(আমার এই লেখাটির প্রথম অংশ এক দৃষ্টিতে আমার কবি-জীবনের স্মৃতি বা অভিজ্ঞতামূলক এবং দ্বিতীয় অংশটি, সম্প্রতি আমার কবি জীবনে একটি ক্ষুদ্রতম প্রাপ্তির সমসাময়িক ঘটনা বলে বিবেচ্য)
আলোচনা পাতায় কোনো কিছু লেখার জন্য ইচ্ছে হলে, প্রথমেই আমাকে "কবি" করে তোলার জন্য বা কবিত্বের সুখ লাভের সুযোগ করে দেয়ার জন্য, বাংলা কবিতা আসর বা বাংলা কবিতা.কম এর প্রতি অপরিসীম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ইচ্ছে করে। আসলেই তাই, শত সহস্র লক্ষ কৃতজ্ঞতা, পবিত্র কবিতার অনন্য আলোয় আলোকিত আমাদের বাংলা কবিতার আসর।
কবে প্রথম কবিতা লিখেছি তা মনে পড়ে না। তবে একটি দৃশ্য সবসময় আমার স্মৃতিময় মনোলোকে জ্বলতে থাকে সুন্দর। আমার সদ্য কৈশোরের একদম প্রারম্ভে, নারায়ণগঞ্জের পাট বাংলাের সবজু ঘাস আবৃত বাগান থেকে যে বাঁধানো ঢাল, নিচে নেমে ছুঁয়েছে শীতলক্ষ্যার রূপসী জলের শরীর, তার ওপর বসে, নদীর ওপর দিয়ে পাট বোঝাই নৌকার প্রায় নীরব আর পানিতে দাড়ের স্পর্শে কোমল ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ধীর গমন, দু'পাড়ের মানুষের নদীর জল দিয়ে তাদের গৃহ-কর্মাদির জীবন দৃশ্য এবং সূর্যের আলোতে ঝিকিমিকি চ্ছটায় শীতলক্ষ্যার প্রশান্ত স্রোতের মিহি শব্দে বয়ে চলার অপরূপা রূপটি সম্মুখে রেখে, জাতিসংঘে চাকুরি-রত আমার মা'র দেয়া একটি চমৎকার ডায়েরীতে কবিতা লিখছি। কবিতা লিখলেও, তখন কিন্তু খ্যাতিমানের কবিতা ভুবনে তেমন করে বিচরণ শুরু হয়নি। তখন গোগ্রাসে গিলে চলেছি একদিকে শরৎচন্দ্র, অন্যদিকে সুনীল-হুমায়ুনের উপন্যাস এবং তৎসঙ্গে বঙ্কিমের "দিনমণি অস্তাচলগমনদ্যোগী" শব্দ সম্বলিত ১৪টি উপন্যাসের আরো ভয়ঙ্কর শব্দের অর্থ উদ্ধারের জন্য বিষম দন্ত-ভঙ্গ প্রচেষ্টা ও আগ্রহে। পাঠ্য বইয়ের কবিতাগুলোর পরে কবিতার রহস্যময় জগত যেন প্রস্তুত থাকে "জীবনানন্দের বনলতা সেন"-কে, যে কোনো রোমান্টিক কবিতা উন্মুখ হৃদয়ের জমিনে প্রথমেই বিছিয়ে দেয়ার জন্য, তাই হলো। এরপর শামসুর রাহমানের রক্ত উছল করে দেয়া বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সাথে সম্পৃক্ত নিবিড় কবিতাগুলোও, অনায়াসে আমার দেশপ্রেমের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। তবে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্যের অতুলনীয় ঝরঝরে সতেজ সাবলীল ভাষা, আমাকে তার কবিতা পাঠের দিকেও ধাবিত করে সহজেই এবং যা প্রত্যাশা করেছিলাম তাই, তাঁর কবিতাও আমাকে দেয় একই মাপের ঐশ্বর্যের আস্বাদন। সেই প্রথম, কোনো খ্যাতিমান কবির কবিতা একাধারে পড়ে গেলাম এবং তারসাথেই শুরু হয়ে গেলো কবিতা পড়া, রবীন্দ্রনাথ নজরুল সুকান্ত, জীবনানন্দ থেকে শুরু করে এপার ওপার বাংলার পুরোনো-আধুনিক সব খ্যাতিমান কবির কবিতা, সেই আমার কৈশোর জীবন থেকে আজ পর্যন্ত। তবে অস্বীকার করার কিছু নেই, জীবনানন্দ এবং তার পরবর্তী কালের কবিতাই আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছে সতত।
ছোটবেলা থেকেই বাংলা কবিতা-গান লেখার পাশাপাশি ইংরেজী গান-কবিতা লিখতাম এবং গানগুলোতে সুরও দিতাম, যার মধ্যে অনেক গান আমার বন্ধুমহল আজো ভালোবেসে গায়। কবিতার মতো এসব গানগুলোও কোথাও প্রকাশিত হয়নি। যার জন্য কবিতায় ক্ষোভ প্রকাশ করে কারণ হিসেবে দায়ী করেছি যে, কবি-সম্পাদক বা সঙ্গীত-শিল্পীদের সুবিধাপ্রাপ্ত কোনো দলে ভিড়তে পারিনি, যারা তাদের তোয়াজ-তোষণ করা ছাড়া আটক করে রাখে কোনাে কবির নতুন প্রবেশ, যারা নিজেদের সৃষ্টি যে মানেরই হোক না কেনো, তা প্রকাশ বা ছাপাবার সুযোগ পায় শুধুমাত্র তাদের পারষ্পরিক পরিচিতি এবং গোষ্ঠিবদ্ধতার সুবাদে। এছাড়া, অনেক বার আমার পাঠানো কবিতা, পত্রিকা সম্পাদকের বাতিল ঝুড়িতেই নিপতিত হয়ে অবাঞ্ছিত হয়েছি, আমি নিশ্চিত। সেই পত্রিকা ম্যাগাজিনে কবিতা ছাপার আমলে, আমি এমন অনেক কবিতা ছাপা হতে দেখেছি, যার তুলনায় আমার অনেক কবিতাই বাতিলযোগ্য তো নয়ই বরঞ্চ সমমানের বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে উন্নত। যার প্রমাণ, কবিতা আসরে আমার দু'বছরের জীবনে, সে সময়কার অনেক কবিতাই, কবিতা আসরে প্রকাশ করার পর, গৎ বাঁধা মন্তব্যের পাশাপাশি অনেক কবি বন্ধুদের, অগ্রজ এবং তরুণ, দু'দিক থেকেই মন আলোড়িত করা মন্তব্য পেয়েছে। সবার প্রতিক্রিয়া তো কৃত্রিম বা অসৎ হতে পারে না, এ কবিতা আসরে কবিতা বোঝার বোধ জ্ঞান অনেকে কবি-পাঠকেরই আছে, কবিতার মূল্যায়নে তাদের স্বীকৃতি অবশ্যই ধর্তব্য।
আর এজন্যই কবিতা আসরকে মাথায় তুলে রাখতে ইচ্ছে হয়। কবিতা আসরের প্রতিষ্ঠাতা কবি ও প্রধান এডমিন পল্লব আশফাক এর কাছে বারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ইচ্ছে করে। নিশ্চয়ই অপ্রকাশিত কবিদের বেদনা প্রত্যক্ষ করে, এক যুগান্তকারী চিন্তা-চেতনার "Genius Masterstroke"-এ, বাংলা কবিতা আসর তিনি প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন। অপ্রকাশের দুঃখ যন্ত্রণায় বিদ্ধ কবিদের, কবিতা প্রকাশের এক অভিজাত, কিংবদন্তীর ক্ষেত্র সৃষ্টি করে, তিনি কবিতার ইতিহাসে অমর একটি জায়গা করে নিলেন নিশ্চিত। কারণ, আমরা যারা এখানে এসেছি, আজ এক যুগ ধরে, আসছে আরো অনেক কবি, তারা কিন্তু কবি পল্লব আশফাক এর নাম স্মরণে রাখবে চিরদিন এবং ছড়িয়ে দিতে থাকবে তার নামটি, বাঙালি কবিতা-প্রিয় মানুষের মাঝে পৃথিবীর চার গোলার্ধে।
এতদিন আমার কবিতা পড়েছেন কবিতা আসরের কবি বন্ধুরাই, তবে সেদিন কবিতার আসরের বাইরে, প্রথমবার চারজন রমণীকে আমার স্বরবৃত্ত এবং একটি অক্ষরবৃত্ত কবিতা পাঠ করে শোনালাম। তাদের মুগ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখে এবং দ্বিতীয় দিন আগ্রহের সাথে আবারো কবিতা শোনানোর জন্য সৎ আহবান দেখে, আমার কবিত্ব আবার নবায়ন লাভ করলো। একজন বললো, আপনার কবিতাগুলোর "ভাব" আমাকে আলোড়িত করেছে, আরেকজন বললো, কবিরা কবিতা লেখে, কিন্তু আবৃত্তি করতে পারে না, উনি কিন্তু দুটোই খুব সুন্দর পারেন। আমি সংকোচে জিজ্ঞাসা করলাম, "কবিতার বই বের করার মতো কবিতা কি হয়েছে?" রমণীরা সমস্বরে সবাই বললো. এরকম কবিতা হলে, অবশ্যই! এই কবিতা আসরের বাইরে প্রথমবার আমার কবিতার সত্যিকার একটি মূল্যায়ন পেয়ে সাহস পেলাম।
এবার আসি লেখাটির দ্বিতীয় অংশে। সেই কিশোরবেলা থেকেই, আমি ইংরেজী কবিতা লিখছি। আমার বাংলা কবিতাই কোনোদিন গ্রাহ্য হয়নি, ইংরেজী কবিতা তো লজ্জায় লুকিয়ে রাখবোই। সম্প্রতি, আমাদের কবিতা আসরের মতো, খুব জনপ্রিয় একটি ইংরেজী কবিতা সাইটে, যেখানে ৪২,০০০ হাজার কবি সদস্য আছে, তন্মধ্যে ৪,৬০০ সক্রিয় কবিতা লিখছে, সেখানে আমি আমার ইংরেজী কবিতা প্রকাশ শুরু করেছি এ মাসের ৩ তারিখ থেকে। সেসব কবিতার কিছু বাংলা অনুবাদ, সাম্প্রতিক সময়ে আমি কবি বন্ধুদের মাঝে নিবেদন করে প্রশংসা পেয়েছি। বাংলা কবিতা আসরে কবি বন্ধুদের কবিতার "পাঠক" হিসেবে আমার যে খানিক জনপ্রিয়তা, তা যেন সহজেই এবং কম সময়ের মধ্যে ধরা দিলো ফের ইংরেজী কবিদের কবিতার আসরটিতে। সবাই, তাদের ইংরেজী কবিতার ব্যবচ্ছেদে, মন্তব্যের রঙে, আমার প্রতি দারুণ মুগ্ধ! এমনকি, কয়েক কবির "Mother Tongue" ইংরেজী হওয়া সত্ত্বেও, ওদের কবিতার ব্যাকরণগত বা পঙক্তির অনুভবগত ভুল আমি ধরিয়ে দিয়েছি। তবে এ কথাও সত্য, আমাদের মুখের ভাষা বাংলাতেও আমরা একইরকম ভুল করি।
সেই ইংরেজী কবিতা সাইটে, আমি যে প্রথম কবিতাটি প্রকাশ করি তার নাম "The Maker & The Eve"। প্রথম কবিতা হিসেবে তেমন পাঠ সংখ্যা পায়নি। ২০০৭ সালে লিখিত সে কবিতা, কবিতা আসরের বন্ধুদের জন্য অনুবাদও করে রেখেছি বহু আগে থেকেই, তবে প্রকাশ করিনি, করবো কিছুদিনের মধ্যেই। যাই হোক, এরপর আরো ইংরেজী কবিতা প্রকাশ করতে থাকলাম, এবং বেশ কিছু কবির প্রশংসা পেতে থাকলাম। শেষ ২৩তম কবিতাটি জানুয়ারীর ১৪ তারিখে প্রকাশের পর, আর কবিতা প্রকাশ করিনি সেখানে ব্যস্ততার কারণে। এখানে একটি কথা বলে রাখি, এই ইংরেজী কবিতা আসরে একদিনে যত ইচ্ছে কবিতা প্রকাশ করা যায়। এছাড়া প্রিমিয়াম এবং লাইফটাইম মেম্বারশীপ ক্রয় করে কবিতাসহ অন্যান্য লেখার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুবিধা পাওয়া যায়। এই "The Maker & The Eve" কবিতাটিতে কোনো পাঠকের মন্তব্য ছিল না। তবে গত ১৫ জানুয়ারীতে মাল্টা দেশের কবি Paul Callus মন্তব্য করলেন, "মার্শাল, খুব সুন্দর একটি কবিতা দিয়ে তোমার আসরে আত্মপ্রকাশ হলো! গর্ভ এবং জন্মদান নারীদের জন্য ঈশ্বরের উপহার!" বুঝতেই পারছেন আমার কবিতার মূল বিষয়।
এরপর, হঠাৎ সেদিন গত ২৩ তারিখে, আমার ই-মেইলে একটি বার্তা আসে, যা আমি দেখি তিনদিন পর ২৬ তারিখে, "সুপ্রিয় মার্শাল ইফতেখার, অভিনন্দন! তোমার কবিতা ""The Maker & The Eve" আসরের হোম পেজে সপ্তাহের কবিতা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে।" ঠিক যেমন আমাদের কবিতা আসরে করা হয়। তবে, সেখানে কোনো রিভিউয়ার পদ্ধতি আছে কিনা জানা নেই। হয়তো, কোনো কবি-কমিটি আছে, তারা আমার কবিতা তালিকা থেকে বাছাই করে, কবিতাটি হাইলাইট করেছেন এবং দাপ্তরিক ই-মেইলের মাধ্যমে আমাকে তা জ্ঞাত করেছেন।
সুতরাং, শেষ কথা এটাই, একটি বৃহৎ জনপ্রিয় ইংরেজী কবিতার আসরে, আমার সাপ্তাহিক কবিতা নির্বাচিত হওয়ার অর্থ আমার কাছে, আমার ইংরেজী কবিতা, কবিতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলো বা পেলো। এবং এটাই আমার কবি জীবনে আপাত ক্ষুদ্র প্রাপ্তি হলেও, "ইংরেজী ভাষার কবি" হবার সাথে সাথে, বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে কবি হিসেবে বৈশ্বিক পরিচিতির একটি ক্ষেত্র সৃষ্টি হলাে! আমার সামান্য কবি জীবনে, এই বা কি কম প্রাপ্তি! আমার জন্যে অনেক। তাই বিষয়টি জানালাম কবি বন্ধুদের। সবার সুখী কবি জীবনের জন্য শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।