কবি সাইফুল্লাহ মাহামুদ দুলাল ও তাঁর কবিতাঃ রবিদাস এবং তালগাছ
সমাজে বহু শ্রেনী পেশার মানুষের বসবাস। বিচিত্র মানুষের বিচিত্র স্বভাব, চাহিদা আর চলাফেরা। কেউ অল্পে খুশী, তৃপ্ত । আবার কেউ তার চাহিদার শেষ কোথায় তা সে নিজেই জানেনা। কেউ অল্পের মধ্যেই সুখের সন্ধ্যান পায় আর কেউ কেউ সুখের নাগাল পাওয়ার বাসনায় মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েও পায় না।
আসলে সুখ একটা অনভূতি। এই অনুভূতি তার তীক্ষ্ণতা অনুধাবনেরও ক্ষমতা, ধৈর্য সকলের থাকেনা। তাই জীবনব্যাপী নিরবদ্য সুখের কামনায় কারো কারো কাছে সুখ ধরাই দেয়না। সুখানুভূতি তার কাছে তার চাহিদার সাথে অন্তহীন হয়ে পড়ে।
যুগে যুগে জ্ঞানী গুনীগন সুখানভূতির নানাররূপ বিশ্লেষণে ব্যপ্ত ছিলেন আছেনও। নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে ও ব্যতিক্রম হবেনা।
কিন্তু সমাজের পিছিয়ে পড়া একশ্রেণীর হত দরিদ্রের মধ্যে সুখানুভূতি একেবারে সহজ সরল। কোন প্যাচেঘোচে নেই। দরিদ্র মানুষের সুখ হলো দু' বেলা নিতান্ত বেঁচে থাকবার তাকিদে কিছু মুখে গুঁজে দেওয়া। আর তার সঙ্গে জৈবিক বলি ও জীবনের তাকিদ বলি পুরুষের জন্য নারী আর নারীর জন্য একজন পুরুষ। কোন পরিস্থিতিতে তার চাহিদা সীমা অতিক্রম করেনা বা অতিক্রান্ত সীমায় তার চাহিদা বা কামনা বাসনা প্লাবিত হয়না।
উপরোক্ত বিষয়টি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে
দেখালেন বাংলা সাহিত্যে চার দশকেরও বেশী সময় ধরে নিরলসভাবে বিচরণকারী ৭৫ খানা গ্রন্থের রচয়িতা কানাডা প্রবাসী কবি সাইফুল্লাহ মাহামুদ দুলাল। পৃথিবীর বহু জনপদে বিচরনকারী বহু জ্ঞানে সমৃদ্ধ কবি চোখে ধরা পড়েছে অম্লমধুর জীবনাচরণ।
তাঁর রবিদাস এবং তালগাছ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকসশ পেয়েছে। হয়তবা তাঁর কোন কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি স্বমহিমায় স্থান পাবে।
কবিতাটি পাঠ করার পর হতে কোন তাড়নায় কোন অভাবিত আকর্ষণে যেন ক্রমশ আমি মুষড়ে যাই। আমরা একটিমাত্র উপন্যাসের জনক অদ্বৈত মল্লবর্মণের নাম জানি "তিতাস একটি নদীর নাম" নদীপারের ধীবর শ্রেনীর সন্তান হৃদয়ে দাগ টেনে কালজয়ী উপন্যাস রচনা করে নিজেই হলেন ইতিহাস। আকতারুজ্জামান ইলিয়াস, আবু ইসহাক জীবনে খুব বেশী লেখেন নি। তাঁদের "খোয়ারী" "চিলেকোঠার সেপাই" "সূর্য দীঘল বাড়ি, "হারেম, "মহাপতঙ্গ, "পদ্মার পলিমাটি" বাংলা সাহিতের এক একটি আলোক -বর্তিকা। আবু ইসহাকের "জোঁক" গল্পটা যেমন এককালে সাড়াজাগানো পাঠ্য আর আলোচিত ছোটগল্প ছিল, আমার ধারনা সে কাল হলে কবি সাইফুল্লাহ মাহামুদ দুলালের এই একটি কবিতার গল্প কাহিনী ভাষাও একটি আলোচিত পাঠ্য আর সাড়াজাগানো রুঢ় সত্য বাস্তবতার কবিতা সাহিত্য হতো। ফেসবুকে আর বৈশ্বিক চরম উৎকর্ষের যুগে এসে আমরা সহজেই সবকিছু ভুলে যাই।
কবি সাইফুল্লাহ মাহামুদ দুলালের কবিতাটির নাম রবিদাস এবং তালগাছ। কবিতাটি আমরা পড়িঃ
♦রবিদাস এবং তালগাছ ♦
**********************
শুধু দারিদ্রসীমার নিচে নয়; দাঁড়িয়ে থাকার সীমানার নিচেও
নীচুশ্রেণির রবিদাস মাথা নিচু করে সেলাই করে
............................. আমাদের পা এবং পাদুকা।
আড়াই হাত ধুলোবালি মাখানো
মাটির বিছানায়
পড়ে থাকে মানুষের পায়ের কাছে, বসে থাকে নতমুখি।
সকাল-সন্ধ্যা কথা বলে সুঁইসুতার সাথে,
......................... পথের পিঁপড়ার সাথে।
দুপুরে ডেরা থেকে গামছায় বাঁধা ভাত আসে,
বউ আসে, পুলিশ আসে!
সারাদিন বিনীত নত মাথা নিচু করে পালিশ করে জুতো,
মন দিয়ে সেলাই করে স্বপ্ন, ছেঁড়া সেন্ডেল।
সেই জুতো-সেন্ডেল পরে
আমরা হেঁটে হেঁটে পাড়ি দেই
...........................ইতিহাস।
অথচ রবিদাস মুচির নিজেরই একটি পা নেই!
ফুটপাতে চটি বিছিয়ে মাটির সাথে মিশে বসে থাকে,
ভর দুপুরে বউ দেখে, ভর দুপুরে পুলিশ দেখে
তাঁর কোনোদিন আকাশ দেখা হয়না,
---------------------পাখি দেখা হয়না।
শুধু মাঝেমধ্যে ঘাড় উঁচু করে উপরে তাকিয়ে 'বাবু' বলে
আমাদের 'ভদ্দনোক'দের মুখ দেখেন,
আমরা তালগাছ!
----------
টরন্টো,
শিকাগো শহরটা আজ কিন্তু খুব বেশী দূরে নয়। শ্রমজীবী মানুষ বছরে একবার স্মরন করেই। বৈশ্বিক উন্নতির জামানায় বিশ্বের সব শহর এখন হাতের মুঠোয়। সাত সাগর তেরনদী পার হয়ে সুদূর কানাডার টরেন্টো শহরে বসেও কবি সাইফুল্লাহ মাহামুদ দুলাল বাংলা সাহিত্য বিকাশে তার মেধার শ্রম দিয়ে চলেছেন সার্বক্ষণিক। অবাকই হতে হয় সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হকের মৃত্যু হলেও আরেক সব্যসাচী কবি জাজ্বল্যমান। কতটা নিখুঁত দৃষ্টিশক্তি তাঁকে রবিদাসের চিত্র আঁকতে সাহায্য করেছে এটাই ভাববার বিষয়।
"শুধু দারিদ্রসীমার নিচে নয়; দাঁড়িয়ে থাকার সীমানার নিচেও
নীচুশ্রেণির রবিদাস মাথা নিচু করে সেলাই করে
............................. আমাদের পা এবং পাদুকা"
সময়ের কতটা আকুতি আর দরদমাখা মন থাকলে কবি চলে গিয়েছেন সমাজের নীচুতর মানুষের জীবন আর জীবীকার কাছে। একজন রবিদাস সমাজের প্রান্ত সীমানায় দাঁড়িয়ে তার থেকে উচুস্তরের মানুষ গুলোর পদসেবা করে চলছে নিরন্তর। রাস্তার পাশে, পথে, ধুলোবালুর মধ্যে অস্থায়ী কোন ঠিকানায় বসে রবিদাস জুতো সেলাই ও পলিশ করে নীচু মাথায়। ধরাপৃষ্ঠে তার মত মানুষ ছাড়া কারো সাথে তার সখ্যতা নেই কারো সাথে তার কথাবার্তা নেই। মনে মনে সে আউড়ে যায় কেবল মাত্র বেঁচে থাকার জন্য জন্য অদৃশ্য খাদ্যের সঙ্গে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কথাবার্তা হয় রবি দাসের সুই আর সুতোর সাথে তুচ্ছ ও সুক্ষপ্রাণী পিঁপড়ার সাথে সরবে নয় নীরবে, রূঢ় বাস্তবে আর কল্পনায়। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয় রবিদাসের বাড়ি নেই ঘর নেই। মাথা গুঁজবার হয়তবা কোন অস্থায়ী ঠাঁই আছে যেখানে জনম জনম দুঃখি প্রিয় মানুষ পোটলায় করে খাবার নিয়ে আসে, কিন্তু ভালোবেসে নয় পুলিশের রণচণ্ডী রূপ ধারন করে। প্রয়োজনের থেকে অতি অল্প অর্থ সংস্থানে রবিদাসের সংসারের ক্ষুণ্ণবৃত্তি হয়না। স্ত্রী তার সেজন্য রূদ্রমুখী থাকে সারাক্ষণ। কখনোই তার মনের যন্ত্রণা দূর হয় না। দরদী কবি তাঁর সাবলীল শব্দ বাক্যে লিখলেন,
""সারাদিন বিনীত নত মাথা নিচু করে পালিশ করে জুতো,
মন দিয়ে সেলাই করে স্বপ্ন, ছেঁড়া সেন্ডেল
সেই জুতো-সেন্ডেল পরে
আমরা হেঁটে হেঁটে পাড়ি দেই
...........................ইতিহাস।
অথচ রবিদাস মুচির নিজেরই একটি পা নেই!""
এখানে কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না। আমাদের সুখ স্বপ্নের সামান্য হলেও সেবার সু্যোগ রবিদাসের হলেও তাকে সেবা করা, তাকে ভালোবাসার মানুষের বড় অভাব। সারাদিন তাই নতমুখী রবিদাস মুচি অপরের জুতো সেণ্ডেল সেলাই করে গেলেও অব্যক্ত এক স্বপ্ন বুনে চলে সার্বক্ষণিক। যা অনুক্তই থেকে যায় রবিদাসের অম্তরে। কবি এখানে কতই না রূপকে ইংগিত করলেন, ""আমরা হেঁটে হেঁটে পাড়ি দেই ----- ইতিহাস।"" অথচ সৃষ্টির নির্মম পরিহাস রবিদাসের আনন্দ নেই। সে হাঁটতে পারেনা। একটা পা হীন রবিদাস আমাদের সমাজের পা সেলাই করে চলে অথচ নিজেই দাঁড়াতে পারেনা।
মাটির সাথে মিশে থাকা রবিদাস সমাজের অচ্ছুত প্রাণী। তাকে ছোঁয়া যায় না। তার কর্ম নেয়া যায়। প্রয়োজনে তাকে ব্যবহার করা যায়, তার পরিচয় দেয়া চলেনা। এ রকম হাজারো খেটে খাওয়া, নিরন্ন মানুষেরা দুপুরের রোদে রুদ্র মূর্তির অভাবী বউ দেখে। আকাশ দেখে না। আকাশ দেখার সময় তাদের হয় না। আনন্দে আকাশের পাখি দেখা হয় না। অবহেলা আর পিছিয়ে পড়া রবিদাসেরা কেবল সমাজের উচুতলার মানুষদের তালগাছ সদৃশ দেখে। কষ্টের মুজুরী নিতেও তারা নতমুখে হাত পাতে।
কবি সাইফুল্লাহ মাহামুদ দুলাল সহজ সরল শব্দ বাক্যে আধুনিক গদ্যরীতির কবিতাটির নামকরণ করেছেন ""রবিদাস এবং তালগাছ। "" একজন অসহায়, একটি পা হীন সমাজের প্রান্তসীমায় বসবাসকারী রবিদাসকে নিয়ে তাঁর প্রাণবন্ত লেখনিতে উঠে এসেছে এই সভ্য জগতেও একশ্রেনী বৈষম্যের শিকার, পীড়িত দুঃখী মানুষের চিত্র। এখনো এই চরম উন্নতির কালে শ্রেনী বৈষম্যে জর্জরিত সমাজটি ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের সাথে যু্দ্ধ করতে গিয়ে দিন চলে যায়। শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণের সময় কোথায়! কবি তার দরদী মন নিয়ে তুলে এনে সমান্তরালে উচু শ্রেনীর মানুষদের দিকে তাঁর প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। সার্থক কবির সার্থক রূপায়ন হলেও আঙ্গুল দিয়ে তিনি দেখিয়ে দিলেন এখনো ক্ষুধার রাজ্যে যুদ্ধরত মানুষের করুন চিত্র।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটা সময়ে এসে মনের চোখে দেখলেন তিনি নিজে কুলীন সমাজের হওয়ায় নিন্মস্তরের মানুষের কাতারে গিয়ে তাদের জীবন জীবীকা অবলোকন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। তাই তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বললেন, "মাঝে মাঝে গেছি আমি ও পাড়ার প্রাঙ্গনের ধারে ;
ভিতরে প্রবেশ করি, সে শক্তি ছিল না একেবারে।""
তিনি অনাগত বা আগামী দিনের কবির প্রতি তার ব্যর্থতা পূরণের আহবান জানিয়েছেন। ঘটনার একশত বছর পরে এসেও কি সে কবির দেখা আমরা পেয়েছি? উচুস্তর নীচুস্তর, দেশ থেক দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো আমার আলোচ্য কবি হয়তবা সে ব্যর্থতা পূরণ করে চলেছেন নিরলসভাবে। আমরা তাঁর দীর্ঘ সুস্থ সাহিত্য জীবন কামনা করি। চিরকাল বেঁচে থাকুন কবি আপনার সৃষ্ট কর্মের মাঝে।
********************************************