্ডিতগন এ ভাষাকে আলো- আঁধারি বা সন্ধ্যা ভাষা নামে অভিহিত করেন ।
চর্যাপদের ভাষা কিন্তু অবিমিশ্র বাংলা নয়, কারণ চর্যার কবিগণ ছিলেন বিভিন্ন অঞ্চলের । বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমা তখন নানাদিকে প্রসারিত ছিল। সেজন্য উড়িষ্যা, আসাম এমনকি বিহারের ভাষাদর্শও চর্যাপদে লক্ষ্য করা যায়। ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায় বাংলা, অসমিয়া ও উড়িয়া ভাষা পূর্ব ভারতের একই মূল কথ্য ভাষা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। তাই বাঙালি, অসমিয়া ও উড়িষ্যাবাসী প্রত্যেকেই চর্যাপদের দাবিদার। তবে ‘বঙ্গাল দেশ’, ‘পঁউয়া খাল’ (পদ্মানদী), ‘বঙ্গালী ভইলি’ ইত্যাদির উল্লেখ থাকায় বাঙালির দাবি অগ্রগণ্যরূপে বিবেচিত হয়।
বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য গণ চর্যাপদ রচনা করেছিলেন । সাধারণত বজ্রযানী ও সহজযানী আচার্যগণই সিদ্ধাচার্য নামে অভিহিত হতেন। তিব্বতি ও ভারতীয় কিংবদন্তীতে এঁরাই 'চৌরাশি সিদ্ধা' নামে পরিচিত। তবে এই ৮৪ জন সিদ্ধাচার্য আসলে কারা ছিলেন তা সঠিক জানা যায় না।
আবিষ্কৃত পুঁথিটিতে ৫১টি চর্যায় মোট ২৪ জন সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায়। এঁরা হলেন: লুই, কুক্কুরী,বিরুআ, গুণ্ডরী,চাটিল, ভুসুকু, কাহ্ন, কাম্বলাম্বর, ডোম্বী, শান্তি, মহিত্তা, বীণা, সরহ, শবর, আজদেব,ঢেণ্ঢণ, দারিক, ভাদে, তাড়ক, কঙ্কণ, জঅনন্দি, ধাম, তান্তী পা, লাড়ীডোম্বী। এঁদের মধ্যে লাড়ীডোম্বীর পদটি পাওয়া যায়নি। ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক পদগুলি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুঁথিতে না থাকলেও ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচী আবিষ্কৃত তিব্বতি অনুবাদে এগুলির রচয়িতার নাম উল্লিখিত হয়েছে যথাক্রমে কাহ্ন, তান্তী পা ও কুক্কুরী। এই নামগুলির অধিকাংশই তাঁদের ছদ্মনাম এবং ভনিতার শেষে তাঁরা নামের সঙ্গে 'পা' (<পদ) শব্দটি সম্ভ্রমবাচক অর্থে ব্যবহার করতেন।
সাধারণভাবে লুইপাদকেই আদি সিদ্ধাচার্য মনে করা হয়। তাঞ্জর বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ছিলেন বাঙালি। তিনি মগধের বাসিন্দা ছিলেন ও রাঢ় ও ময়ূরভঞ্জে আজও তাঁর নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। চর্যার টীকায় তাঁর অন্য নাম লূয়ীপাদ বা লূয়ীচরণ। ১ ও ২৯ সংখ্যক পদদুটি তাঁর রচিত।
চর্যার পুঁথিতে সর্বাধিক সংখ্যক পদের রচয়িতা কাহ্ন বা কাহ্নপাদ। তিনি কৃষ্ণাচার্য, কৃষ্ণপাদ ও কৃষ্ণবজ্র নামেও পরিচিত। পুঁথিতে তাঁর মোট ১১টি পদ (পদ- ৭, ৯, ১১, ১২, ১৮, ১৯, ২৪, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫) পাওয়া যায়। ইনি ওড়িশার এক ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন বলে জানা যায়। শৌরসেনী অপভ্রংশ ও মাগধী অপভ্রংশজাত বাংলায় তিনি পদ রচনা করতেন। ভুসুকুপাদ বাঙালি ছিলেন বলে অনেকের অনুমান। কেউ কেউ তাঁকে চর্যাগানের শান্তিপাদের সঙ্গে অভিন্ন মনে করেন। চর্যার পুঁথিতে তাঁর আটটি পদ (পদ- ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩, ৪৯) আছে। এছাড়া সরহপাদ চারটি (পদ- ২২, ৩২, ৩৮, ৩৯), কুক্কুরীপাদ তিনটি(পদ- ২, ২০, ৪৮) এবং শান্তিপাদ (পদ- ১৫ ও ২৬) ও শবরপাদ দুইটি পদ (পদ- ২৮ ও ৫০) রচনা করেন। একটি করে পদ রচনা করেন বিরুআ (পদ ৩), গুণ্ডরী (পদ ৪), চাটিল (পদ ৫), কম্বলাম্বরপাদ (পদ ৮), ডোম্বীপাদ (পদ ১৪), মহিণ্ডা (পদ ১৬), বীণাপাদ (পদ ১৭), আজদেব (পদ ৩১), ঢেণ্ঢণ (পদ ৩৩), দারিক (পদ ৩৪), ভদ্রপাদ (পদ ৩৫), তাড়ক (পদ ৩৭), কঙ্কণ (পদ ৪৪), জঅনন্দি (পদ ৪৬), ধাম (পদ ৪৭) ও তান্তী পা (পদ ২৫, মূল বিলুপ্ত)। নাড়ীডোম্বীপাদের পদটি পাওয়া যায় না।
চর্যাপদে তত্ত্বের কথা থাকলেও এর সাহিত্যমূল্যও স্বীকৃত। কবিরা যুক্তিবাদী ও মননধর্মী হয়েও উপমা-রূপকের ব্যবহারে দক্ষ ছিলেন। তাঁদের রচনাশৈলী শিল্পসৌকর্যের অভিমুখী। তাঁদের বাকরীতি সংক্ষিপ্ত, অথচ নিগূঢ় অর্থবাহী। কোনো কোনো পদের এ অর্থগূঢ় বাক্যে সাধনমার্গে পৌঁছাবার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, যেমন ডোম্বীপার ১৪নং পদ: ‘বাহতু ডোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা। সদ্গুরু পাঅ পসাএ জাইব পুণু জিনউরা\’ অর্থাৎ, ডোমনি নদী পারাপার করছে, আর তারই মাধ্যমে সহজ সাধনার তীর্থধামে পৌঁছানোর আভাস সূচিত হচ্ছে।
চর্যাপদ শুধু প্রাচীন বাংলা সাহিত্যেরই নিদর্শন নয়, প্রাচীন বাংলা গানেরও নিদর্শন। প্রতিটি পদের শুরুতে রাগ-তাল ও প্রতি জোড়-পদে ‘ধ্রুব’ শব্দের উল্লেখ থাকায় নিশ্চিত প্রমাণিত হয় যে, এগুলি তখন গাওয়া হতো। চর্যাপদে মোট ১৭টি রাগ পাওয়ায়া গেছে, রাগ গুলো হচ্ছে, পটমঞ্জরী,মল্লারী,গুঞ্জরী,কামোদ,বরাড়ী,ভৈরবী,গবড়া,দেশাখ,রামক্রী,শবরী,অরু,ইন্দ্রতাল,দেবক্রী,
ধনসী,মালসী,মালসী-গবুড়া ও বঙ্গাল। এ ছাড়া পদগুলি থেকে তৎকালীন বাঙালি জীবনের আচার-আচরণ ও সমাজের বাস্তবঘন পরিচয়ও পাওয়া যায়। যেমন তখনকার মানুষ হরিণ শিকার, নৌকা চালনা, চেঙারি তৈরি, শুঁড়ির কাজ ইত্যাদি করত। কাড়া-নাকাড়া ও ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বর-কনেকে বিয়ের আসরে নিয়ে যাওয়া হতো। সমাজে যৌতুক প্রথা প্রচলিত ছিল। গরু ছিল গৃহপালিত পশু; হাতিরও উল্লেখ আছে। মেয়েরা পরিধানে ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জার মালা এবং কর্ণে কুন্ডল পরত। টাঙ্গি, কুঠার, নখলি বা খন্তা ছিল উল্লেখযোগ্য অস্ত্র। তবে সমকালীন সমাজের এসব চিত্র অঙ্কন করলেও চর্যাকারেরা প্রধানত ছিলেন বৈরাগ্যপন্থি, জগৎমুখী নন।
চর্যাপদ শুধু আমদের সাহিত্যের প্রচীনতম নিদর্শনই নয় এটি আমদের হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। হাজার বছরের বাংলার সামাজিক, সাংষ্কৃতিক, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক অবস্থার দর্পণ । এটি আমদের ইতিহাসের একট গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ ।
আশা করি উপরক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনায় কিছুটা হলেও চর্যাপদ কি ও কেন রচিত হয়েছিল এবং আর গুরুত্ব কি –এ ব্যাপারে কিছুটা হলেও ধারণা দিতে পেরেছি ।
তথ্য সূত্রঃ বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত, ডঃ মুহাম্মাদ শহীদিল্লাহ/
বাংলাপিডিয়া/ উইকিপিডিয়া/ বাংলাসাহিত্যার ইতিবৃত্ত/ দি অরিজিন এন্ড ডেভেলপম্যান্ট অব দ্য বেঙ্গলী ল্যাঙ্গুয়েজ
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়