বিষয় : বৈষ্ণব কবিতা
‘সত্য করে কহো মোরে হে বৈষ্ণব কবি
কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি?’
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিশ্বসাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলী অতুলনীয়। বাংলা তথা ভারতীয় সংস্কৃতি ও ভারতীয় দর্শনের সূক্ষাতিসূক্ষ ভাব ও বিষয়গুলি অপরিসীম সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়ে বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যকে দান করেছে পরম আশ্চর্য অনন্যতা । পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচশ বছর ধরে নিয়মিত ভাবে শত শত কবি কেবলমাত্র একটি বিষয় নিয়ে হাজার হাজার কবিতা ও কাব্য রচনা করেছেন - এরূপ নিদর্শন তৎকালীন বাংলা তথা ভারতবর্ষ ছাড়া সমগ্র বিশ্বে আর কোথাও নেই।
বৈষ্ণব কবিরা একই সঙ্গে ছিলেন সাধক ও কবি। চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি,জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস,যাদবেন্দ্র,রাধামোহন ঠাকুর প্রমুখ সকল মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব কবির সম্পর্কেই একথা প্রযোজ্য। স্রষ্টা হিসেবে তাঁরা ঈশ্বর ও ঐশীভাবকে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন সংসার আঙ্গিনার মধ্যেই। তাই তাঁরা ঈশ্বর ও ঐশীভাবকে কখনো খুঁজেছেন মাতা - পিতা ও সন্তানের সম্পর্কের মধ্যে , কখনো ঈশ্বর ও ঐশীভাবকে খুঁজেছেন পারস্পরিক বন্ধুত্বের মধ্যে, কখনো ঈশ্বর ও ঐশীভাবকে খুঁজেছেন গৃহ কর্তা ও গৃহকর্মীর মধ্যে, আবার কখনোবা ঈশ্বর ও ঐশীভাবকে খুঁজেছেন পতি-পত্নী সম্পর্কের মধ্যে। আর জীবনের সৃষ্টিশীলতাকেও তাঁরা কখনো ঈশ্বরবিমুখ হিসেবে ভাবতে পারেননি। তাই ঈশ্বর ভক্তি আর জীবনপ্রেম মিলে মিশে তাঁদের রচিত পদাবলী সাহিত্যে সঞ্চার করেছে আদর্শ গৃহজীবন ও সাধনাক্ষেত্রের মহামিলন বার্তা। এই পর্যালোচনাটি যেকোনো বাঙ্গালী তথা ভারতীয়ের কাছেই শ্লাঘার বিষয় রূপে গণ্য হতে পারে। একদিন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে আমার মনেও প্রবাহিত হয়েছিল অনুরূপ অনুভূতি। আজও তার অনুরণন হয়।
আমরা জানি, বিশ শতকেও বৈষ্ণব কবিতা লেখা হয়েছে । একুশ শতকেও মাঝে মধ্যে বৈষ্ণব কবিতা অথবা বৈষ্ণব ভাব ও বিষয় নির্ভর কবিতা চোখে পড়ে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সেবকরা যদি মনে করেন তাহলে বৈষ্ণব কবিতা রচনার ধারাটিকে আরো দীর্ঘ করতে পারেন; এইকথা ভেবে যে - অনেক দূর ভবিষ্যতে হয়ত এমন একদিন আসবে, হয়ত হাজার বছর পরের কোনো ছাত্র যেদিন একুশ শতকের বাংলা সাহিত্যকে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য হিসেবেই বিচার করবে, সেদিন বৈষ্ণব কবিতাকেও আবার নতুন ভাবে নতুন চোখে বিচার করবার চেষ্টা করা হবে। সেই দিনটির কথা ভেবে আমরা , বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শ্রমিক বা সেবক রূপে আমাদের পুরনো গর্বের ক্ষেত্রগুলিকে আরো গৌরবময় করে তুলবার চেষ্টা করতে পারি।
।। ।। ।। ।। ।।