পাঠকের রুচি একটি অধিকার। তার সে অধিকারকে আমরা খর্ব করতে যেমন পারি না, তেমনি যে পাঠক একটি ধারার, একটি ঘরানার রুচির অধিকারী, সেও অন্য পাঠকের রুচিকে তিরষ্কার করার অধিকার রাখেন না। যে পাঠক যে কালে বেড়ে উঠেছেন, সেকালের কবিতাই তার সারাজীবন ভালো লাগবে। এবং সময়ের সাথে সাথে একটি পাঠকের পাঠ রুচিতে পরিবর্তন ঘটতে পারে বা নতুন অন্য ধারা বা পুরোনো ধারার কবিতাকেই সে ভালোবাসতে শুরু করতে পারে। পাঠকের সুক্ষ্ণ বোধ-জ্ঞান, অবিরত বিভিন্নমুখী পাঠ চর্চা এবং শৈশব থেকে যৌবনে বিদ্যালয়, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে তার পাঠকাল যত সমৃদ্ধ, সুদৃঢ় হবে, তত তার মননের রুচির বিস্তার ঘটবে।
ফলে সে পাঠক যে কোনো যুগের লেখারই রূপ-রস-ভাব ইত্যাদি অনুভব, উপভোগ করার দক্ষতা, মননশীলতা অর্জন করবে। একজন পাঠক যখন মাইকেল মধুসূদন, রবি ঠাকুর বা নজরুল পড়বে, তখন সে জগতের শব্দ বাক্যের ব্যঞ্জনার মধ্যে নিজেকে স্থাপন করে নেবে । আবার যখন আধুনিক কবিতা পড়বে, তখন ঠিক তেমনই তার পাঠ অনুভব আধুনিকতার শব্দ-বাক্য রূপ-কাঠামোর মাঝে সমর্পণ করে দেবে। আধুনিক কালে বসে কেউ যদি মধসূদন বা রবি যুগীয় কবিতা লেখা চর্চা করে, তবে তাকে বর্জন বা গ্রহন করা পাঠকের অধিকার। কিন্তু তাকে স্বৈরাচারের মতো বলা যাবে না, আধুনিক সময়ে এমন কবিতা তুমি লিখতে পারবে না। কবিতা লেখা কোনো মসনদ অধিগ্রহন নয়, যে তাকে আমরা সেই পূর্ববর্তী মহানদের মতন কবিতা লিখতে বাধা দেবো। যদি আধুনিক কালে আপাতদৃষ্টিতে প্রাচীন ছন্দে শব্দ বাক্যে কবিতা লেখা মহা অপরাধ হয়, তবে আজো কেনো রবীন্দ্রনাথ প্রিয় কবি হিসেবে অপরাজিত, কেনো নজরুল আজো বিদ্রোহী ও বিরহী কবিদের সম্রাট, হয়ে গেছে তো শতবর্ষ পার, এ সময়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যদি তাদের প্রিয়'র তালিকায় এসব পুরোনোকালের কবি মহানদেরই হৃদয়ের কাব্য দেবতা করে রাখেন, তবে কেনো আমরা বলবো, ওঁদের মতো লেখা যাবে না! এবং যাবে না লেখা, জীবনানন্দের মতোও! এসব হাস্যকর সংকীর্ণতা, অযথা আধুনিক বলে দাবী করা কবিদের, পাঠকদের একধরনের গোয়ার্তুমি। কবিতা কবিতাই, পুরোনো দিনের শব্দ-বাক্য দ্যোতনায় কবিতা লিখলে তা অকবিতা হয়ে যায় না।
কবি ইমামুল ইসলাম মুরাদ, সেরকমই বিগত দিনের ক্লাসিক ধারায় কবিতা রচনার চর্চাকারী, একান্ত নিমগ্ন। কবিতা আসরে যোগ দিয়েছেন প্রায় পাঁচ মাস হলো। তার প্রথম কবিতা পড়ি "সহসা বঙ্গবন্ধু" এ বছর জানুয়ারী মাসের ২৫ তারিখে। সেই প্রথম কবিতায় আমার মন্তব্যটি, আলোচ্য কবি কোন ধারার বা কাঠামোতে কবিতা রচনা ভালোবাসে, সেটির পরিচয় এবং আমার নিজের অনুমোদন প্রদান করে, "ভালো লাগলো সাধু ভাষার কবিতার কাঠামো এবং তার ব্যঞ্জনা!" - এই শুরু হলো আমার মুগ্ধতা। এরপর, আমার মন্তব্য দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকলো মুগ্ধতায়! সে মুগ্ধতা কিসের জন্য? সেই মাইকেল মধুসূদন দত্ত বা রবির যুগের মতো শব্দ বাক্য ছন্দের অপূর্ব ঝংকারের জন্য। কবি মুরাদের কবিতা পাঠকালে আমি ভুলেই যাই, আমি আধুনিক কালে বসে, এরকম "পুরোনো ভাষা কাঠামোর অনন্য ব্যঞ্জনার" অপার পাঠ সুখ উপভোগ করছি।
কবি ইমামুল ইসলাম মুরাদ এর জন্ম ১১ই ভাদ্র ১৪০০ বঙ্গাব্দে সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার জগদল গ্রামে সম্ভ্রান্ত কোরেশী পরিবারে। কবির দাম্পত্য সঙ্গী, মিসেস হুমায়রা কোরেশী শাপলা, যিনি সম্প্রতি কবিতা আসরে "আপাতত" ছড়াকার হিসেবে যোগদান করেছেন। হয়তো পরে ছড়ার পাশাপাশি কবিতাও লিখতে পারেন। কবির পিতা-মাতা, জয়নাল কোরেশী ও মিনা কোরেশী। কবি তার প্রিয় অঙ্গন বলতে ভালোবেসে "বাংলা-কবিতা ডটকম"-কেই করেছেন। কবির কবিতার গ্রন্থ, "নীলোৎপল", "মহানন্দা তীরের তরুণী" এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কবির অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ "বাংলার পদ্মকর"খুব শীঘ্রই শুভপ্রকাশ হতে যাচ্ছে।
এবার আলোচ্য কবিতায় আসি। কবিতা আলােচনা ছাড়াও আমার উদ্দেশ্য, আপনাদের কাছে এক প্রকারের যুক্তি নিবেদন করা যে, আমার মতন নামমাত্র সৌখিন কবি যখন শুধুমাত্র কথ্য ভাষায় কবিতা লিখতে পারে, সাধু ভাষায় কবিতা লেখার ক্ষমতাই নেই, যেহেতু সাধু ভাষার শব্দ-জ্ঞান নেই বললেই চলে, যখন আমাকে পুরো আধুনিক না বললেও, জীবনানন্দ পরবর্তী সুনীল যুগের কবিতা কাঠামোর অকবি বলেই বা ধরে নিতে পারেন, তখন কি করে আমি, এই পুরোনো কালের ভাষায় রচিত কবিতাকে এত গভীর অনুভব করার ক্ষমতা রাখি ? তার একটাই উত্তর, যা আমি শুরুতেই বলেছি, শিক্ষা, সুক্ষ্ণ বোধ-জ্ঞান এবং উদার পাঠ রুচির বিস্তৃত পরিধি। সাধু ভাষায় যদি সত্যিকার দক্ষতায় কবিতা লেখা যায়, তবে সে কবিতা, এই আধুনিক কবিতার যুগেও গ্রহনযোগ্য, শ্রেয় হতে পারে নির্দ্বিধায়।
কবি, তার কবিতাটি বিবিধ কবিতা বিষয়শ্রেণী করেছেন। প্রকৃতপক্ষে কবিতাটি মানবতাবাদী, জীবনে-বৈষম্যগত দুঃখবোধ এবং প্রতিবাদী কবিতার সংমিশ্রণ। কবিতাটিতে আমার পাঠ প্রতিক্রিয়া মন্তব্যই যথেষ্ট, আবারাে তা প্রমাণ করার জন্য যে, যদি আপনি সাধু ভাষ্যে কবিতা উপভোগ. উপলব্ধি, অনুভব করার ক্ষমতা রাখেন, তাহলে আপনি আমার মতো এভাবেই মুগ্ধতা প্রকাশ করবেন, "কবি, তোমার কি কোনো মাইকেল মধুসূদন এর কাব্যের মতো গুপ্ত আশ্চর্য শব্দের জলাধার আছে! যেখানে ডুব দিয়ে এমন মোহময় শব্দের কবিতা লেখো! আমাকে তো সাংঘাতিক মুগ্ধতার জোয়ারে ভাসিয়ে নেয় এমন শব্দাবলীর চিত্রকল্প, অনুভব!"
আদালত প্রাঙ্গনে একজন বিচার বঞ্চিত নারীর করুণ পরিস্থিতি নিয়ে কবিতার মূল ভাব। কবি, কবিতাটি উৎসর্গ করেছেন মমতাময়ী মা শ্রীচরণেষু ইন্দিরা দেবী নামের একজন মহিলাকে, যতদূর বুঝতে পারি ইনিই হতে পারেন সে আদালত কর্তৃক অনাদর অবজ্ঞা অবহেলার শিকার। তবে নিশ্চিত নই।
কবিতার প্রথম স্তবক পড়ুন:
সেদিন কোর্ট পাড়ায় -
দৃষ্ট ধূলি-মলিন ধূসর ছেঁড়া বসন কায়,
এক অধবা প্রৌঢ়া নারী উদবেগ-নেত্র চঞ্চলা
সিঁদূর শূন্য টেড়ি, হাতে নাই শাঁখা-পলা।
একে একে পঁচিশটি বসন্ত অতিক্রান্তে এই পতিহারা রমনী,
আজো পেলোনা সুরাহা শুধু শুনানির পর শুনানি।
যার এক চোখে সুবিচারে আকুল অনুরোধ,
আর চোখে সংবৃত ক্লিষ্ট ব্যাথা সঞ্চিত ক্রোধ।
তবু অপেক্ষায় ন্যায়ালয়ের অলিন্দে অনির্ভর নয়ন;
ধর্মাবতার! ধর্মাবতার বলে বুকে উঠে মন্দ্রিত গর্জন।
কী অনন্য সাধু ভাষার কাব্য-শব্দ ব্যঞ্জনা! পাঠ-মাত্রই মনে তোলে সহানুভূতির নিখাদ আলোড়ন, মন-হৃদয় হয় বিষাদগ্রস্থ এবং একিসাথে কবিতার পাঠসুখে হতে হয় ভরপুর! প্রথম স্তবক পড়ে সেই অধবার চিত্রকল্প বিছিয়ে দেয় বিষাদের চাদর পাঠকের সমগ্র সত্তায়! আর "ধর্মাবতার! ধর্মাবতার" দু'বার উচ্চারণ, মর্মে বইয়ে দেয় অসহায় করুণ এক বেদনার স্রোত! কবি মুরাদের সাধু ভাষার শব্দ দক্ষতা এবং দ্যোতনার দিকে দৃষ্টিপাত করুন - বসন কায়, নেত্র চঞ্চলা, শাঁখা-পলা সংবৃত ক্লিষ্ট, ক্রুতু আরতি, উদ্বন্ধন-রশি, জরতি, পাষাণ পুঞ্জে ঝুলন্ত, অন্ধকার শ্যামঘন, উদ্দিষ্টে সত্য-সূর্যের তেজস্কর কিরণ, ন্যায়াধীশ, কে জ্বালে সত্য-দীপ্র, সত্যপূজারীরা সত্যব্রতা আর আজ সত্যের যজ্ঞে মিথ্যার জয় সত্যের মহাপ্রয়াণ। "সত্যের মহাপ্রয়াণ" একেবারে ক্লাসিক মাইকেল মধুসূদন বা রাবিন্দ্রীক নামকরণ!
এবার, প্রথম স্তবকের চিত্রকল্পটির নির্মাণ, আমাদের আধুনিক কথার ভাষায় পরিবর্তন করে চিন্তা করুন তো? এই অনন্য সাধু ভাষার গাম্ভীর্য, সৌন্দর্য কি থাকবে? একধরনের দারুণ রহস্যময়তা কি থাকবে? নস্যাত হবে সুনিশ্চিত। আমি বলছি এটা পাঠ করে যখন পরিবর্তন চিন্তা করবেন তার কথা, অর্থাৎ কথ্য ভাষার কোনো কবির দক্ষ হাতে অনন্য হবে না, তা কিন্তু বলছি না। তবে এই ঐশ্বর্য আর থাকবে না।
এবার পাঠ রুচি বিষয়ক বিপরীত চিত্রটি অঙ্কন করি আলোচ্য কবিকে দিয়েই। আমি যখন তাকে কবিতা আসরে আবিষ্কার করে শুধু মুগ্ধ হচ্ছি, তখন দেখছি অন্য কেউ তার কবিতা পাঠ করছে না। সেও অন্যদের কবিতা পড়ছে না। আমার স্নেহে সে শুধু আমার কবিতা কষ্ট করে গলাধঃকরণ করছে। তখন তাকে জিজ্ঞাসা করায় উত্তর দিলো এরকম, "আপনার পরামর্শ অনুযায়ী আসরে নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু বারবার বিদায় নিতে হচ্ছে নিদারুণ ব্যথিত হৃদয়ে। আমি সুন্দরের অবমাননা সহ্য করতে পারিনা আর কবিতা সুন্দরের প্রকাশ! সুন্দর প্রতীক কবিতার শরীরে যে ক্ষত হালে সৃষ্টি হয়েছে, তা মেনে নিতে পারছিনা কবি । আমি শুধু ব্যথাতুর চোখে চেয়ে রই অসহায়ের মত।" এই হলো তার নিজস্ব রুচির বৃত্তাবদ্ধতা!
এটি শোনার পরে তাকে উপদেশ দেই, তখন তাকে আপনি বলতাম এখন অনুজ ভালোবাসায় তুমি বলি, "আপনার মতো কবিতা অনেকেই লিখবে না! কিন্তু একবার ভাবুন তো কবি, আমার তো আপনার মতো লেখার ক্ষমতা এক বিন্দুও নাই, তাহলে কিভাবে আমি এত ভালোবাসি আপনার কবিতা! এই তাহলের উত্তরটি হলো, কবিতার আঙ্গিক একরকম হয় না, হাজার রকমের হয়, একজন কবি নিজের যা ভালো লাগবে তাই লিখবে, কিন্তু তার ক্ষমতা থাকতে হবে সবার সবরকমের কবিতা পড়ার!"
"সত্যের মহাপ্রয়াণ" কবির কবিতা কর্মের এক ঐশ্বর্যময় কবিতা হয়ে থাকবে আমার মতে, নিচের লিংক দিয়ে সম্পূর্ণ কবিতাটির পাঠরস উপভোগ করুন। কবি ইমামুল ইসলাম মুরাদ এবং কবির দাম্পত্য সঙ্গী আসরের সদস্য মিসেস হুমায়রা কোরেশী শাপলা কে অশেষ শুভেচ্ছা ও আন্তরিক দোয়া।
বিশেষ সংযুক্তিঃ মনে হতে পারে, আমি কবি ইমামুল ইসলাম মুরাদ কে খাঁটি সাধু ভাষায় কবিতা রচনার চর্চাকারী রূপে উল্লেখ করেছি। প্রকৃতপক্ষে তিনি তা নন। তবে আমরা যারা প্রমিত শুদ্ধ চলিত অথবা কথ্য ভাষায় কবিতা চর্চা করি, তাদের কাছে তার কবিতা কর্ম সাধু ভাষা বলেই অনুভূত হবে। কবি ইমামুল ইসলাম মুরাদ এর মূল কবিতা কাঠামো প্রমিত শুদ্ধ চলিত, তিনি তার সাথে সাধু ভাষার অনন্য ব্যঞ্জনাময় শব্দগুলো দক্ষ আলংকারিকের মতাে সেই প্রমিত চলিত মূল কাঠামোর ওপর বসিয়ে দারুন এক সংমিশ্রণ ঘটান। যা দূষণীয় হয়ে তো ওঠেই না, বরং হয়ে ওঠে হৃদয়গ্রাহী এবং চমৎকার দ্যোতনাময়। সুতরাং তাকে সম্পূর্ণ সাধু ভাষার বা পুরাতন কালের মহান কবিদের মতো সনাক্ত সংজ্ঞায়িত করেছি এরকম বোধ হলে অন্যায় হবে। সুতরাং তার কবিতা কাঠামো অনুসারে কবি ইমামুল ইসলাম মুরাদ আধুনিক কালের কবিদের মাঝে নিজ মর্যাদায় অবস্থান করার শতভাগ অধিকার সংরক্ষণ করেন। আলোচ্য কবি এবং পাঠকদের আবারো শুভেচ্ছা এবং ধন্যবাদ।