শহরে কি আজ মিছিল ছিল?
ওদের কি আজ মৃত্যু হয়েছে?

অতি সম্প্রতি ইউটিউবে দেখছিলাম, রাজনীতিবিদ মির্জা ফখরুল এর একটি ভিডিও । কথা বলার মাঝে তিনি হঠাৎ একটি কবিতার কয়েকটি লাইন আবৃত্তি করলেন।

"ধানের গুচ্ছে রক্ত জমেছে, সমুদ্র তাই উদ্বেল হল।
ফেরারী বসন্ত কয়ে দিয়ে গেল নগরীর যত শিবিরে শিবিরে
কাল শহরে মিছিল ছিল।
সবাই শুনলো খুন হয়ে গেছে, খুন হয়ে গেল।"

থমকে গেলাম মুগ্ধতায় । কার লেখা এমন অপূর্ব কবিতা ! জনাব মির্জা ফখরুল তো আর বলেননি, তাই আমিও সে ভিডিও থেকে ছুটে গেলাম গুগলের কাছে। কবির নাম তো আর জানি না, মির্জা ফখরুল এর আবৃত্তির লাইনগুলো টাইপ করে সার্চ দিলাম। সহজে কোনো উত্তর পেলাম না। একটি সাইটে কিছুটা সম্ভাবনার সংকেত পাওয়া গেলো। ক্লিক করলাম, কিন্তু বর্তমান শিক্ষার্থী-সংগ্রামী এই সময়ে ইন্টারনেটের অতি ধীর গতির কারণে সাইটটি লোড হতে গিয়ে যেন কয়েক যুগ পার হতে লাগলো। অবশেষে বহুক্ষণ পরে লোড হলেও ঠিক মতো হলো না, ভাঙা ভাঙা ছিল সাইটের পেজ। পেলাম এবং দারুণ আশ্চর্য হলাম কবিতাটির রচয়িতা কবির নাম দেখে !

কবিতার নাম একুশের কবিতা এবং কবির নাম ফজলে লোহানী । ফজলে লোহানী কে চিনতাম মানে এই পুরো বাংলাদেশই একসময় চিনতো "যদি কিছু মনে না করেন" সেই বিখ্যাত টিভি অনুষ্ঠানের জন্য। এবং জানতাম তিনি একজন সাংবাদিকও ছিলেন। তাকে মনে হলেই আজো আমার চোখে ভেসে ওঠে কুজো হয়ে যাওয়া কষ্টে থাকা গ্রামীন বৃদ্ধার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন মাইক্রোফোন হাতে বৃদ্ধাটির দিকে ঝুকে পড়ে । আর মনে পড়ে, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এর মৃত্যুর পর এক ডকুমেন্টারিতে প্রেসিডেন্ট জিয়ার অনন্য সততার বর্ণনা করছেন, দেখাচ্ছেন জিয়াউর রহমান এর বিছানায় বিছিয়ে তারই পরিধেয় সাধারণ কাপড়।

কিন্তু ফজলে লোহানী একজন কবি ছিলেন এবং যদি খ্যাতিমান কবিও না হন, তবু এমন একটি সমৃদ্ধ কবিতা লিখেছেন, তা একদম অজানা ছিল। আপনারা কেউ কেউ হয়তো জানতেন, কিন্তু আমি জানতাম না। তাই ফজলে লোহানী কে একজন কবি হিসেবে এবং তার কবিতাটিকে আবিষ্কার করে আমি দুর্দান্ত রকমের মুগ্ধ হয়েছি। কবিতাটি অপূর্ব ! কাব্যিকতার কোনো অভাব নেই। পাঠক হৃদয়ে বেদনা জাগাতে যথেষ্ট পারঙ্গম একটি শৈল্পিক কবিতা নিঃসন্দেহে। কবিতাটির সাথে আপনাদের পরিচয় করে দেয়াটি আমার কাছে দায়িত্ব মনে হলো। কবিতাটি আবিষ্কার করে, কবিতাটি পাঠ করে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছি । আশা করি আপনারাও মুগ্ধ হবেন । ফজলে লোহানী কবিতাটি কবে লিখেছেন সেই নির্ভরযোগ্য তথ্য উদ্ধার করতে পারিনি। একটি আবৃত্তি সংযুক্ত করে দিলাম। ধন্যবাদ।

একুশের কবিতা
-  ফজলে লোহানী


শীতল পৃথিবী, অবশ নগর,
অসার আকাশ, বাতাস নিথর,

ফুটপাতে শুধু ছড়িয়ে আছে জীবনের সব রেণুকণা যত।
রোদগুলো সব ছড়িয়ে পড়েছে, বিছিয়ে রয়েছে ঘাসের মতন,
পলাশ ফুলের ডগায় ডগায়, ল্যাম্পপোষ্টের উঁচু কোণটায়।

একুশে বিকেল ।
মৃত্যু হয়েছে আজকে ওদের।

বোবা পাখীগুলো পাখা ঝাপটায়।
একুশে রাতের আঁধার নামে সব শহরের গলিঘুঁজিতে,
গায়ের বাঁকা পথগুলোতে,
রেল কলোনীতে, কেরানীর ঘরে, কিষাণের ঘরে,
ঘরে নয় শুধু । সবার বুকে আঁধার নেমেছে ।
আজকে তাদের মৃত্যু হয়েছে তাই শুনে সব স্তব্ধ পাষাণ ।
সব চুপচাপ।
পাখীগুলো শুধু পাখা ঝাপটায়। ব্যথায় বোধ হয়।

সবাই শুধোয়। শিলাময়।
মন কথা কয়ে ওঠে  
ওদের কি আজ মৃত্যু হয়েছে?
মৃত্যু হয়েছে? মৃত্যু হয়েছে?
হাসপাতালের গন্ধবাতাস।
বাইরে প্রহরী । খবর কোথায়?

সবাই শুধোয় রাস্তার দল, অফিসের লোক,
দোকানী, পসারী, ও পাড়ার মুদী,
নৌকার মাঝি হাল ছেড়েছে,
কামারের ঘরে হাপর থেমেছে,
কাস্তে থেমেছে, কোদাল থেমেছে,
রেলইঞ্জিনে সিটি থেমে গেছে।

ঘুমভাঙা কোন কবরখানায় জলার ধারে
প্রহরী কুকুর ডেকে ডেকে কয়
শহরে কি আজ মিছিল ছিল?
ফাল্গুনী রাত আঁধারে কাঁদে । একা ল্যাম্পপোষ্ট মিটিমিটি জ্বলে ।
শহরে সেদিন মিছিল ছিল ।
পৃথিবী সেদিন উল্টো ঘোরেনি, এগিয়ে গেছে।
সবাই শুনলো খুন হয়ে গেছে, খুন হয়ে গেল।
মায়ের চোখের দু'ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছে রমনার পথে ।
ধানের গুচ্ছে রক্ত জমেছে, সমুদ্র তাই উদ্বেল হল।
ইম্পাত-দৃঢ় কঠিন শপথ । কাজ নয় আর কাজ নয়।
ফেরারী বসন্ত কয়ে দিয়ে গেল নগরীর যত শিবিরে শিবিরে
কাল শহরে মিছিল ছিল। কাজ নয় আর কাজ নয়।

সকালের রোদে খবর পেয়েছে
বাংলার ঘরে সব ভাইবোন
হত্যা হয়েছে কাল শহরে। তাই কাজ নয় আর কাজ নয়।
মৃত্যুকে যারা ভয় করেনি, মৃত্যু তাদের বরণ করেছে,
এ খবর গিয়ে গাঁয়ে পৌঁছেছে, সবার মুখেই বজ্র শপথ;
হাতুড়ি আমরা নামিয়ে নিলাম, কাস্তে-কোদাল থামিয়ে দিলাম
কাঁচা-শহীদের স্মৃতির ভারে।
পাড়ার মোড়ে ল্যাম্পপোষ্টটাও অবনমিত শ্রদ্ধাভরে।
বাংলার কোনো দূরদেশ গাঁয়ে ।
সজনে তলায় মাটির ঘরে উঁচু দাওয়াটায় প্রদীপ জ্বলে
জীবনের সব ভীরু পাখাগুলো জড়ো হয়ে আছে মায়ের মনে ।
একাকী মায়ের ফাঁকা বুকখানি কেঁপে কেঁপে ওঠে কীসের শোকে ?
“মাগো, ভাবনা কীসের ? আসছে ছুটিতে আবার ফিরবো তোমার কোলেই।”

শহীদ ছেলের শেষ কথাগুলো মনে পড়ে যায় একলা রাতে ।
দুঃখিনী মায়ের আঁচলের ধন ফিরে আসবেই রাত্রিশেষে । ছুটির শেষে।
আকাশের যত তারারা আজকে ভিড় করে সব মিছিল করেছে ।
সখিনা মায়ের অশ্রু ছুঁয়ে শপথ নিয়েছে ।
আর চুপ নয়
মায়েরা সব গেয়ে ওঠো আজ । মায়েরা সব গেয়ে ওঠো
ধান ভানতে ক্ষুদ কুড়োতে, গমের শীষের খোসা ছড়াতে
ধান ভানতে ক্ষুদ কুড়োতে, গমের শীষের খোসা ছড়াতে

মায়েরা সব গেয়ে ওঠো আজ । মায়েরা সব গেয়ে ওঠো
আর চুপ নয়
এবার শুধু
শহীদের গান। বিজয়ের গান ॥
শহরে যাদের মৃত্যু হয়েছে,
ফিরে আসছে, ফিরে আসছে,
হাজারে হাজারে মিছিল করে ॥


(০৪.০৮.২০২৪)