উন্মেষ-র চতুষ্টয়ী

ইন্দু সাহা কবি, গীতিকার, ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার)
মতিন বৈরাগী (কবি)
কাজী মনজুর (কবি)
মহসিন শস্ত্রপাণি (কবি, প্রাবিন্ধিক, গল্পকার ও নাট্যকার)

ইন্দু সাহা রাজনৈতিক দর্শনের কারণে ১৯৬৮ সালে জেল খেটে পরে দেশান্তরিত হয়েছিলেন সত্তর দশকে, কোলকাতায় ঘাঁটি গাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। বাংলাদেশে আর স্থায়ী ভাবে ফিরে আসতে পারেননি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার লেখা গান প্রেরণা দিয়েছে সাম্যবাদী মুক্তিযোদ্ধাদের। প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় কোলকাতায় প্রয়াত হন ২০২১ সালে, করোনা চলাকালে। তার লেখা বইয়ের সংখ্যা দেড়শতাধিক। তাঁর উপন্যাস নিয়ে সিনেমা হয়েছে। গান লিখেছিলেন তিনহাজারের বেশি।
মহসিন শস্ত্রপাণি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে হঠাৎ প্রয়াত হন তাঁর প্রাণের শহর যশোরে ২০১৯ সালে। তাঁর বইয়ের সংখ্যা পয়ত্রিশের বেশি। ফুলবাড়ি আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন।
মতিন বৈরাগী এখনো সক্রিয় ভাবে লিখে চলেছেন সরল ছন্দে। তার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ২০ এর অধিক।
কাজী মনজুর লেখালেখি ছেড়েছেন বহু আগে, নিভৃতে নীরবে থাকেন।
এক জায়গায় চারজনের দারুন মিল। এঁরা চারজনই জনগণতন্ত্রের জন্য লিখেছেন, কাজ করেছেন, সমাজ বদলের কথা বলেছেন ও কাজের মধ্যে দিয়ে করার চেষ্টা করেছেন, শ্রমজীবি মানুষের জন্য কখনো কলম দিয়ে এবং প্রয়োজনে মাঠে ময়দানে লড়াইয়ে সামিল হয়ে। এদের মধ্যে ইন্দু সাহা ও মহসিন শস্ত্রপাণি বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে। পার্টির নির্দেশে প্রগতিশীল কিন্তু কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট নন এমন বহু সাংস্কৃতিক কর্মীদের সংঘবদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে। ক্রান্তি সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরিতে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছেন। পরবর্তীতে সাম্যবাদী দর্শনের উন্মেষ সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ তৈরি করেছেন পূর্ববাংলা প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে আরো শক্তিশালি করার জন্য। আয়ুব স্বৈরশাসনের চরম নিপীড়নের দিনে ১৯৬৮ সালে যখন সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে গিয়েছিলো তখন অকুতোভয় গেরিলা কায়দায় আয়ুববিরোধী মিছিল করেছিলেন গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত যা পরে হাজার মানুষের মিছিলে পরিণত হয়েছিলো। কম্যুনিস্ট পার্টি পূর্ববাংলায় যখন কম্যুনিস্ট আন্দোলন বেগবান করার প্রক্রিয়া ও নীতি নিয়ে দ্বিধা বিভক্ত হয় তখন ইন্দু সাহা ও মহসিন শস্ত্রপাণি সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষের অংশে যোগ দেন এবং আজীবন বিশ্বাস করেছেন যে জনগণকে সম্পৃক্ত করে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই সাম্যবাদী জনগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তারা পূর্ববাংলার তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা কবিতা, গান ও নাটকে খোলা মঞ্চে বলা শুরু করেন সেই ১৯৭০ সালেই, মওলানা ভাসানী-র লালটুপি সম্মেলনে স্বাধীনতার ডাক দেবার সময় থেকে যখন অন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মূল চাওয়া ছিলো পূর্ববাংলার স্বায়ত্বশাসন ও রাজনৈতিক ক্ষমতা। এরা আরো বিশ্বাস করতেন যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছাড়া রাজনৈতিক আন্দোলন কখনোই পুরোপুরি সফল হয় না এবং প্রগতিশীল পরিবর্তন টেকসই হয় না আর সে জন্য কাজ করা ও ক্রমাগত ভাবে সাম্যবাদী চেতনার সাংস্কৃতিক কর্মী, কবি, সাহিত্যিকদের সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে গ্যাছেন আমৃত্যু।
মতিন বৈরাগী ও কাজী মনজুর উন্মেষ-র প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পরেই এবং এখনো আছেন। এদের সাথে (ছবিতে নেই) উল্লেখযোগ্য কবি সমুদ্র গুপ্ত, কবি মুনীর সিরাজ। সমুদ্র গুপ্ত প্রয়াত হন ২০০৮ এ। মুনীর সিরাজ ও মতিন বৈরাগী এখনো বাংলাদেশের ও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। মুনীর সিরাজের বইয়ের সংখ্যা ২০ এর অধিক। বিভিন্ন সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হলেও তাঁদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাবার কোন সম্ভাবনা নেই রাজনৈতিক দর্শন এবং তোষামোদ-বিবর্জিত ব্যক্তিত্বের কারণে।