ত্রিশের কবিদের হাত ধরে বাংলা কবিতায় যে আধুনিকতার প্রবেশ ঘটে তা আস্তে আস্তে বিকশিত হয়েছে। কবিতায় প্রবেশ করেছে ফ্রান্সের সুয়ারিয়ালিজম, জার্মানির এক্সপ্রশেনিজন, লাতিন আমেরিকার ম্যাজিক রিয়ালিজম, ইতালির ফিউচারিলিজম প্রভৃতি। আর এদের সংমিশ্রিত রূপ কবিতাকে আধুনিকতায় সমৃদ্ধ করলেও হারিয়ে গেছে বাঙালির প্রাণের সুর, লোক জগতের ঐতিহ্য- সংস্কৃতি, নিজস্বতা। কেউ কেউ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন ঘরের দিকে, চেষ্টা করছেন সার্বজনীন শেকড় সন্ধানে, খুঁজে ফিরছেন তার নিজস্ব কণ্ঠস্বর।
একথা নিঃসন্দেহ যে কবিতা কবির একান্তই ভালোবাসার ফসল। কবি তার জীবনবোধ পাঠকের সাথে ভাগ করেন; কবির ভাবনাবিন্দু স্পর্শ করতে পাঠক কখনো ব্যর্থ হন, আবার কখনো এমন এক চেতনার সন্ধ্যান লাভ করেন যা কবির আরাধ্য ছিল না। একটি কবিতা প্রকাশের পর তা পাঠকের সম্পদ হয়ে যায়। তবে কবির এ সৃষ্টি পাঠক কিভাবে নেবে এটাই মূলকথা। কবির জীবনে যা জড়িয়ে যায়, যে ঘটনা, ঘটনাসমষ্টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ; যে হাওয়া কবিকে ভাবিয়ে তোলে, যে যন্ত্রণা কবির কাছে সুখ হয়ে ধরা দেয়; যে আপাত কদর্যতার মাঝে কবি সৌন্দর্য়ের সন্ধান পান, তা পাঠককে জানাতে কবি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন।
আর একজন কবি যখন কবিতার পাঠক হন,তখন তার চাওয়াটা একটু বেশীই হয়। সাধারণ পাঠক কবিতার মাধ্যমে পেতে চান মনের আনন্দ আর পাঠক কবি চান কল্পনার আনন্দ। কবির ভালোলাগা সৌন্দর্যের প্রগাঢ়।কাজেই পাঠক কবির মনকে জয় করা যথেষ্ট সহজ কাজ নয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন," সুন্দর আনন্দ দেয়, তাই সাহিত্যে সুন্দরকে নিয়ে কারবার। " বস্তুত বলা চাই, যা আনন্দ দেয় তাকেই মন সুন্দর বলে,আর সেটাই সাহিত্যের সামগ্রী। একটা কবিতা একেক পাঠকের কাছে একেক ভাবে ধরা দেয়। একটি কবিতা আমাকে ভাবায় হয়তো অন্যের কাছে তা নিছক শব্দগুচ্ছ; একটি কবিতা আমাকে সুখের অতলে নিয়ে যায়, অন্যকে হয়ত ডাঙ্গায় দাঁড় করিয়ে রাখে। পাঠকের উপলব্ধি, অভিব্যক্তি এবং চিন্তার যেহেতু বৈচিত্র এবং ভিন্নতা রয়েছে, সেহেতু কবিতাও পাঠকভেদে ভিন্ন ভিন্ন অভিধাপ্রাপ্ত হবে এটাই স্বাভাবিক। এতো বাক্যের আয়োজন যে জন্য, এবার আসা যাক সেই প্রসঙ্গে।
কবি মোঃ সিরাজুল হকক ভূঞা নিছক একজন কবি নন। তারমধ্যে রয়েছে এক অনন্য চিন্তাধারা। গাছপালা, পাহাড়, নদী, পশু,পাখি, লতা-পাতা, ফুল- ফল আর সারল্যে ভরা একটা ফ্রেমে আবদ্ধ করে ছন্দের উচ্ছ্বসিত বুননে ঠাসা বাঙালীর প্রাণের সুরে ভরা তার অনুপম শিল্পায়নের আবেগী কবিতা সকল।
তার কবিতা ও দ্যোতনা পাঠককে দীপ্ত করে তোলে। কবিতার ভেতর খুঁজে পাওয়া যায় কবিতার রহস্যময়তা। যে রহস্য কবির ব্যবহৃত চিত্রকল্প, মিথ, এ্যালুশনে হয়ে উঠেছে নান্দনিক। জীবনানন্দ দাশ কবিতার কথা নামক প্রবন্ধে বলেছিলেন-- আধুনিকদের কাল কেটে গেলে আরেক রকম স্বতন্ত্রতায় দাঁড়াবে কবিতা ; সে কবিতাকে গ্রহন করবার জন্য অনুভূতি ও আলোচনা ঠিক আজকের ভাবনা বিচারের কোণ থেকে কাজ করতে পারবে না।"
আজ আমরা উত্তরাধুনিকতার কালখণ্ডে দাঁড়িয়েও ঈর্শনীয় আক্ষরিক সুর ছন্দের কবিতার বিমোহিত না হয়ে পারিনা।
প্রকৃতির অতি সামান্য বিষয়কেও তিনি সুচারু হাতে যেন রোপন করে গেছেন কবিতার অক্ষরে।
বুলবুল পুস্তক প্রকাশনী, কালিহাতি, টাঙ্গাইল হতে প্রকাশিত চলতি বছরের একুশে বইমেলাকে সামনে রেখে কবির ৪ টি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে "প্রকৃতি ও প্রেম" নামীয় কাব্যগ্রন্থটি প্রকৃতির সহিত মনের মিতালী বা প্রেমের অভিধায় তিনি অনন্য করে তুলেছেন। ৫৬ টি কবিতার সবগুলি কবিতাই প্রকৃতি প্রেম নিয়ে রচিত।
কবি ঈশ্বর গুপ্ত তপসে মাছের গুণকীর্তন নিয়ে নিপুণ কবিতায় আজও অমর হয়ে আছেন। কবি সিরাজের "প্রকৃতি ও প্রেম" নামীয় গ্রন্থে দ্বিতীয় সংখ্যক কবিতার শিরোনাম "তিত পুঁটি"। বাংলার রসনা বিলাসে আবহমান কালধরে পুঁটিমাছকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। নানা ধরণের রান্না ও তার অবস্থান নিয়ে কবি সুচারু রপায়নে রূপায়িত করেছেন। তিনি কবিতাটির শেষান্তে লিখলেন,
" ভাজা ভুনা পুঁটি মাছে আছে যত টান,
পুঁটি মাছ পাতে নিতে মনে উঠে বান।
তিত পুঁটি ছোট মাছ স্বাদে ভরপুর,
খেতে বসে গিলে খাই গলা যতদূর।"
"সর্বনাশা পদ্মা" কবিতায় কবি লিখলেন,
"ভ্রান্তির ছাপ নিয়ে তোর চলাফেরা,
পদ্মারে তুই অশান্ত তুই বড় ত্যাড়া।
ভাঙ্গাগড়ায় কারো প্রতি রাখিস না শ্রদ্ধা,
তাই তোরে লোকে বলে সর্বনাশা পদ্মা।"
গোলাপে প্রীতি গোলাপে ভীতি কবিতার শেষে এসে দেখলাম,
গোলাপেই ভালোবাসা গোলাপেই ভয়,
গোলাপেই ঝড় তুলে সারা বিশ্বময়।
কারো প্রেম ফুলে আঁকা কারো গ্লানিময়,
কেউ দেখি হাতে ফুল রাখে সদাশয়।
কাঁটাযুক্ত ফুল দিয়ে যদি প্রেম করো,
ছিঁড়ে নিতে তার গায়ে বুঝেশুনে ধরো।
তেঁতুলের গুণ, খেজুর রসে, হেমম্তের রাতে, শরতের সুখসহ কিছু কবিতা নিরেট প্রকৃতির অপার মুগ্ধতার সাথে মানবজীবনের প্রয়োজনীয়তা ও উপলব্ধিতা প্রকাশ পেয়েছে। আর প্রেমজ কিছু আলপনা " দূরে দূরে থেকো না, ভালোবাসার লাল টিপ, চিঠি, একবার বলো প্রবৃতি শিরোনামীয় কবিতাগুলিতে বাঙময় হয়েছে সুনিপুণভাবে। ছোট বড় সকলেই কবির এ কবিতার বইটি সহজে আত্মস্থ করতে সক্ষম হবেন।
কবির এ কাব্যগ্রন্থটি পাঠে মনে হয়েছে কোথাও তিনি খুব বেশী আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠেননি। বরং তিনি অনেক বেশী সামষ্টিক। একাকী মানুষের কোন অস্তিত্ব নেই- জেনেই যেন কবি সমষ্টির সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা বলেছেন। নিঃসীম শূন্যতা, অনন্ত পরম্পরার ভেতর থেকে কবি নিজের স্বপ্নকে আলাদা করে প্রকৃতির মধ্যে বিচরণ করতে চান। কবির যে বোধের জগত তা একান্তভাবেই সামাজিক ও মানবতার কাছে দায়বদ্ধ। তবুও তার কবিতা ভাব অনুভাবে পাঠ পাঠোত্তরে পাঠকের বোধের দ্রাঘিমাকেও ছুঁয়ে যায় অবলীলায়।
বলা বাহুল্য বক্ষমান কবিতার বইটি কবি এ অধমকে উৎসর্গ করেছেন। কবির এ কবিতার বই এবং কবির রচনার উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।