কবি ছালেহা খানম
আমার দৃষ্টিতে আর ব্যবচ্ছেদে
======================
-- শরীফ এমদাদ হোসেন
তাং ১৪-১২-২০২০

শুনেছি জন্মগত ভাবে কেউ কেউ কবি হয়েই জন্মায় আবার কেউ কেউ কষ্টের নদী সাঁতরে। আমি কবি কিনা জানিনা। দুঃখ বেদনার সঙ্গে ভালোবাসা করে আছি বলেই কোন একদিন কবিতা ভালোলেগেছিল। কিছু পড়ি কিছু লিখি করে কাটলো যথেষ্ট সময়। ডুব দিতে পারিনা। হয়ত আমার সীমাবদ্ধতা। তাই প্রতিদিন পার হই দুঃখের সিঁড়ি। কবিতাকে আঁকড়ে ধরি বুকের মধ্যে।

           বেশ কিছু দিন ধরে চোখে পড়ছে একজন কবি যিনি হলেন ছালেহা খানম।  তার ডাক নাম ফেন্সি। কোন কোন লেখায় ডাক নামটা যুক্ত করে দেয়া নজরে এসেছে। প্রোফাইলে যতদূর জানি তিনি ফেনী শহরের বাসিন্দা। কবিতা লেখায় পারদর্শী।

           বাংলা কবিতা এখন এমন একটা সময় পার করছে যে সময়টাকে বলা হয় উত্তারাধুনিক সময়। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ সবযুগেই এর সাধকগন সর্বান্তকরণে দুর্ভেদ্য আকারে নির্মান করার চেষ্টা করে গেছেন। আর এখন এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে সারমর্ম , সারার্থ বেছে বের করা সাধারণ পাঠকের নিকট কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে। ফলে কোনো কবিতার গুঢ়ার্থ ধরে পাঠ না করে যার যার ইচ্ছে আর অনুমান ভিত্তিক অর্থে কবিতা এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে এসকল কবিতা সময়ের বিবর্তনে টিকে থাকবে না হারিয়ে যাবে তা সময়ই নির্ধারণ করবে নিঃসন্দেহে।তবে বহু অর্থে লিখিত সার্থক কবিতার সমাদর ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে দেশে বিদেশে বহু ভাষায়, বহু কৃষ্টিতে।
ছালেহা খানম এই সময় আর এই সময়ের কবিতাকে  ও স্পর্শ করে চলেছেন অকপটে। আর তার লেখা বেশ কিছু কবিতায় বেশ জোরালো আবেদন আর মুন্সিয়ানা পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে তিনি ছন্দবদ্ধ কোন কবিতায় আদৌ চলাফেরা করেছেন আপাত দৃষ্টিতে তা দেখছি না। অধুনা নানা ব্যঞ্জনায় কবির কবিতা বাঙ্ময় হয়ে যায়।

"হৃদয়ে রাত নেমেছে- ফর্সা দিন গুলো কালো রূপ ধরছে,
উদ্বেলিত মন ঘরে মৃদু মৃদু আগুন ;
পুড়ে কেনো ছাঁই হলোনা!"

         অবচেতনে কবি মনে নানা প্রশ্ন উঁকি দেয়, নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে চেপে রাখা যন্ত্রণাগুলো বুকের ভেতর প্রশ্নকরে "কেনো বেঁচে থাকা" কবিতায়।

        পরাভূত কবি পরমুহূর্তে ফিরে এসে বাঁচায় নেশায় উন্মত্ত হয়ে ওঠেন কবিতায়,

"মস্তিষ্ক আমায় পরামর্শ দেয়
জীবনের হাসপাতাল বড় বেপোট;
হাজার হাজার বছর মনের দেনায় দেউলিয়া --
তবুও প্রতিদিনের প্রতিটি মুহূর্তে বাঁচতে চায় মন।"

তারপর আবার সেই একই প্রশ্নে উদ্বেলিত কবিমন,

ধূসর কালো মেঘ গ্রাস করছে অস্তিত্ব;
বিরহী কুয়াশারা পায়ে পড়িয়েছে বেড়ি- রোদ করছে সালিশি,
জীবন উপভোগের জন্য লড়াই
দুশ্চিন্তা, ভেবে ভেবে সারা- না পাই কূল,  
পৃথিবীর বুকে কেনো এ ঘর বাঁধা?

         জীবনের নানা মনসংঘাতে কবিমন বিধ্বস্ত হয় আবার গড়ে ওঠে নতুন করে, ভাঙ্গা আর গড়ার এই যে অব্যাহত যুদ্ধ তারমধ্যেও কবি ১৯৭১ সালকে সামনে রেখে, স্মরনে রেখে "মিনতি" নামীয় তার একটি কবিতায় লেখেন,

"প্রিয় বাংলা,
আজ তোমার কাছে আমার এই লিখা
বেদনার্ত রাতের - দুখের প্রহরের মধ্যভাগ
কিংবা বিকেলের। "

        তিরিশ লক্ষ জীবনের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার স্বপ্ন সাধ কবির নিকট দুরাশাই রয়ে গেলো। ভূলুণ্ঠিত স্বাধীনতা নিয়ে কবি আক্ষেপ করে বলেন,

"আজ তোমার কাছে স্বাধীনতার মুক্তি ভিক্ষা চাই-
মুক্তি না দাও কুকুর লেলিয়ে দিওনা,
আঘাতে-আঘাতে, অনাদর, অবহেলায়, মানবতা ডিঙিয়ে স্বাধীনতার সুন্দরকে অসুন্দর করো না। "

       যে পৈশাচিক চরিত্রের কারণে একদিন এদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষ একতাবদ্ধ  হয়ে বহু ত্যাগ আর রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা
কবি  চোখে তা অসুন্দরের পথে, তাই তার কামনা কখনো যেন মধুর স্বপ্ন অম্লতায় পরিণত  না হয়।

      মাত্র অল্প ক' দিন আগে "বিবক্ষা" শিরোনামের কবিতাটি কবি মনের গভীর আবেগ ভালোবাসার অনুরণন সৃষ্টি করেছে।

        বিবক্ষা শব্দার্থ নিশ্চয়ই আমাদের জানা, মানে- কিছু বলতে চাওয়া, কবি বলতেই চান তার লাগামহীন  আবেগী কথার মালা, কিন্তু তা প্রকাশের কোন জায়গা কবির মিলছে কি মিলছে না এমন এক অস্পষ্ট দোলাচলে কবি বলেন,

"পরাজিত সৈনিক আমি- তপ্ত রোদে হাঁটতে হাঁটতে ছিড়েছে  জুতা,
শতকোটি প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে - কোমল, নরম
কিন্তু নত নয়।
চোখ মুছতে মুছতে এক টুকরো সুখের মণি নিয়ে
তবুও একদিন ফিরবো ঘরে।"

        জীবনের কোনো বাঁকে কবি আশাহত হন, আর সে আশাহতর শোকাশ্রু নিয়ে কবি মাথা উঁচু করে দাড়ান  আর সুখ নামক সোনার হরিন নিয়ে ফেরবার জন্য কবি দৃপ্ত শপথ গ্রহন করেন। মানব জীবনের এই যে দোলাচল এই যে উঠানামা "জীবন অনুভবে" কবিতায় কবি বলেন,

"ক্ষুন্ন হৃদয়ে সুখেরা সব মৃত- দুঃখেরা সব আহত;

জীবনের পলেস্তারা গুলো রাতের সাগরে খাচ্ছে হাবুডুবু,
উপল পথের বাঁকে- স্বপনেরা ফেলে আসা জীবনের চিত্র আঁকে।
জীবন ডাঙায় দুঃখ সুখের যাওয়া আসা- ""

       কী গভীর অনুভব! আপাদমস্তক  একজন মানুষ জীবন বোধে কখনো কবি, কখনো পৌরাণিক। আনুপূর্বিক  বিশ্লেষণের কোন প্রয়োজন আর পড়ে কি? শব্দ বাক্যের মাধুর্যে কবিতা হয়েছে ঋদ্ধ সমৃদ্ধ।

        প্রেমে ভালোবাসায় আচ্ছন্ন কে না হয়! সে প্রেম আসে নানা পথে নানা বাঁকে, সময় অসময়ে কোন এক মোহময়তায় নিবিষ্ট হয়েও ব্যর্থ নয় অথচ শফলও নয় এমন আচ্ছন্নতার মাঝে কবি  অপূর্ব এক তুলির আঁচড় টেনেছেন "উত্তরের সন্ধ্যানে" কবিতায়

"এক লহমায় গোধূলির আলোয় আলোকিত
আজন্ম কাঙালের চিরন্তন বিকেল
হতশ্রী রূপ ধারণ করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে যায়...

একাকী শোকের সুধা পিয়ে "তুমিহীন" মন ভাবে, আমি কি পেতে পারিনা নিজের ভালোবাসা! "

        "অহম" নামীয় কবিতাটি পুরোটা পড়তে পারি কবি সচেতন বোধের এক অনুপম ছোঁয়ায়।

একাকী নীরব লগনে মন ডাকে কবিতায়
ঘুম ভাঙা রাতে আকাশ পাড়ে-চাঁদের আলো অনেক দূরে,  
শান্ত মন- অনতি সঙ্গী ঝড়ো হাওয়া।
ফ্যাল-ফ্যালিয়ে  কাঁদে দু'চোখ- তাকিয়ে নিরাশার অশ্রু ধারায়,
নদী তোমার মতো করে সাজিয়ে দেবে কি আমায়?

বিবৃত জোনাক আলোয় খুঁজি স্বপ্ন নিভৃতে নিরালায়,
নোনাধরা দেয়ালের কান্না কেউ শুনে না,
আড়ালে থেকে বাজে বিষের বাঁশি।

কে বানাইছে মন- ভূবণ!
সারি সারি দুঃখ গুলো দখল করছে সুখের নদী,
হৃদয় এখন সন্ধ্যা তারার পাড়ে ঘন মেঘ দেখে- জীবনের রূপ স্মরণে,
মেঘের বিদ্যুতে রোদের জোয়ারে জন্ম নেয় আগুনের শিখা।

রূপালী চাঁদের রাঙা রাত্রীরা হারায় প্রেম ছন্দ লেখা-
মিসিসিপির উজানে ভাসে ফেলে আসা পীরিতের ফুল,
আমায় খেয়াল করে অবসাদ- হৃদয় ক্ষত করে বেদনার কুশ,

পালা বদলের ইচ্ছেরা মুখ বুঝে যন্ত্রণা বয়-
মুঠোয় মুঠোয় তোলে বিরহ,
ঝলমলে সুন্দরী চাঁদের স্পর্শ না পেয়ে বসন্ত আসছে না।
বিবর্ণা কোন রেখায় পৃথিবীর কোলে-ছোট্ট ঘরের  দরজার এক কোণে কখনো পড়ে থাকবে
আমার ঠাণ্ডা মৃতদেহ।

       কবিতায় অনেক বেশী  শব্দ  বাক্যের প্রয়োজন হয়না। অযাচিত শব্দ বাক্য পরিহার করে শোভনীয় শব্দ বাক্যের ব্যবহারে পাঠককে ব্যাকুল  করা যায়।
ছালেহা খাতুন তার অজস্র লেখায় বাড়তি শব্দ বাক্য ব্যবহার করে তার কবিতাকে করে তুলেছেন কিছুটা আকর্ষণহীন। অনলাইন সাহিত্য পাঠে পাঠকের সময় ধৈর্যর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে শব্দ সাজাতে হবে হিসেবের কড়া ক্রান্তিতে। অহম কবিতার শব্দ বাক্যগুলো ভীষণভাবে সচেতন হাতে সাজানো। প্রতিটি বাক্যকেই  মনে হয় এক একটি কবিতা।

"কে বানাইছে মন- ভূবণ!
সারি সারি দুঃখ গুলো দখল করছে সুখের নদী"

        হৃদয় যন্ত্রণাময় হলে কবিতা হয় নইলে হয়তবা নয়। সুখতারার নীচে কবিতার ভাবভাষা এক কলঙ্কিত চাঁদের ক্ষীণ আলোয় সে কবিতা আরেক, কবিতা তো নয় তেতো এক উপমাই হয়।এটা হয়ত সবার বেলা ঠিক নয়। যিনি সময়কে ভাবেন, রাতের আঁধারকে ভালোবাসেন, ফুল পাখি আকাশকে ভালোবাসেন তিনি কবি। কবি রেখা টানে পথ চলে দুই হাতপায়ে, চোখের ভাষায়, দ্যাখে সমাজ, রাষ্ট্র মহাকাল। ছালেহা খাতুন তেমনই একজন।
*******************-**************************
টুঙ্গিপাড়া,