৪৭ থেকে তিন দশক বাংলাদেশের কবিতার ধারা
=================================

  ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর গভীরতর রক্তক্ষরণ ও স্বপ্নভঙ্গের পটভূমিতেই সংঘটিত হয় ১৯৫২ র ভাষা-আন্দোলন। ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ক্ষুব্ধ, অগ্নিগর্ভ সমাজসত্তার শিল্পিত আত্মপ্রকাশের পথ সুপ্রশস্ত হয়। দেশবিভাগের পর নতুন কবিতা (১৯৫০) নামে যে-সংকলন প্রকাশিত হয়,  অনেক কবিই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের কবিতার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। এ-সময়ের কবিদের মধ্যে শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুলস্নাহ, আল মাহমুদ প্রমুখের কবিতায় ভাষা-আন্দোলন বড় ধরনের পালাবদলের সূত্রপাত করেছে। ভাষা-আন্দোলনের বাস্তব অভিঘাত একজন কবির চৈতন্যে কতটা আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে শামসুর রাহমানের একটি কবিতা থেকে আমরা তা উপলব্ধি করতে পারি :

আমরা যখন ঘড়ির দুটো কাঁটার মতো
মিলি রাতের গভীর যামে,
তখন জানি ইতিহাসের ঘুরছে কাঁটা
পড়েছে বোমা ভিয়েতনামে।
(শামসুর রাহমান)

হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদের কাব্যরীতি ও কাব্যভাষা বাংলা কবিতার নতুন উৎসমুখ খুলে দেয়। হাসান হাফিজুর রহমান তাঁর সেই বিখ্যাত ‘অমর একুশে’র আনুভূমিক ও ভাষণধর্মী কাব্যপঙক্তিমালায় উচ্চারণ করেন :

এখানে আমরা ফ্যারাউনের আয়ুর শেষ ক’টি বছরের
ঔদ্ধত্যের মুখোমুখী,
এখানে আমরা পৃথিবীর শেষ দ্বৈরথে দাঁড়িয়ে
দেশ আমার, সত্মব্ধ অথবা কলকণ্ঠ এই দ্বন্দ্বের সীমামেত্ম এসে
মায়ের সেণহের পক্ষ থেকে কোটি কণ্ঠ চৌচির করে দিয়েছি :
এবার আমরা তোমার।
(হাসান হাফিজুর রহমান ‘অমর একুশে’)

এই স্বদেশ ও জীবনলগ্নতা কেবল বাংলাদেশের নয়, সমগ্র বাংলা কবিতার পটভূমিতেই এক স্বতন্ত্র চেতনায় বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে। কবিতায় ভাবালুতার পরিবর্তে প্রাধান্য পেলো মননশীলতা, নিঃসঙ্গ একাকী জেগে উঠলো আত্মবিশ্বাস ও সংগ্রামের রক্তিম চেতনাগুচ্ছ। ১৯৫২ থেকে ১৯৭০ কালপর্ব বাংলাদেশের কবিতার আত্মসংস্থিত হওয়ার কাল। কেননা, এ-সময়ে কবিরা সামাজিক-রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও সংক্ষোভকে যেমন কবিতায় রূপায়িত করেছেন, ব্যক্তি সত্তাবিকাশের বহুমুখী সম্ভাবনা নিয়েও তেমনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। যুদ্ধোত্তরকালের নবোদ্ভূত কবিদের রক্তিম জীবনাবেগ, সদ্য স্বাধীন দেশের বাসত্মবতায় সীমাতিরিক্ত প্রত্যাশা ও অবশ্যম্ভাবী ব্যর্থতাবোধ, প্রেম ও নিসর্গভাবনায় প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা প্রভৃতি একটা সামাজিক রূপ লাভ করে। ষাটের দশকের অনেক কবি স্ব-উদ্ভাবিত পরিণত  আঙ্গিকে অভিন্ন কাব্যবস্তুকেই যেন প্রকাশ করলেন। পঞ্চাশের দশকের শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী এবং ষাটের দশকের অধিকাংশ কবিই নিজস্ব
কাব্য-অবয়বে সমকালের চেতনা ধারণ করলেন। ষাটের দশকের শেষদিকে আবির্ভূত বেশ কয়েকজন কবি এ-সময়ে আত্মপ্রকাশের তীব্রতায়, ব্যক্তি ও সমষ্টির নির্বাধ আবেগজীবন উন্মোচনের ঐকামিত্মকতায় এবং দেশপ্রেমের রক্তিম কাব্যকলা সৃষ্টিতে যথেষ্ট আলোড়ন তুলতে সমর্থ হন। ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে সিকদার আমিনুল হক, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আসাদ চৌধুরী, মোহাম্মদ রফিক, মাহমুদ আল জামান, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু  গুণ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, আবুল হাসান, হুমায়ুন আজাদ, সাজ্জাদ কাদির প্রমুখ কবি পঞ্চাশের  দশকের কবিতার বিপ্রতীপ এক নতুন ধারার সৃষ্টি করলেন। পঞ্চাশের কবিরা যেখানে সমকালীন জীবনাবেগ রূপায়ণের প্রতি ঐকাত্মিক এবং সমাজ ও সমষ্টি-সংলগ্ন, সেখানে ষাটের দশকে উদ্ভূত কবিরা সমকালের আন্দোলন -সংঘাত-রক্তপাত ও উজ্জীবনের পটভূমিতে  বিস্ময়করভাবে বহির্জগৎ-বিমুখ, আত্মমগ্ন । মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে যে-সকল নতুন কবি আবির্ভূত হলেন, দ্বিধাহীন আত্মপ্রকাশ-আকাঙ্ক্ষা, সমাজ ও রাষ্ট্রের বস্ত্তগত পটপরিবর্তনের সুখবোধ এবং  আনন্দানুভূতি অনেকের স্বপ্নলোককেই করে তুললো বস্তুসম্পর্ক রহিত। প্রেম ও সংগ্রামের দ্বৈরথ অগ্রজদের কারো কারো মতো এঁদেরকে আলোড়িত করেনি। বরং যুদ্ধোত্তর কয়েক বছরের মধ্যে জাতীয় জীবনের বিপর্যয়, মুক্তিযুদ্ধ-অর্জিত চেতনার ক্রমবিলীয়মান রূপ, পাকিস্তানি   আমলের পরাজিত দৃষ্টিভঙ্গির পুনরুত্থান, সেনাতন্ত্রের বিকৃত মুখচ্ছবি, গণতন্ত্রের পরিবর্তে  স্বৈরতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, পরাজিত সাম্প্রদায়িকতার পুনর্জীবনচেষ্টা এবং সংবিধানের মূলস্তম্ভগুলোর অপসারণ জাতীয় চৈতন্যকে নিক্ষেপ করে গভীর অন্ধকার ও অনিশ্চয়তা গহ্বরে। এই  পরিস্থিতিতে সংবেদনশীল কবি চৈতন্যের যে প্রতিক্রিয়া, সমাজ ও সময়ের স্বর অনুধাবনে তার তাৎপর্য অপরিসীম।  
মুক্তিযুদ্ধের পর চল্লিশ, পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের কবিরা আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব কাব্যবস্তুর সন্ধান পেলেন।  এ-সময়ে কবিতা চর্চায় সক্রিয় আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান এবং সানাউল হকের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ নতুন বোধের উৎসমুখ হয়ে উঠেছে।
যেমন –
১. কোথাও পড়ে না চোখে বধ্যভূমি, অথচ প্রত্যহ
নিহতের সংখ্যা বাড়ে। কোথাও একটিও
লাশ কিংবা কবর পড়ে না চোখে, অথচ প্রত্যহ
শবাধার ব্যস্ত হয়ে হেঁটে যায় এবাড়ি ওবাড়ি।
(আহসান হাবীব)

২. অনেক শেখানো অনেক পড়ানো
বহু পুরুষের মর্চে ধরানো
ভাগ্যটার
ঝুঁটি ধরে নাড়া দেবার সময়
এসেছে এবার…
(আবুল হোসেন)

৩. আমার মনে হয়
সমুদ্রের সামনে যুগযুগান্তের সাক্ষ্য বিদ্যমান –
মহাকালকে এখানে অনুধাবন করা যায় একটি
প্রার্থনার কাম্যে।
(সৈয়দ আলী আহসান)

৪. নক্ষত্রের আলো
মুক্তিসেনা চিতার শরীর, বাংলার ন’মাসী উন্মেষ
কখনো কাতর; অকাতর রক্তক্ষরা ধাবমান তরী,
অশোচ আতুর ঘরে সর্ষে ঝাঁঝ, রুদ্ধদ্বার ছায়াকালো :
সেখানে আমার জন্ম – কী আনন্দ স্বাধীন বাংলাদেশ। (সানাউল হক )  

উল্লিখিত উদ্ধৃতিগুচ্ছ পরিণত অভিজ্ঞতাও গভীরতর আবেগ ধর্মের সাক্ষ্যবাহী। অবশ্য যুদ্ধকালীন সক্রিয়তা বা নিষ্ক্রিয়তাও অনেক ক্ষেত্রে কবিদের আবেগ-মননের চারিত্র্য নির্দেশ করেছে।   শামসুর রাহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, হাসান হাফিজুর রহমান, আজীজুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, মোহম্মদ মনিরুজ্জামান, আল মাহমুদ, আবু হেনা মোস্তাফা কামাল, ফজল শাহাবুদ্দীন, জিয়া হায়দার,  আবুবকর সিদ্দিক, শহীদ কাদরী প্রমুখ যুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর জীবন সমগ্রতার অঙ্গীকারকে বিচিত্রভাবে প্রকাশ করেছেন। সংগত কারণেই জীবন চেতনা ও শিল্পাদর্শের প্রশ্নে এঁরা সকলেই স্বনির্মিত কাব্যাদর্শের বৃত্তেই আবর্তিত হয়েছেন।
যেমন –
১) বন্দী, তুমি এখনও ভুলতে পারছ না
কী অমর্তহীন এই বন্দী দশা,
বন্দী, সেই থেকে তোমার ঘুম পলাতক
যদিও মুক্তিসেনারা এসেছিল
একদিন
(জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী)  

২. এবার মোছাব মুখ তোমার আপন পতাকায়।
হাজার বছরের বেদনা থেকে জন্ম নিল
রক্তিম সূর্যের অধিকারী যে শ্যামকান্ত ফুল
নিঃশঙ্ক হাওয়ায় আজ ওড়ে, দুঃখভোলানিয়া গান গায়।
মোছাব তোমার মুখ আজ সেই গাঢ় পতাকায়।
(হাসান হাফিজুর রহমান)

৩. একটি কবিতা একজন কবির হৃৎপিন্ড চিবিয়ে খাচ্ছে
রক্ত
একটি স্বপ্ন একজন প্রেমিকের চোখ উপড়ে নিচ্ছে রক্ত
রক্ত
রক্ত রক্ত রক্ত
উন্মোচিত জরায়ুতে কি এতো রক্ত থাকে?
(আজীজুল হক)

৪. শুভঙ্কর কোথায় জন্মেছিলো?
নিশ্চয় প্রাচ্যভূমি
সেখানে জীবনটা
আয়নার উল্টোপিঠ;
এবং ইতিহাস দস্যুর উপাখ্যান।
(আলাউদ্দিন আল আজাদ)

৫. যখন তিরিশ লক্ষ মানুষের রক্তে প্রবহমান আমার স্মৃতি,
এখনো তো আমার স্মৃতি;
যখন তিন কোটি মানুষের গৃহত্যাগে বিলীয়মান আমার সভ্যতা
এখনো তো আমার সভ্যতা;
যখন বলীবর্দের দ্বিখন্ডিত খুরে কম্পমান আমার স্বপ্ন,
প্রিয় ব্রহ্মপুত্র, এখনো তো আমার স্বপ্ন।
(সৈয়দ শামসুল হক)


এই তো আমার মুখ ভাইসব, এই তো আমার মুখ!
আমার মুখচ্ছবির মধ্যে এই তো চারজন যুবক প্রবেশ করলো।
কচুরিপানার শিকড়ের মত কালো উজ্জ্বল দাড়ি। দুমড়ানো
পোশাক। যারা সর্বশেষ আহবানে হৃদয়ের ভেতর
অস্ত্র জমা রেখেছে। এখন আমার মুখের ভেতর তাদের
গুপ্ত অধিবেশন। যে অতর্কিতে
শহরগুলোকে দখল করা হবে
আমার মুখ তারি রক্তাক্ত পরিকল্পনা।
(আল মাহমুদ)

৭. মধ্য-দুপুরে, ধ্বংসস্তুপের মধ্যে, একটা তন্ময় বালক
কাঁচ, লোহা, টুকরা ইট, বিদীর্ণ কড়ি-কাঠ,
একফালি টিন,
ছেঁড়া চট, জংধরা পেরেক জড়ো করলো এক নিপুণ
ঐন্দ্রজালিকের মতো যতো
এবং অসতর্ক হাতে কারফিউ শুরু হওয়ার আগেই
প্রায় অন্যমনস্কভাবে তৈরী করলো কয়েকটা অক্ষর
‘স্বা-ধী-ন-তা’।
(শহীদ কাদরী)

উদ্ধৃত কবিতাংশগুলো বাংলা কবিতার ধারায় বিষয় ও প্রকরণে কেবল নতুন মাত্রাই যুক্ত করেনি, বাঙালির বাস্তব-অভিজ্ঞতা ও অস্তিত্ব জিজ্ঞাসার ক্ষেত্রে যুগান্তরের ইঙ্গিত বহন করছে।  জীবনাভিজ্ঞতা ও বোধের তীব্রতায় এ-সময়ের কবিতা অপরিমেয় গতি, ব্যাপ্তি ও গভীরতা পেয়েছে। যুদ্ধোত্তর জীবনে সমাজ ও ব্যক্তি মানুষের অনিশ্চয়তা, অবক্ষয় ও নৈরাশ্য কবিমনকে পীড়িত করলেও পলায়নের পরিবর্তে দুঃখ, যন্ত্রণা ও রক্তিম স্মৃতি-আক্রামত্ম বাস্তব বিশ্বকেই গ্রহণ করলেন কবিরা। এসব কবির অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বাংলা কবিতার পালাবদলে মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী অবদানের রূপ ও স্বরূপ এঁদের কবিতা পাঠে অনুধাবন করা যায়।  
এই সংরক্ত চেতনাবাহী কবিদের মধ্যে রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, মহাদেব সাহা, বেলাল চৌধুরী, আসাদ চৌধুরী, মোহাম্মদ রফিক, আবুল হাসান, হায়াৎ মামুদ, শামসুল ইসলাম, সিকদার আমিনুল হক, আহমদ ছফা, মাহমুদ আল জামান, আবু কায়সার, হুমায়ুন কবির, মুহম্মদ নূরুল হুদা, হুমায়ুন আজাদ, মাহবুব সাদিক, অসীম সাহা, অরুনাভ সরকার, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, কাজী রোজী, জাহিদুল হক, সাজ্জাদ কাদির, সানাউল হক খান, হেলাল হাফিজ প্রমুখ উলেস্নখযোগ্য। কয়েকটি দৃষ্টান্ত সহযোগ উল্লেখিত কবিদের বোধ ও রূপসৃষ্টির অনন্যতা সন্ধান করা যেতে পারে :
১. কিন্তু শেষ নয় হে মাতৃভূমি
এই ধর্ষিত দেশ থাকবে না অনাসক্ত
আর স্থির আতপ্ত বাতাসে। নেকড়ের মুখ থেকে
একটি হরিণছানাও অতর্কিতে মুক্ত হয়ে যায় শুনেছি
দেশও হবে –
আমার বাংলাদেশ। (সিকদার আমিনুল হক)

২. আমার অনেক কিছুই নেই –
কিন্তু তাতে আমার কিছু এসে যায় না
আমার কোনো অভাবও নেই
কারণ আমার একটি সুন্দর পতাকা আছে,
এখন আমার শুধু একটি আগ্নেয়াস্ত্র চাই,
আর কিছু নয়।
(রফিক আজাদ)

৩. নারকেল সবুজ পাতার বালির ঢাকা চাঁদেও সোনালি কামান
নিঃশব্দ ওঙ্কারে গর্জে উঠে তুমুল জ্যোৎস্না ছুঁড়ে মারে
এই চলে সারা রাত
জ্যোৎস্নায় তমসায় বাদানুবাদ
গৃহযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধে রূপামত্মরিত হয়ে যায়।
(আবদুল মান্নান সৈয়দ)

৪. পৃথিবীর ইতিহাস থেকে কলঙ্কিত পৃষ্ঠাগুলো রেখে
চ’লে আসি ক্যানাডার বিশাল মিছিলে শেষগান শোনাতে।
মানুষের জয় হোক, নিপীড়িত জনগণ জয়ী হোক অমিত্মম
সমরে।
অসত্যের অন্যায়ের পরাজয়ে খুশি হোক বিশ্বের বিবেক,
পলাতক শামিত্ম যেন ফিরে আসে আহত বাংলার ঘরে ঘরে। (আসাদ চৌধুরী)

৫. বাংলার আকাশ জুড়ে মূক ও বধির
মুখ থুবড়ে পড়ে আছে পূর্ণিমার চাঁদ, এতো বেশী –
রক্তপাতে, রক্তহীন
… … …
ঘরে ঘরে লক্ষ কোটি মানুষের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস
অগ্নিময় ঝরে পড়ে রক্তফোঁটা, মূক ও বধির
(মোহাম্মদ রফিক)

৬. আঙ্গিনা শূন্য, গ্রাম শূন্য, বাস্ত্তভিটা শূন্য
বাগানে ভাগাড়ে সবই প্রকাশ্য।
ঝ’রে পড়েছে মানুষের থেঁতলানো শরীরে
মৃত্যুর স্পর্শ
একটু একটু করে তুলে ধরো মাটির মধ্যে
নিঃসাড় শরীরে
তোমার তৃষ্ণা।
(মাহমুদ আল জামান)

৭.
বাইরে বাতাস শ্বাসরুদ্ধকর, রাজপথে সারি সারি বুট,
সব কিছু চেয়ে আছে অস্ত্রেরই বিশাল ডালপালা ;
কোথাও ফোটে না ফূল, কোথাও শুনি না আর
হৃদয়ের ভাষা,
কেবল তাকিয়ে দেখি মার্চপাস্ট, কুচকাওয়াজ, লেফট রাইট
এই রক্তাক্ত মাটিতে আর ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস।
(মহাদেব সাহা)

৮. খন্ডিত হয়েছে পৃথ্বী এত খন্ড খন্ড রূপে।  
এই দ্বন্দ্ব ঘুচে গেলে পর আবার সম্পূর্ণরূপে,  
মহামানবের পূণ্যতীর্থে জাগিবেন জন্মভূমি, জননী আমার।  
সপ্তসিন্ধু তের নদী, দশদিগন্তের ডাকে আবার নতুন করে  
ফিরে পাবো জনারণ্যে হারানো সে মাকে।
(নির্মলেন্দু গুণ)

৯. আমার যে ডান হাতে শামিত্ম ছিলো
সেই ডান হাতটি নেই
উড়ে গেছে বেয়াদব বোমা বিস্ফোরণে
বাম হাতে গৃহযুদ্ধ অন্ধকার
স্বদেশের সাতকোটি মানুষের হতাশার কররেখা নিয়ে আমি
ন্যূব্জ মুখে পড়ে আছি
অসহায় পড়ে আছি
(আবুল হাসান)

সত্তরের দশকের কবিরা জীবনের সদর্থক প্রবণতা গুলোকে সজ্ঞানে পরিহার করতে চাননি, ষাটের দশকের কবিদের যুদ্ধ-পূর্ববর্তী কবিতার মতো। বরং জীবনের নেতিবাচক রূপের অব্যাহত আত্মপ্রকাশ তাঁদের পরাভব চেতনাকে ত্বরান্বিত করেছে। ব্যক্তি, সমষ্টি, মানুষ, দেশ – এসব বোধ তাঁদের ব্যর্থতাবোধের ব্যাকরণে নতুন তাৎপর্য আরোপ করেছে। এই ‘বিপন্নতা’ যে ব্যক্তিগত বিপন্নতা নয়, প্রায় সকল কবির দীর্ঘশ্বাসের মধ্যেও যে রয়ে গেছে অন্তর্নিহিত ঐক্য, – এই লক্ষণ সত্তরের দশকের কবিতার একটা মৌলিক বৈশিষ্ট্য।  
যুদ্ধের অব্যবহিত পরে যাঁদের কবিতা রচনার সূত্রপাত, তাঁদের মধ্যে শহীদুজ্জাম, আবিদ আনোয়ার, সৈয়দ হায়দার, শানু কায়সার, দাউদ হায়দার, শিহাব সরকার, সুজাউদ্দিন কায়সার,ান ফিরোজ, মুজিবুল হক কবির, শান্তিময় বিশ্বাস, আবিদ আজাদ, বিমল গুহ, মুনীর সিরাজ, মাহবুব বারী, শামীম আজাদ, আবু করিম, মাহবুব হাসান, মোসতাফা মীর, হাসান হাফিজ, সৈকত আসগর, রবীন্দ্র গোপ, শামীম আজাদ, আসাদ মান্নান, দিলারা হাফিজ, ময়ুখ চৌধুরী, মাসুদুজ্জামান, কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, রেজাউদ্দীন স্টালিন,গোলাম কিবরিয়া পিনু প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। প্রথম আত্মপ্রকাশ-মুহূর্তে পূর্বতন কাব্যবিশ্বাসে অনাস্থা নিয়েও এঁদের জন্ম হয়নি। তবে অগ্রজ কবিদের অভিজ্ঞতার জগৎ থেকে এসব কবির অভিজ্ঞতার ভুবন স্বতন্ত্র।
১. গ্রামটা আমার ভেসে গেছে, চৈত্র এলেই পুড়ে যাবে
কাজের জন্য দুয়ার দুয়ার ঘুরেও কোনো ফল হবে না
এখন দেখি শহর আমায় রাখে কিনাবেঁচে থাকার ইচ্ছে নিয়ে গ্রামটি ছেড়ে চলে এলুম
চলে এলুম তোমায় ছেড়ে চলে এলুম
(দাউদ হায়দার)

২. আমাকে পাবে না। পাবে শুধু অচল দিবাবসান
অনুক্ষণ মরীচিকাপোড়া দিগমেত্মর ডান
বিসর্পিল শুষ্ক জিহ্বা ঝরে যাবে তোমার পথের
পিপাসার্ত নদী তোমাকে দেখিয়ে দেবে ভুল পথে
(আবিদ আজাদ)

৩. সর্বজনীন সূর্য এসে এই বাড়িতে ডোবে
আঁধার-মুখো চাঁদের নটী উল্টো পায়ে নাচে
দেয়াল ফেটে রক্ত ঝরে জং ধরেছে কাঁচে
ক্লামত্ম চড়ই নিজের পাখা নিজেই ছোঁড়ে ক্ষোভে।
গোরের গানে তৃপ্তি খোঁজে নতুন কোনো র্যাঁবো
এই বাড়িকে জিয়ন-কাঠি ছুঁইয়ে কখন দেবো?
(আবিদ আনোয়ার)

৪. নাচঘরে অস্থির ছুটোছুটি, সারা মঞ্চে আগুন
নিমেষে আমার পান্ডুলিপি কেড়ে নিয়ে
সামনে পেছনে প্রহরা
ক’জন গোয়েন্দা পরে আমার ভাষার ইতিহাসও দাবি করে
তার চেয়ে শিরা কেটে নিলে না কেন?
(শিহাব সরকার)

৫) এসো দুঃখের বিবাদ মিটিয়ে ফেলি
আনন্দের সংগে হোক আমাদের সহবাস
পাতার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসুক কাঠবেড়ালি
নিটোল ঝংকৃত পেয়ারা খেতে খেতে
(শান্তিময় বিশ্বাস)

যুদ্ধোত্তর সমাজ ও ব্যক্তিমানসের বিপর্যয় ও অনিশ্চয়তার অস্থির চিত্রই উল্লেখিত  কাব্যাংশগুলো থেকে পাওয়া যায়। দশকের মধ্য পর্যায়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে  শুরু হয় ষড়যন্ত্র, হিংস্র-মত্ততা ও রক্তপাত। ইতিহাসের পশ্চাদগতি ও রাষ্ট্রাদর্শ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চিহ্নসমূহের ক্রম-অপসারণ সমগ্র সমাজ জীবনকেই নিক্ষেপ করে সীমাহীন তমসা গহবরে। কবিদের স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণা আকাশচুম্বী পরাভব চেতনায় রূপ নেয়। এই পরিস্থিতিতে কবিদের মধ্যে সংরক্ত অনুভূতির পুনর্জীবন ঘটে :
১. এই বাড়িটা জাতির পিতার, এই বাড়িটা সবার
এই বাড়িটা মুজিব নামে পলাশ, রক্তজবার
এই বাড়িটা অশ্রুলেখা শোকের আগস্ট মাস
এই বাড়িটা পিতৃভূমির কান্না, দীর্ঘশ্বাস।
(কামাল চৌধুরী)

২. অতোটা ফুলের প্রয়োজন নেই
ভাষাহীন মুখ নিরীহ জীবন
প্রয়োজন নেই প্রয়োজন নেই
কিছুটা হিংস্র বিদ্রোহ চাই কিছুটা আঘাত
রক্তে কিছুটা উত্তাপ চাই, উষ্ণতা চাই
চাই কিছু লাল তীব্র আগুন।
(রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ)

৩. আমার হৃদয় ভর্তি কথাগুলি
অব্যর্থ একটি মেশিনগানের মতোন মুখর হতে চায়।
(মাহবুব হাসান)

এই প্রতিবাদী সদর্থক চেতনা এ-সময়ের অনেক কবির মধ্যেই নতুন কাব্যবোধের জন্ম দিয়েছে। তাঁরা নিসর্গ বন্দনার পরিবর্তে চেতনা প্রসারিত করেছেন বৃহত্তর জনপদে – প্রেমের ব্যর্থতাবোধকেও একটা তত্ত্বময় অভিজ্ঞানে পৌঁছে দিয়েছেন কোনো কোনো কবি। সত্তরের দশকের মধ্য পর্যায়ে যে-সকল তরুণ কবির আবির্ভাব ঘটে তাঁদের মধ্যে নাসির আহমেদ, হালিম আজাদ, শিশির দত্ত, ইকবাল আজিজ, সোহরাব হাসান, ফারুক মাহমুদ, জাহিদ হায়দার, মুহাম্মদ সামাদ, আসলাম সানী, আশরাফ আহমদ, তুষার দাশ, তসলিমা নাসরিন, জাফর ওয়াজেদ, আহমদ আজিজ, নাসিমা সুলতানা, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, আবু হাসান শাহরিয়ার, সৈয়দ আল ফারুক প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এই প্রজন্মের কবিদের মধ্যে ব্যক্তিসত্তার  আত্মপ্রতিষ্ঠার তীব্রতা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে সর্বগ্রাসী ব্যর্থতা ও হতাশার মধ্যেও শুশ্রূষার জন্য আকুতি।
আশির দশকের নতুন কবিরা বাহ্যত অনাস্থা প্রকাশ করলেন অগ্রজের কাব্যচারিত্র্য, জীবনানুভব ও নন্দন চিত্মায়। রক্তিম সমাজ জিজ্ঞাসা যে কবিতার মনোলোক ও শরীরকে বিক্ষত করতে পারে, সত্তরের দশকের নিকট-দৃষ্টাত্ম থেকে এ-ধারণা তাঁদের মধ্যে দৃঢ় ভিত্তি পায়। তাঁদের অনুভবে সমাজায়ত চিন্তা ও উপলব্ধি অপেক্ষা বিশ্বজনীন দর্শন ও বিজ্ঞানের নিত্যনতুন উদ্ভাবনা, মিথ-উৎসের নবমাত্রিক ব্যবহার, পরাবিদ্যার অঙ্গীকার; এমনকি, বিশুদ্ধ নন্দনচিন্তার সমান্তরালে আধ্যাত্মিক বিশ্বাসেরও বিচ্ছুরণ লক্ষ করা যায়।

★এ লেখাটা বেশ কয়েকবছর আগের। এটা আমার কবিতা নিয়ে কিছু বলবো শিরোনামীয় ধারাবাহিকের ৮ম পর্ব ছিল। ★