[বিশেষ দ্রষ্টব্য: কবি নিজেই নিজের কবিতার গুণগান বা প্রশংসা নয় কিন্তু কবিতাটি কী কারণে কবি লিখলেন সেই গল্প আলোচনা পাতায় বলার অনুমোদন মাননীয় এডমিন দিয়েছেন। এক্ষেত্রে আলোচনা পাতায় পথিকৃত আসর প্রিয় কবি সরদার আরিফ উদ্দিন এবং তার খুব সুন্দর সমৃদ্ধ সিরিজ কবিতার পেছনের গল্প ১ থেকে ১২।]

কবি নাহিয়ান ফাহিম এর সাথে আমার পরিচয় ব্যাংকে কাজ করার সময়, ২০০৯-২০১০ সালে । আমার থেকে বয়সে হয়তো পনেরো বছর ছোট ছিল । দু'জন দুই সেকশনে কাজ করতাম । তবে রত্ন কী আর আড়ালে থাকে ! ঠিকই আমার চোখে আবিষ্কৃত হলো, সে একজন দুর্দান্ত কবি । তার কবিতা পড়ে ভিড়মি খাবার যোগাড়, কীভাবে এই তরুণ, ঋদ্ধ কবিদের মতো কবিতা লেখে । তার কবিতার অনুভবে আমার মন উত্তাল বেতাল ছিন্ন বিচ্ছিন্ন এবং বলতে বাধা নেই, ঈর্ষাকাতর ! তার প্রিয় কবি ছিলেন, কবি মহাদেব সাহা । জানার পর দেখতাম সেই কবির অনবদ্য ছায়া মাঝে মাঝে নাহিয়ান এর নিজের কবিতায়, তবে অবশ্যই সেগুলো ছিল মৌলিক এবং তা পাঠে মুগ্ধতা ছাড়া কিছুই আমি পেতাম না ।

নাহিয়ান এর একটি কবিতার মোটা খাতা ছিলো, তাতে ভরপুর কবিতা এবং প্রত্যেকটি কবিতার পাশে সে আঁকতো কবিতার ভাব অনুসারে অপূর্ব সব চিত্র । পরে আমাকেও সে আমার কবিতার বেশ কিছু ট্যামপ্ল্যাট করে দিয়েছিলো । শুধু সে-ই আঁকতো তাই না, খাতাটায় ভালোবেসে এঁকে দিতো নাহিয়ান এর প্রেমিকাও । সেটা নিয়েও আমার একটি কবিতা আছে, "আধোকাব্যর উত্তর"। সেই কবিতা নাহিয়ান তার নিজের ফেসবুকে পোস্ট করে রাখে । আমি তো আর জানি না । পরে যখন আমি প্রথম পোস্ট করলাম কবিতার আসরে ২০২০ সালে, দেখি বিস্মিত হয়ে আমার কবিতা পাঠের সংখ্যা মুহূর্তে হাজার ছাড়িয়ে যাচ্ছে । আমি তো তাজ্জব, কী বিষয় রে বাবা ! একটু পরে আমার আশ্চর্য নাশ করে অভিযোগ এলো, আমি নাকি অন্যের কবিতা চুরি করেছি । এই অপবাদ তো আমার কাছে মৃত্যুর মতো । আমি ছেপেছি ২০২০ সালে এই কবিতার আসরে প্রথম, ব্যাংক ছেড়ে চলে আসার দশ বছর পর । আমার তো আর ঘুম আসে না । প্রমাণ তো দিতেই হবে এটি আমার কবিতা । খোঁজ, খোঁজ, নাহিয়ান কে খোঁজ । ফোনের পর ফোন করে পেলাম, নাহিয়ান কে, না, সে এখনো আছে ঐ ব্যাংকেই । আমি আবেগে কাঁপতে কাঁপতে জানালাম সব । সে স্বীকার করলো এই কবিতা "আধোকাব্যর উত্তর" সে তার নিজের ফেসবুকে পোস্ট করে রেখেছিলো । এবং বললো, এক্ষুণি আপনার ওখানে মন্তব্য করে অভিযোগকারীদের সব ভ্রান্তি দূর করে দিচ্ছি। অতঃপর কবি নাহিয়ান লিখলো খুবই আন্তরিক প্রীতিপূর্ণ ভাষায়,

"সম্পূর্ণ মনে আছে আমার! সেই কত বছর আগেকার কথা। আমার এক সামান্য লেখার উত্তরে এই লেখাটি ইফতেখার ভাই অফিসে বসেই লিখলেন। পড়ার পর বিস্ময়বোধ কাটতে বেশ সময় লেগেছে। পাঠকদের জানাই, এই ভদ্রলোক এক চাঁদে পাওয়া কবি। পুরোদস্তুর কবি। আপোষ করতে হবে শুনে এক অভিজাত চাকরি বসের মুখের উপরে এক কথায় ছুঁড়ে দিয়ে এসেছেন। যা এই এতটা বছরে আমাদের পক্ষে সম্ভব হল না।
কবিকে শুভেচ্ছা। ভালোবাসা। শ্রদ্ধা। বিনীত, নাহিয়ান।"

এই কবি নাহিয়ান আজো আমার হৃদয়ে এক অনন্য কবি এবং বন্ধু, যদিও এখন আর দেখা হয় না । সে পরে কবিতার বই বের করেছিলো ২০১২ সালের একুশে বইমেলায়, "ভিনদুপুরের নোটবই" । কিন্তু দুঃখের বিষয়, ২০২০ সালে তার সাথে কথা হবার সময় সে বলেছিলো, সে এখন আর কবিতা লেখে না । খুব দুঃখ পেয়েছিলাম, আশ্চর্য হয়েছিলাম, অথচ আমার মতো নিম্ন মানের অকবি কবিতা লিখেই চলছে নির্বোধের মতো । নাহিয়ান এর কবিতা পড়ে আমি তো মাত্রা ছাড়া মুগ্ধ হতাম। আমার কবিতা সে তুলনায় কিছুই না । তবুও নাহিয়ানকে দিতাম পড়তে । পড়তে পড়তে এই কবিতা "মেয়েটি.." পড়ে, এবার নাহিয়ান মুগ্ধতায় দারুণ আটকে গেলো । বার বার আমাকে বলে, "হারিয়ে যে যাচ্ছো মেয়ে, বিদায় নিলে না ?" নাহিয়ান এর বন্ধুরা গান বাজনা করতো এবং লিটল ম্যাগাজিন বের করতো । সেই সূত্রে, জীবনে প্রথম আমার একটি বাংলা কবিতা, এই কবিতা "মেয়েটি.." ছেপে দিল নাহিয়ান তাদের ম্যাগাজিনে এবং এরপরের আরেকটি সংখ্যায় আরেকটি কবিতা । এরপর আর ছাপা হয়নি কোথাও আমার বাংলা কবিতা । তাই এই কবিতার তুল্যমূল্য যাই-ই হোক, এটা আমার হৃদয়ের খুব কাছে রেখে দেয়া একটি কবিতা। কবি নাহিয়ান ফাহিম তোমার জন্য আজো ভালোবাসা।

এবার কবি নাহিয়ান ফাহিম এর "ভিনদুপুরের নোটবই" কবিতার বইটি থেকে কিছু কবিতার অংশ পড়ার অনুরোধ করছি:

"এমন একটা শহর"

আমরা একটা শহর বানিয়েছি
যার রাস্তাগুলো সরু হচ্ছে, বাড়িগুলো হেলে পড়ছে
আমাদের জানালা খুললেই কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি
বারান্দায় দাঁড়ালেই পাশের বাড়ির রান্নাঘর
ছাদের উপরে বিলবোর্ড
বাগানের অর্ধেকটা পার্টি অফিস, বাকি অর্ধেকটা বস্তি
ওভারব্রিজে উঠলে তবে আমাদের বাজারসদাই
আমাদের মহাসড়কে লাল বাতির মানে গতি বাড়াও
আমাদের বাচ্চারা ড্রয়িং পরীক্ষায় সবুজ মাঠ আঁকতে বললে
কেমন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে

"দুঃখ"

ঈশ্বরের জন্য খুব দুঃখ হয় । ঈশ্বর একা ।

"অপচয়"

তোমার স্টাডিরুমের শোকেসে পৃথিবীর তাবৎ মহাপুরুষের সম্মিলন-
ফলে, স্বাভাবিকভাবেই,
তোমার চশমার পাওয়ারে ঝিম মেরে আছেন মাও সেতুং
ভুরুর মাঝখানে ঈষৎ বিরক্ত লেনিন
এবং লম্বা দাড়ি গোঁফের দঙ্গলে বিষণ্ন কার্ল মার্ক্স ।
তোমার স্টাডিরুমের এন্তার ভিডিও সিডিতে বিশযুদ্ধ আছে-
দেশত্যাগ আছে-
ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ আছে-
তোমার টি শার্টে গনগনে মুখের চে
আর দেয়ালে কাস্ত্রোর ছবিও আছে ।
তুমি বন্ধুকে ডাকো কমরেড
আর কিছুতেই গলা নামিয়ে কথা বলতে পারো না ।
মার্কিন পতাকা দেখলে তোমার হাত মুঠো হয়ে আসে ।
গান নয়, তোমার ঝাঁকড়া বাবরি চুল শ্লোগান শুনলে নেচে ওঠে ।
অর্থাৎ, তোমাকে সামান্য কাত করলেই, বলা যায়, গড়িয়ে নামছে বিপ্লব ।
সত্যি দারুণ ব্যাপার !
আচ্ছা, পুরোটা যৌবন তুমি কোথায় কাটালে, তোমার স্টাডিরুমে ?

"কবি"

কবির কিছুই নেই
পথের ওপারে কোনো গন্তব্য নেই তার
নেই বাড়ি, রক্তের যোগ্য কোনো নারী-

কবি নয় মিছিলমানুষ-
ভরদুপুরেও যখন সে ফুটপাতের একটি নিষ্কর্মা
কুকুরের সঙ্গে হাই তোলে
আর বাদামওয়ালার সঙ্গে বিনিময় করে সিগারেট
তখনও তার চোখে ফুলের উৎসব, বুকপকেটে মেঘ
একদিন মুঠোয় নেবে তাই, কবিই তো পুকুরজলে
কান ধরে টেনে আনে চাঁদের থালাটি

কখনও কবিকে খুব নিরীহ দেখায়
বাঈজীর চারপাশে পড়ে থাকা মুদ্রার মতো
কখনও প্রকাশকের ফর্মায় সে হ্রাস করে নিজস্ব হিয়ার আকার
বিদ্রূপের ছুরি পিঠে নিয়ে সন্ধ্যাবেলা নীল অন্ধকারে
কবি তখনও অন্যমনষ্কতায়
চুপচাপ হেঁটে যেতে জানে, হেঁটে যেতে জানে

"শব্দার্থ"

জেনে গেছি সব......
শুধু মানুষের শব্দার্থ আজও জানা হলো না

"জাদুঘর"

স্মৃতির সঙ্গে ডিভোর্স হয় না,
স্মৃতি কী ভীষণ প্রজননশীল !
একটাই মুখ ভুলতে চেয়েছ,
দিনরাত সেই মুখের মিছিল ।

কোলে নিয়ে এত ফাঁকা মুহূর্ত
আবছা মলিন জং অস্বচ্ছ
কখনও মনে কি হয়নি, তুমিই
জাদুঘর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছ ?

মাত্র কিছুদিন আগে একটি কবিতায় আমি লিখেছি আমি বাসের মানুষ । সেরকমই একদিন ২০০৯ সালে বাসে করে অফিসে যাচ্ছি । আমি বসে ছিলাম পেছনের দিকে । আর মেয়েটি বসে ছিল বাস ড্রাইভারের অপর দিকে জানালা সমান্তরাল লম্বা বেঞ্চের মতো সিটে । মেয়েটির দিকে চোখ পড়তেই, তার গোল মুখ এবং সেই মুখের মাঝে অনন্য এক বিষন্নতা দেখে আমি বার বার তাকিয়ে থাকলাম । মেয়েটি আমার মাঝে এক গভীর অনুভব সৃষ্টি করলো, তা বোলে বোঝানো, বর্ণনা করা দুষ্কর, দুঃসাধ্য । কবিতার বাক্যের ভ্রুণ নড়াচড়া শুরু করেছে ভেতরে কিন্তু পূর্ণতা পাচ্ছে না । বাসটি ফার্মগেটে থামলো । মেয়েটি কী ধীর নম্র এক ভঙ্গিতে সিট থেকে উঠে এসে নামলো দরজা দিয়ে । আমি নিবিড় তাকিয়ে আছি । এবং নামার পরই, মেয়েটি দৃশ্যায়িত করলো কবিতার একটি মূল অভিঘাতের দৃশ্য. "... টুক করে খুলে দিলো তার খোঁপা" এবং সে হারিয়ে যেতে লাগলো ফার্মগেটের জনঅরণ্যে এবং হারিয়ে গেলো তারপর । মনে মনে যেন বোলে উঠলো আমার বেদনার্ত কবি সত্তা, "তোমাকে মেয়ে, এত গভীর অনুভবে আপন করে নিলাম, অথচ তুমি তা না জেনেই নির্বিকার চলে গেলে !" আমার ভেতরে হাহাকার করে উঠলো কবিতার শেষ বাক্য, "হারিয়ে যে যাচ্ছো মেয়ে, বিদায় নিলে না ?" এই হলো ইতিহাস, কবিতাটির ।  
  

মেয়েটি..
- মার্শাল ইফতেখার আহমেদ

মেয়েটিকে হয়তো কেউ বলেছিলো
খোলা চুলে তাকে সবচেয়ে সুন্দর দেখায় ।

তাই বাস থেকে নেমেই
মেয়েটি টুক করে খুলে দিলো তার খোঁপা

বিস্তৃত হলো আমার সামনে গভীর অরণ্য ।

মেয়েটির গোলাকার মুখের স্বচ্ছ আয়নায়
ছিলো মেঘলা দিনের বিষন্নতা ।

হারিয়ে যে যাচ্ছো মেয়ে, বিদায় নিলে না ?


(২০০৯)


** সেই সময় নিজের নাম লিখতাম, ইফতেখার মার্শাল আহম্মেদ । পরে এদিক ওদিক করে এখন যা দেখছেন সেভাবে লিখি। ধন্যবাদ সবাইকে।