‘পার’ ও ‘পাড়’ অনেক সময় একই অর্থ বোঝালেও প্রায়োগিক ধরন ভিন্ন। নদী, সমুদ্র ইত্যাদির তীর বোঝাতে পার কিন্তু পুকুর, দিঘি, সরোবর ইত্যাদির ‘তীর’ অর্থে পাড় ব্যবহার করা হয়। আবার ‘পার’ অর্থ নদীর বিপরীত তীর (নদীর এ-পার ও-পার)। নিষ্কৃতি (পার পাওয়া) অর্থেও ‘পার’ ব্যবহৃত হয়। যেমন: অনেক কষ্টে বিপদ থেকে পার পাওয়া গেল। আবার প্রান্তদেশ(শাড়ির পাড়) বোঝাতেও ‘পাড়’ ব্যবহৃত হয়। তবে বৃহৎ সাধারণত বৃহৎ জলাশয়ের তীর ‘পার’ কিন্তু ছোট জলাশয়ের তীর হচ্ছে ‘পাড়’। যেমন: নদীর পার, সাগরের পার কিন্তু পুকুরের পাড়। আসলে কী এ ব্যাখ্য যথার্থ?
পার সংস্কৃত শব্দ। পার বলতে বোঝায় নদীর বিপরীত তীর বা কূল। এছাড়াও শব্দটি আরও বিভিন্ন অর্থ প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। যখন বলা হয়, ‘গগন পারে সূর্য হাসে’; তখন এর অর্থ প্রান্তভাগ। যখন বলা হয়, ‘মাঠের পারে মাঠ, তার পারে হাট’; তখন পার অর্থ বোঝায় সীমানা। যদি বলা হয়, ‘কৌশলটা কাজে লাগলে পার পাওয়া যাবে’; এখানে পার অর্থ প্রতিকার পাওয়া। আবার নিষ্কৃতি, উদ্ধার ,রেহাই প্রভৃতি অর্থেও পার লেখা হয়। যেমন: ‘দয়াল পার কর আমারে।’ এখানে পার অর্থ পরিত্রাণ। ‘সপ্ততল ভেদ করি বাণ হল পার, শত্রুরা কম্পমান, রেহাই নাহি আর।’ এখানে ‘পার’ বলতে এক পাশ ভেদ করে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে যাওয়া। উত্তীর্ণ হওয়া অর্থেও ‘পার’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। যেমন: ‘পরীক্ষার কঠিন বৈতরণী কোনও প্রকারে পার করলাম।’ নিষ্কৃতি অর্থেও ‘পার’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন: ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা।’
‘পাড়’ শব্দের আভিধানিক অর্থ নদীর তীর, প্রান্ত, তট বা কূল, উঁচু জায়গা। সংস্কৃত পার, পাট বা পাটক থেকে শব্দটির উৎপত্তি। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, পুকুর, জলায়শ বা কুয়োর চারিপাশের বেষ্টনী, ক্ষেতের আল প্রভৃতি হচ্ছে ‘পাড়’। পরিধেয় বস্ত্রের প্রান্তভাগ বোঝাতেও ‘পাড়’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। এ ‘পাড়’ শব্দটির উৎস সংস্কৃত ‘পট্টি’ থেকে। আবার পায়ের চাপ দেওয়াও পাড়; যেমন ঢেঁকিতে পাড়। পায়ের ‘পাড়’ এসেছে সংস্কৃত ‘পাত্’ ধাতু থেকে।
অভিধান অনুসারে নদীর বিপরীত তীর হচ্ছে পার। তাহলে অন্য তীড় পাড়। যদি কেউ বলেন, মমিন নদীর পার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, এর অর্থ মমিন নদীর ওপার দিয়ে হেটে যাচ্ছে। আবার যদি বলা হয়, মমিন নদীর পাড় দিয়ে হেটে যাচ্ছে, অর্থ হয় মমিন নদীর এপার দিয়ে হেটে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলায় ‘পার’ ও ‘পাড়’ শব্দ দুটো এ অর্থে ব্যবহার হয় না। লেখা হয়, এপার থেকে ওপার যাব, কেউ লেখে না এপাড় থেকে ওপার যাব। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। ওপরের আলোচনা হতে এটি প্রতীয়মান হল : নদী বা জলরাশির তীর বোঝাতে ‘পার’ ও ‘পাড়’ শব্দের যে অর্থ দেওয়া হয়েছে তা অস্পষ্ট।