কবি কে? কারা? কবি তিনি, যার অন্তর নিংড়ানো ভালোবাসার পংক্তিগুলি তাকেসহ অপরকে আন্দোলিত করে। দেশ রাষ্ট্র জনতাকে ভুল শুধরে সামনে এগোনোর আহবান জানায়। প্রকৃতির নিপুণ চিত্র যার হাতে চিত্রময় হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেনঃ
'ভালো যদি বাসো সখি কি দেবো গো আর
কবির হৃদয় আছে দেবো উপহার।'
কাজী নজরুল ইসলাম গেয়েছেনঃ
'তুমি আমায় ভালোবাসো তাই তো আমি কবি।'
আসলে কবি হলেন ভালোবাসার পূজারী। ভালোবাসার ফুল ফুটিয়ে কবি প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে রাঙিয়ে তোলেন আগামীর ক্যানভাস। সমস্ত মাঙ্গলিক দর্শনকে সামনে রেখে কবি এঁকে চলেন জীবনের জয়তিলক। সাধারণ মানুষ হলেও এটাই কবির ভিন্নতা। তাই এটাই ধ্রুব সত্য, সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি।
কয়েকদিন আগে কবি খন্দকার খসরু পারভেজ একটি নিবন্ধে লিখেছেন, "কবিতার কোনো সংজ্ঞা নেই, তাই ইচ্ছে-খুশি মত লিখলেই কবিতা হয়ে যাবে, এমন একটি ধারণা আমাদের অনেকের ভেতরে দিনদিন বদ্ধমূল হয়ে উঠেছে। একারণেই আমাদের অধুনার নানান মিডিয়ায় লক্ষ্য করা যায়, অন্যান্য লেখার চেয়ে কবিতা লেখার প্রবণতা বেশি।"
আসলেই কি কবিতা লেখার কাজটি অনায়াসসাধ্য? বিষয়টি তা নয়। সাহিত্যের অন্যান্য শাখার চাইতে কবিতাই সবচেয়ে কষ্টার্জিত শিল্প। কঠিন শ্রম, নিষ্ঠা, অধ্যবসায়, একাগ্রতার মাধ্যমে একজন কবিতা লিখিয়ের পক্ষে এই কঠিন কাজটিকে আয়ত্ব আনা সম্ভব। যারা নিয়মিত কবিতার সাথে আছেন; তাঁদের জেগে ওঠা, জ্বলে ওঠার অপেক্ষায় আমরা দিন গুনি। কেননা, ক্রমাগত আমাদের বৈচিত্রহীন কবিতার শ্লথ গতিকে তাঁরা বইয়ে দেবেন নতুন দিগন্তে, যেটা খুবই জরুরি। দুঃখের বিষয়, একই কবিতা যখন অনেকের লেখায় পড়ি, দেখি আর পরীক্ষা-নীরিক্ষার নামে উদ্ভট, জটিল, আঘোরহীন কবিতার জ্বরে আক্রান্ত হই, তখন কিছু কবিতাযোদ্ধা উঁচিয়ে ধরেন তাঁদের নিজস্ব ধারার বৈজয়ন্তী। তাঁদের সংখ্যা কিন্তু নিতান্তই কম। আবার পুরোনো রীতিকে টেনে এনে পাঠকের সামনে সম্পূর্ণ নতুন করে পাঠ আওড়ানোর মতো করে, মনের তারে বাঁধবার মতো শব্দ বাক্য উপমায় অমেয় আলোর কবিতা উপহার দেওয়া কবির সংখ্যাও নিতান্তই কম। এই কম সংখ্যক কবিদের মধ্যে সময়ের অন্যতম কবি মোঃ সিরাজুল ইসলাম ভূঞা কবিতায় জাগিয়ে তুলেছেন প্রকৃতিবোধ, দেশবোধ আর মানবচেতনায় সমৃদ্ধ কবিতা সকল। স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, লিমেরিক ছন্দে সিদ্ধহস্ত কবি বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও সামাজিক মাধ্যমে লিখে চলেছেন ক্রমাগত।
কবিতায় কিন্তু এক একটা ঘোর থাকে। থাকে এক ধরনের মোচড়। যা পাঠককে সচকিত করে এবং ক্লান্তি বা একঘেয়েমিপনা থেকে মুক্তি দেয়। এর একটাই কারণ জীবনের গভীর অন্তর্দেশ খুড়ে কবিতাকে উপস্থাপন করতে হয় পাঠকের সামনে। কবিতায় জীবনকে জাগানোর যে আকুল প্রত্যাশা, সেটা তো আমার মত একজন জীবনবাদী পাঠকের প্রত্যাশাও। কবি মোঃ সিরাজুল হক ভূঞা সে প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গেছেন অনেক আগেই। প্রকৃতি প্রেম, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, রোমান্টিকতা, মানবতাবাদী বিবিধ ভাবনায় তার কবিতার বিচরণ । মোদ্দাকথা, ফুল-ফল, লতা-পাতা, পশুপাখি, আকাশ-বাতাস, নদীজল, আমাদের গ্রাম বাংলার নানান লোকজ ঐতিহ্যকে বিষয়বস্তু হিসেবে নিয়ে কবি অবিরামভাবে লিখে চলেছেন মনোমুগ্ধকর সব কবিতা। তিনি হয়ে পড়েছেন এক প্রকৃতিবাদী কবি।
ব্যক্তিগতভাবে কবি বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) উপপরিচালক (প্রশাসন) পদে কর্মরত আছেন।
সদ্য প্রকাশিত হলো কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ " প্রকৃতি ও ভালোবাসা। " টাঙ্গাইলের কালিহাতির বুলবুল পুস্তক প্রকাশনীর কর্ণধার মোঃ বুলবুল হোসেন অতিনিষ্ঠার সাথে ৯০ টি কবিতা নিয়ে ৬ ফর্মার এ ঝকঝকে তকতকে গ্রন্থটি প্রকাশ করে বইমেলায় এনেছেন।
গ্রন্থটির তিনটি অধ্যায় বা পর্যায়ে তিনধরনের কবিতার স্থান দেখা গেলো।
১) প্রকৃতি ও জীবনবোধের কবিতা
২)দেশাত্মবোধক কবিতা
৩) প্রেমের কবিতা
প্রকৃতি ও জীবনবোধের কবিতা পর্যায়ে এবং গ্রন্থটির প্রথম কবিতার শিরোনাম "নিম"
একটি অনন্যসাধারণ কবিতা 'নিম'। নিম শিরোনামে, নিমের গাছ-পাতা-ফুল-ফল নিয়ে লেখা একটি রূপকল্প। শুরুটা কবি এক কথোপকথনের মাধ্যমে শুরু করে নিমের অগুণাগুন নিয়ে আলোকপাত করেছেন। শেষে নিমের ভাষায় তার ভেতর ও বাইরের সকল গুণাবলী চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন। কবি নিমের স্বগতোক্তির মাধ্যমে বলেছেন,
হাজার গাছের রাজা আমি আছেও অনেক মূল্য,
আমার আছে ঔষধি গুন কোটি টাকার তুল্য।
খায়না পোকায় ধরেনা ঘুন আমার কাঠ শক্ত
হাজার কাজে ব্যবহারে কাঠ মিস্ত্রিও ভক্ত
আমার ঘ্রাণে কীটপতঙ্গ দূরেন সরে যায়
আমার গুণেই বায়ুমণ্ডল নির্মলতা পায়।
নিমগাছ যে প্রকৃতি তথা জীবনের বন্ধু, তা কবি বোঝালেন অতি সাবলীলতায়। আমাদের চারপাশে প্রকৃতির এরকম উপকারী ফুল ফল লতাপাতার অভাব নেই। বাহ্যত আমরা প্রত্যক্ষ করলেও এর অন্তর্নিহিত গুণাগুণ সম্পর্কে আমরা খুব একটা জ্ঞাত নই। কবি সেই গুণাগুন নিয়ে আতাফলের গুণ, কমলালেবুর গুণ, পাকা জামের গুণ,পাতিলেবুর গুণ, কলার গুণ মেলা নামে তার অনন্যসাধারণ কবিতাগুলি সাজিয়েছেন। যা প্রকৃতিপ্রেমের এক অত্যুৎজ্জ্বল উদাহরণ। বৈজ্ঞানিক আর অর্গানিক জ্ঞান সমৃদ্ধ কবি কবিতার ছত্রে ছত্রে নিপুন হাতে আমাদোর সামনে এনেছেন এসবের গুণাগুণ।
১
পুষ্টিগুণ আর ভিটামিন যতবেশী চাও
অরুচি আর ক্ষুধামন্দায় পেয়ারা তুমি খাও।
২
ক্যালসিয়াম আর ফসফরাস, অনেক ম্যাংগানিজ
আতা খাওয়ার সময় জিবে লাগে কালো দানার বীজ।
৩
কমলালেবু হাতে নিলে জিবে আসে জল
খোসা বাদে ভেতরদিক রসে টলমল।
৪
লেবুর আছে ঔষধিগুণ সাথে ভিটামিন
সুস্থ শরীর গড়ে তুলতে সে যে তুলনাহীন।
নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। দেশটিকে জালের মতো বিস্তার করে আছে অসংখ্য নদী। এমনই সব নদীর নামে কবির অনবদ্য সব কবিতায় মন পাগলপারা হয়ে পড়ে।
পাগলপারা পদ্মা, তুমি ব্রহ্মপুত্র, নদী মধুমতী তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
নদী মধুমতী নিয়ে লিখেছেন,
মধুমতীর গতিবিধি মধুময় নয়
বছর ধরে শান্ত থাকে বর্ষাকালে ভয়।
একই কথাটি এ কবিতার শেষে বন্ধুবৎসল কবির অনিন্দ্যসুন্দর উচ্চারণ,
যৌবন ফিরে মধুমতীর ভরা বর্ষা এলে
ভালোলাগে বন্ধুরবাড়ি বর্ষাকালে গেলে।
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। রূপে গুণে বাহারে রোদ বৃষ্টি শীতের সমন্বিত এ দেশ। কবিদের কবিতায় পেয়েছে আরো বেশী ঋদ্ধতা। কবি মোঃ সিরাজুল হক ভূঞা ঋতু বৈচিত্রের এদেশের রূপ রস গন্ধ নানাবিধ উপমায় যেন চিত্রময় করে তুলেছেন।
'পৌষ যখন শুরু 'নামীয় কবিতাটির দুটি চরণে আমরা পাই আবহমান বাংলার ভেতরকার ঐতিহ্য:
বাংলা মায়ের ঘরে ঘরে শুরু নবান্নের
চিড়ামুড়ি পিঠার বাজার আগাম পৌষের।
নবান্ন শিরোনামের একটি কবিতায় গ্রামীন বাংলার সন্ধ্যাকালে আমাদের রান্নাঘরের বর্ণনাটা কবি এভাবে দিলেন,
সন্ধ্যা হলে লেগে যায় রান্নাঘরে ভীড়
খেতে বসে পাতে নেয় গুড়-মুড়ি-ক্ষীর।"
গ্রাম বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য আজও স্বগৌরবে লালিত হচ্ছে আমাদের নকশিকাঁথায়। কবি নকশিকাঁথা শিরোনামে একটি কবিতায় উপস্থাপন করেছেন,
হাসি কান্নার সব কাহিনী কাঁথায় জোড়া থাকে
যত্ন করেই নকশিকাঁথা সারা জনম রাখে।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত, সবচেয়ে বেশি নন্দিত, সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারী প্রপঞ্চটির নাম প্রেম। পৃথিবীতে কত আকাশচুম্বী অট্টালিকা আছে, কত হাজার দুয়ারী ভবন আছে, কত বিশালায়তনের দালান আছে কিন্তু কবরের ওপর রচিত একটি পাথরের মিনার হৃদয়বান মানুষের স্বপ্নের ঠিকানা আজো তাজমহল। কারণ সেটি প্রেমের প্রতীক। প্রেমের রাজধানী। ভালোবাসার মক্কা। শুধু প্রেমিকাকে স্থায়ীভাবে পাওয়ার জন্য রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন। কিছুদিন আগেও জাপানের রাজকুমারী প্রেমিককে বিয়ে করার জন্য রাষ্ট্র প্রদত্ত রাজপরিবারের সকল সুবিধাদি পরিত্যাগ করেছেন। পৃথিবীতে সকল ভাষায় যত গান, কবিতারচিত হয়েছে, তার ভেতর সিংহভাগের কেন্দ্রীয় বিষয় প্রেম। উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, রূপকথা, লোককাহিনী সবখানেই প্রেমের উপস্থিতি প্রবল। কবি মোঃ সিরাজুল হক সে মানব প্রেমের যে একান্ত নিবিড় ছোঁয়াকে প্রকৃতিময় করে তুলেছেন। আটপৌরে জীবনের নানান চাহিদার সাথে প্রেম ভালোবাসাকেও এনেছেন সহজ সরল সুন্দর আর সাবলীলতায়।
ভালোবাসার চিঠি নামীয় কবিতায় কবি লিখলেন,
যেদিন তুমি এসেছিলে হেসেছিলো মন
এখন তুমি দূরে থাকো চিন্তা সারাক্ষণ ।
শেষ দেখায় বলেছিলে চিঠি দেবে রোজ
এখন তুমি ভুলে আছো নেই কোন খোঁজ।
"আমার সাথে থাকো" কবিতায় বন্ধুপ্রীতি নিয়ে কী সাবলীল উপস্থাপন!
উত্তর পাড়ায় বন্ধু থাকে দক্ষিণ পাড়ায় আমি
বিরূপ হলেও আমার কাছে বন্ধুর কথাই দামী
আমার প্রাণের বন্ধুর জন্য পাড়ায় পাড়ায় মিল
উভয় পাড়া ঠায় দাঁড়িয়ে মাঝে হাতিরঝিল
দক্ষিণ পাড়ায় মাঝে মাঝে ঝগড়াবিবাদ বাঁধে
আমার জন্যই বন্ধু এসে দোষটা তুলে কাঁধে।
গ্রন্থটির প্রকৃতি ও জীবনবোধের কবিতাংশে মোট ৫৪ টি কবিতা। দেশাত্মবোধ ও মানবতাবাদী কবিতাংশে যথাক্রমে ১৩টি ও ২৩টি কবিতা স্থান পেয়েছে। পুরো ৯০টি কবিতার ভেতর কবি অনায়াসলব্ধ কবিতা হিসেবে ৪৯টি কবিতাই লিমেরিক ছন্দে প্রণয়ন করেছেন।
একসময় হাটে-ঘাটে-বাজারে, পরিবারে,বিয়ে শাদীসহ নানান সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপে চলনে বলনে মানুষ কাব্য কবিতার আশ্রয় নিতো। কাব্যিক মনোভাব ব্যক্ত করতো। কবি সিরাজুল হক অতি নিষ্ঠার সাথে সেই সহজ সরল কথামালার মাধ্যমে আমাদের শহুরে জীবন আর গ্রামীন জীবনের মাঝের দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টায় এগিয়ে এসেছেন।
কবিতার সঙ্গে জীবনের নিগূঢ় সম্পর্ক বেশি, না মননের সম্পর্ক বেশি; এ নিয়ে মতানৈক্য থাকতেই পারে। আমি বরাবরই মনে করি, মননকে ধারণ করে জীবন নয়; জীবনকে ধারণ করেই গড়ে ওঠে মননভূমি। জীবন থেকেই কবিতার উপাদান ও রসদ যোগাড় করতে হয়। একারণে কবিতা নির্মাণ নয়, কবিতা সৃষ্টি হয়। কবিতার জন্য প্রয়োজন যে গভীর চেতনা ও রুচিবোধ, তা সিরাজুল হকের ভেতর প্রত্যক্ষ করি। সমকালের কবিদের থেকে তাঁর কবিতা আলাদা। তাঁর কবিতায় শব্দের সুমিত ব্যবহার, শব্দবন্ধ তৈরির প্রবণতা লক্ষণীয়। তাই বলে শব্দের সহজ সরল বোধগম্যতার প্রয়োগে তাঁর কবিতা অহেতুক সহজ হয়ে ওঠে না। তাঁর কবিতায় রয়েছে স্বতঃস্ফূর্ততা। একারণেই শুধু নয়, সাধারণ পাঠকের ভাবনার কাছে সরব, কাব্যিক এবং শিল্পিত। তাঁর কবিতা পাঠের জন্য কেবল অনুসন্ধিৎসু, শিল্পজ্ঞান সমৃদ্ধ পাঠকই নন, সব শ্রেনী পেশার মানুষই বুঝতে পারবেন কবির কবিতা। কেননা,কবি নিজেই ভাবেন, তিনি কবিতা লেখেন না, কবিতা তাঁকে লেখে।' এই যাদু বাস্তবতার নিরিখে তাঁর কবিতা পাঠ করার জন্য পাঠকের মনোনিবেশ প্রয়োজন।
কবির বিনয়ী মনোভাব আর উদারতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তার প্রথম কবিতাগ্রন্থখানা এ অধমকেই তিনি উৎসর্গ করেছেন। আগামীতে কবি আমাদেরকে আরও অনেক ভালো কবিতা উপহার দেবেন, এটাই প্রত্যাশা করি।
-----------------------------------------
টুঙ্গিপাড়া,