শব্দচয়ন নিয়ে লিখতে গেলে প্রথমেই মনে আসে ভবভূতি ও কালিদাসের সেই বিখ্যাত গল্পটি যেখানে একটি শুকনো কাঠের খণ্ডকে দেখে কেউ একজন বলছেন - “শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠতি অগ্রে” সেখানে কালিদাসের কথায় “নীরস তরুবর পুরতঃ ভাতি”। একই প্রকাশ ভিন্ন শব্দে। শব্দকে কবিতার শরীর বলা হয়। সুনির্বাচিত শব্দের সুপ্রযুক্ত বিন্যাসেই সার্থক কবিতার সৃষ্টি। এখানে কবির যেমন স্বাধীনতা আছে, আবার তেমনি যথার্থ মুন্সিয়ানার পরিচয় বিধৃত হবার পর্যাপ্ত অবকাশও রয়েছে এখানে। প্রত্যেক ভাষারই একটি নিজস্ব শব্দ-ভান্ডার রয়েছে। যে ভাষা শব্দ-সম্পদের দিক দিয়ে যত সমৃদ্ধ সে ভাষা তত উন্নত। বাংলার শব্দভাণ্ডার খুবই উন্নত। কোন ভাষায়ই প্রতিদিন নতুন নতুন শব্দ সৃষ্টি হয় না। ক্ষেত্র বিশেষে কালেভদ্রে দু’একটি নতুন শব্দের সৃষ্টি হয়। ব্যতিক্রমী প্রতিভার অধিকারী সৃজনশীল কোন কোন ব্যক্তি সজ্ঞানে দু’একটি নতুন শব্দ সৃষ্টি করেন। প্রচলিত কাব্যিক শব্দ এনু, গেনু, হিয়া, হেরি, হেন, মোদের, মম, মোরা, তব, পানে, যবে প্রভৃতি শব্দ বর্জন বর্তমানে কবিতা রচনার রীতি। আর কিছু শব্দ বিনা প্রয়োজনে ব্যবহারের একটা প্রবণতা আমাদের আছে, তবে, কিন্তু, তাই, এবং, আচ্ছা ইত্যাদি। এগুলি কবিতাকে মেদবহুল করে।
এবারে আসি শব্দচয়ন ও শব্দসজ্জার কারণে কবিতা দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে। আপাত দুর্বোধ্যতার এই প্রাসঙ্গিক কারণগুলি এবার আর একটু বিশদে খতিয়ে দেখা যাক।
★১। সাহিত্যের সব শাখাগুলির মধ্যে কবিতাসর্বাপেক্ষা পরিশীলিত। স্বভাবতই তার ধর্ম মিতকথন। সৎ কবি কখনোই অতিকথনে বিশ্বাসী নয়।
“ঘরে ফিরে মনে হয় বড়ো বেশি কথা বলা হলো?/ চতুরতা ক্লান্ত লাগে খুব?”
(মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়, শঙ্খ ঘোষ, ১৯৭৪)
প্রয়োজনের অতিরিক্ত শব্দ পাঠককে ক্লান্ত করে। আবার প্রয়োজনের তুলনায় কম শব্দ ব্যবহার কবিতাকে কখনও কখনও ধাঁধাঁয় পর্যবেসিত করে।
★২। ইঙ্গিত এবং সংকেত কবিতাকে রহস্যময় করে। সার্থক কবিতায় তাদের ব্যবহার অপরিহার্য। অথচ পাঠক যদি সেগুলি ডিসাইফার করতে অপারগ হন তাহলে সে কবিতা অচেনাই থেকে যায়। অন্যদিকে কবির দায়িত্ব সেই সঙ্কেতগুলি এমনভাবে ছড়িয়ে রাখা যাতে সেগুলি নিরবচ্ছিন্নভাবে এবং নির্দ্বিধায় পাঠককে সমাধানের দিকে নিয়ে যায়।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের “এক অসুখে দুজন অন্ধ” কবিতার শেষ দুটি লাইনে পৌঁছোতে পৌঁছোতে ঠিক কোন দু’জন একই অসুখে অন্ধ পাঠক মোটামুটি আন্দাজ করে ফেলে।
“এক অসুখে দুজন অন্ধ! / আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ।” (হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান, ১৯৬৮) একজন বহির্মুখী বোহেমিয়ান বালিতে আধ-কোমর বন্ধ করে রোদ পোহায়। অন্যজন হল্লা-হাওয়া সামলে, পাল্লা-আগল বন্ধ করে মাটিতে শিকড় নামায়। সমুদ্রের আমিষ গন্ধে দুজনেই তোলপাড়।
★৩। কবিতায় প্রতীকের ব্যবহার চলে আসছে আদি অনন্তকাল ধরে। তবে আধুনিক কবিতায় প্রতীক চোখে আঙ্গুল দিয়ে উপমাটি চিনিয়ে দেয় না। বরং যে-দুটি বস্তুর মধ্যে তুলনা করা হচ্ছে তার মধ্যে একটিকে অনুক্ত রাখতেই সে বেশি আগ্রহী। এই কুয়াশার মধ্যে দিয়ে গন্তব্যর রাস্তাটি খুঁজে নেবার দায়িত্ব কিন্তু সংবেদী পাঠকের।
যেমন ধরা যাক শ্রীজাতর “এই শহর, এই সময়/ নিয়মমাফিক” কবিতার প্রথম দু লাইন।
“কলকাতায় নিয়মমাফিক সন্ধে হলেই/
পাথর নেমে আসবে বুকে সন্দেহ নেই।” (উড়ন্ত সব জোকার, ২০০৩)
পাঠক অনুমান করে নেয় এই পাথর হয়তো আদতে বিষাদ।
★ ৪। অতিরিক্ত মাত্রায় প্রতীকের ব্যবহার কবিতাকে অর্থহীন করে তোলে। সঙ্গতিহীন বিকল্প শব্দের ব্যবহার তাকে ভারাক্রান্ত করে। প্রয়োজন হয়ে পড়ে কবিতা অভিধানের। তাই শব্দ যতই অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত হোক না কেন, তার অর্থবহ হয়ে ওঠা অত্যন্ত আবশ্যিক।
★৫) আশির দশকে উত্তরাধুনিক ভাবনায় ভাষাকে মনে করা হয় কেবল মাত্র চিহ্নর সমাহার। শব্দর অর্থ নির্ভর করে দুটি শব্দর চিহ্ন কতখানি আলাদা তার উপর। ডিকন্সট্রাকশন যে শুধু দুটি শব্দের চিহ্নকে পৃথক করে তাই নয়, নতুন শব্দ সৃষ্টির দাবি রাখে। সেগুলিকে অতিক্রম করতে গেলে সযত্ন চিন্তার প্রয়োজন। শ্রীজাতর উড়ন্ত সব জোকার কবিতার শেষ দুলাইন সম্ভবত এই সতর্ক প্রয়োগের কথাই মনে করিয়ে দেয়, ‘জীবন কিন্তু প্রেমদিওয়ানা সাবধানে তার গায়ের গন্ধ শুঁকো -’/ বলছে আমায় উড়ন্ত দুই পাগলা জোকার – দেরিদা আর ফুকো। (উড়ন্ত সব জোকার, ২০০৩) প্রত্যেক সত্যের উলটো পিঠে কিন্তু অসত্য থাকে না। থাকে অন্য সত্য।
★৬) অনেক সময় কোনো অপরিণত কবি বা কবিগোষ্ঠী ইচ্ছাকৃত দুর্বোধ্যতার আড়ালে নিজের (নিজেদের) অক্ষমতা ঢেকে রাখতে চান। গোষ্ঠীর একে অন্যের পৃষ্ঠ কণ্ডূয়ন করে নাবালক মতটিকে প্রতিষ্ঠা করতে চান। এটি পাঠকের সঙ্গে তঞ্চকতা।
চিত্রকল্প, রূপকল্প
==============
চিত্রকল্প আন্দোলন গত শতকের বিশ দশকের মাঝমাঝি সময়ে ‘Imagist Anthology’ (১৯১৪) প্রকাশের মাধ্যমে আমেরিকাতে সূচিত হয়েছিলো। এমি লাওয়েল, পাউন্ড, এইচ. ডি এবং বৃটিশ কবি রিচার্ড অলডিংটন ছিলেন এর প্রবক্তা ও আদি কবি। পাউন্ডের মতে, এই ইমেজ কোনো বুদ্ধিদীপ্ত বা ভাবোদ্দীপক জটিলতারই প্রকাশ। এই কবিকূল ক্যামেরায় ছবি তোলার মতো কোনো কিছুর সরাসরি উপস্থাপনে বিশ্বাসী ছিলেন না। কবিতায় এতৎকাল যে সংবেদনশীলতার প্রাধান্য ছিলো তার জায়গায় ইমেজ প্রাধান্য পেল। তবু আবেগ থেকে পালাতে পারেননি তাঁরা। মন্ময় ও তন্ময় বিষয়ে এলো সরাসরি উপস্থাপন ও বিষয়কে সমৃদ্ধ করে না এমন শব্দাবলী বর্জিত হলো। অবশ্য ইমেজ বা চিত্রকল্প সব যুগে সকল কবিদের কবিতাতেই ছিলো ও আছে। ইমেজ ছাড়া কবিতা হয় না। তবে ইমেজিস্ট আন্দোলন পূর্ববর্তী সনাতন/ আধাসনাতন কবিরা মুখ্যত প্রত্যক্ষ ছবি আঁকার মাঝেই আবেগ ছড়িয়ে দিতেন। একে বলা যায় visible image বা দৃশ্যমান চিত্রকল্প। ওয়ার্ডসওয়ার্থ, রবার্ট ফ্রস্ট, রবীন্দ্রনাথ সহ অনেক কবির কবিতায় এরই দুর্দান্ত প্রকোপ লক্ষ্য করি। তাঁরা নিজ নিজ কাব্যস্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে শব্দমালা দিয়ে সরল ও দৃশ্যমান চিত্রকল্প এঁকেছেন। ইমেজিস্ট আন্দোলন পরবর্তী আধুনিক কবিতায় বহুব্যবহৃত দৃশ্যমান চিত্রকল্পের পাশাপাশি অদৃশ্যমান চিত্রকল্প (invisible image) ও বিমূর্ত চিত্রকল্প (abstract image ) দেখা যায়। অপরদিকে উত্তরাধুনিক কবিতায় এসব চিত্রকল্প যেমনি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, তেমনি অসম্পূর্ণ বা ভাঙা-ভাঙা চিত্রকল্পও প্রচুর থাকে। অদৃশ্যমান/বিমূর্ত চিত্রকল্প দৃশ্যবহির্ভূত, যা চোখে দেখার মতো বা ষ্পর্শনীয় কিছু নয়। বাস্তবের রংয়ে নয়, শুধুই অতিকল্পনার রংয়ে আঁকা। হৃদয় থেকে উৎসারিত এসব ব্যতিক্রমী ছবি বাস্তবে অসম্ভব। তাহলে কী দৃশ্যমান চিত্রকল্প কবির হদয় থেকে আসা ভাষা নয়? ওটাও হদয়জ চিত্রকল্পই, তবে এর সাথে সংশ্লিষ্ট ছবিগুলো বাস্তবে সম্ভব। চিত্রকল্প ছড়িয়ে থাকে কবিতার পরতে পরতে। চিত্রকল্পগুলো কবিতাটিকে একটি মালার মতো গেঁখে রাথে, যা চোখ ও হৃদয় দুটোকেই আবিষ্ট করে। কবিতায় সৃষ্ট নিজস্ব চিত্রকল্প কবিকে বিশিষ্টতা দেয়। লক্ষ্য করে থাকবেন যে, কোন ছন্দ ও অলঙ্কার ছাড়া বা এসব অল্প ব্যবহার করে কেবল সমৃদ্ধ সব চিত্রকল্পের সাহায্যে অহরহ আধুনিক কবিতার স্তবক নির্মিত হচ্ছে। চিত্রকল্প ছাড়া শুধু শাব্দআবহে কবিতা ঋদ্ধ হয় না। অনেকের মতে, চিত্রকল্পই কবিতা। কবিতার চিত্রকল্পগুলো শব্দমালা দিয়েই আঁকা। রং ও তুলির আঁচড় ছাড়া যেমনি ছবি আঁকা সম্ভব নয়, তেমনি শব্দের বুনট ছাড়া চিত্রকল্পও সৃষ্টি হয় না। তাঁর সাথে যুক্ত হয় কবির হৃদয়াবেগ ও ধীশক্তি।
কিছু তুলনামূলক দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন:-
(কবিরা তাঁদের মনের মাধুরী মিশিয়ে নানা ভাবে ও ব্যঞ্জনায় ইচ্ছেমতো চিত্রকল্প নির্মাণ করেন। এখানে শুধু বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য একভাবে উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে।)
১.
সাধারণ চিত্র : “মেঘে মেঘে আজ বিকেলটাই মাটি হয়ে গেলো”।
চিত্রকল্প : “মেঘের ঢাকনার নিচে আটকে গেছে সুখময় গোধূলির প্রেম”।
২.
সাধারণ চিত্র : “ভারতে লেগেছে আজ উন্নয়নের ছোঁয়া, কোরিয়াও বসে নেই”।
চিত্রকল্প : “বসরার গোলাপ আজ ভারতে ফোটে, কোরিয়া সাগরে খেলে পশ্চিমের আভা”।
৩.
সাধারণ চিত্র : “ছেলেটি আর মেয়েটিরক চোখাচোখি হলো”।
চিত্রকল্প : “ছেলেটি নিজেকে ঢেলে দিচ্ছে মেয়েটির চোখে”।
( এই অংশটি আবুল কাইয়ুম-এর কবিতা প্রসঙ্গঃ ছন্দ ও ছন্দাতীত এর অংশবিশেষ থেকে নির্মিত)
রূপকঃ
=========
রূপ নির্মানে চাতুরতার আশ্রয় নিয়ে যখন বিষয় উপস্থাপিত হয়, তখন তার নাম হয় রূপক অথবা আসল ঘটনা শিল্পের মাধ্যমে দর্শকের কাছে পৌছে দেবার জন্য যার সাহায্য নেওয়া হয় তাকে রূপক বলে। রূপকের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই, মানুষ যখন চাক্ষুস বাস্তবের উপস্থাপন প্রকৃ্তিবাদ(Naturalism) এর মধ্য দিয়ে করতে পারে না তখন সে নানা ধরনের রহস্যবাদী সংকেতের সাহায্য নেয় যা মূল গল্প বা ঘটনা থেকে সরে গিয়ে কোন পরোক্ষ্ অবলম্বনের মধ্যা দিয়ে প্রকাশিত হয়। অন্যভাবে বলা যায় কোন একটি সংকট পরিস্থিতিতে মানুষ যখন কোন ঘটনা বা বিষয়কে দর্শকের সামনে সরাসরি ব্যক্ত করতে পারে না তখন সে একধরনের সাংকেতিক কাহীনি তৈ্রি করে, যার লক্ষ্য হয় একটি ভাব বা দর্শনের বহিঃপ্রকাশ। তবে রুপকের ক্ষেত্রে মূল ঘটনা বা পরিস্থিতি জানা না থাকলেও বর্ণিত বা চিত্রিত রূপের আস্বাদন দর্শক বা শ্রোতা করতে পারে। কিন্তু সেই সাথে যদি মূল ঘটনা বা লক্ষ্য জানা থাকে তবে তাহলে রূপকের রসাস্বাদন সম্পূর্ণ হয়।
রূপক কবিতা হল যে কবিতার রূপ নির্মানে বিভিন্ন ধরনের চতুরতা বা কৌশল অবলম্বন করা হয় তাকে রূপক কবিতা হলে। রূপক কবিতায় রহস্যবাদী সংকেত বা ভিন্ন কোনো গল্প বা ঘটনার মাধ্যমে বাস্তব চিত্র বা প্রকৃত ঘটনা প্রকাশিত হয়। অন্যভাবে বলা যায় যে কবিতায় কোনো পরোক্ষ ঘটনা বা বিষয়বস্তুকে সামনে এনে তার আড়ালে বাস্তব কোনো থিম, ভাব বা দর্শনের বহিঃপ্রকাশ করা হয় তাকে রূপক কবিতা বলে।
যেমনঃ সোনার তরী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উত্তম ও অধম – সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, একটি মোরগের কাহিনী – সুকান্ত ভট্টাচার্য, আলালের ঘরের দুলাল – সুভাষ মুখোপাধ্যায়
উপমাঃ
=======
উপমা শব্দের অর্থ সাদৃশ্য, তুলনা, অর্থালঙ্কারবিশেষ। কবিতাকে পূর্ণতা দেয় উপমা। উপমা কখনো ইঙ্গিতকে অধিকতর ইঙ্গিতবহ করে তোলে। তাতে কবিতার দেহে তৈরি হয় লুকোচুরি খেলা। উপমা কখনো কবিতাকে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ করে তোলে। কবিতায় উপমা তৈরি করে আড়। আড়ের কারণে কবি শক্ত কথাও সহজে বলতে পারেন অবলীলায়। উপমার আড় কখনো বাঁচিয়ে রাখে কবিতার প্রাণ। বাংলা কবিতায় উপমার প্রলেপ আদিযুগ হয়ে বর্তমানের অপূর্ণ দ্বিতীয় দশক অবধি বহাল তবিয়তে আছে। লুইপা'র একটি চর্যায় আমরা পাই-
কাআ তরুবর পাঞ্চবি ডাল।
চঞ্চল চীএ পইঠো কাল
এখানে দেহের উপমা হচ্ছে তরু। এমন এক তরু যার পঞ্চশাখা। অর্থাৎ দেহ হচ্ছে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের তরুর ন্যায়। চিত্ত চঞ্চল হলে এই পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়েই কালে বা সময়ে কাল বা রিপু দেহে অনুপ্রবেশ করে।
বাংলা সাহিত্যের বিরহী কুসুম মহাকবি মাইকেল। বিরহ মায়ের সাথে, বিরহ জন্মভূমি, জন্মভিটা আর শৈশবের নদী কপোতাক্ষের সাথে। তাঁর কবিতায় উপমারা মূলত অর্থের সম্প্রসারণবোধক হয়েই দেখা দিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের উপমারা চিত্রকল্প নির্মাণে অব্যর্থ। বর্ণনার আতিশয্য নেই, উচ্ছ্বাসের ঘনঘটা নেই কিন্তু উপমার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত চিত্রকল্পটি যেন অবনীন্দ্রনাথের চেয়ে সমৃদ্ধ দক্ষতায় উপমার দ্বারা পরিস্ফুটিত হয়ে যায়। 'মানসী' সকল দিক থেকে কবিগুরুর অতিনন্দিত এক কাব্যগ্রন্থ। এই গ্রন্থেরই 'নিষ্ফল কামনা' কবিতাটিতে সন্ধ্যার বাতাসের স্বরূপ তুলে ধরতে যে উপমাকে ব্যবহার করেছেন তা কেবল সন্ধ্যার বাতাসের জন্যেই যেন নির্মিত।
চল্লিশের সমাজতন্ত্রী কবিরা উপমাকে সমাজতন্ত্রে ধারণ করেন নির্মোহ ভাবে। তাদের উপমায় চিরাচরিতভাবেই ফুটে উঠেছে কাস্তে-হাতুড়ি আর লাল ঝাণ্ডার আদর্শ। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য কিংবা সমর সেনের কবিতায় উপমারা সমাজতন্ত্রী লেবাসে আমাদের সামনে চলে আসে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর কবিতায় প্রেয়সী আলোর পাশাপাশি আঁধারের আলপথ বেয়ে লাল টুকটুকে দিন আনার কথা বলেছেন। কবি সুকান্ত কৃষক বধূর চোখে সবুজ ফসলে সোনালি যুগ প্রত্যক্ষ করেন। আদর্শে সমর সেন সুভাষ আর সুকান্তের চেয়ে বেশ শক্ত। তাঁর উপমা শোষিত আর শাসককে আলাদা করে তোলে দৃঢ়ভাবে। 'শাসক' কবিতায় সমর সেন যখন বলেন, 'অপরের শস্যলোভী পরজীবী পঙ্গপাল; তখন বুঝতেই হয়, পরজীবী শোষক কৃষক-শ্রমিকের শ্রম-ঘাম শুষে ফুলে ফেঁপে বড় হয়।
উপমায় কামজভাব নিয়ে আসেন কবি আল মাহমুদ। পরম প্রেমে কিষাণ যখন ক্ষীরের মতো গাঢ় নরম মাটিতে রুয়ে দেয় ধান তখন কবির কাছে তা হয়ে উঠে কিষাণীকে নিবেদিত প্রেমের শামিল। উপমা এখানে প্রেম ও কামের এক মহৎ ভাবকে বিজ্ঞাপিত করে।
আশির দশকের উপমারা কখনো আধুনিক, কখনো ব্রাত্য। কবি মারুফ রায়হান এই দশকে কবিতাকে নতুনরূপে দেখতে চান। তার কবিতা হবে প্রাচীন প্রস্তরভেদী জলের মতো। সর্বত্র তার প্রবাহ থাকবে, সকল প্রাচীনত্বে সে আনবে নবধারা প্রাণ। তাই প্রস্তরভেদী জল এখানে ধারণ করে উপমার আধুনিকতা। বাঙালি সমাজে ব্রাত্য হয়ে আছে কৃষক আর তার গরু। আশির দশকের কবি রেজাউদ্দিন স্ট্যালিনের উপমায় গো-ক্ষুর-এর মতো বিভাজিত সময় আর কালো কৃষকের পায়ের মতো ফাটা মুহূর্তগুলো অবহেলিত জীবনকে তুলে আনে নান্দনিকতায়। ব্রাত্য জীবনের উপমায় কবিতা হয়ে উঠে জীবন-সঙ্গীত।
উপমা কবিতার কেবল অলঙ্কার বা ভূষণ তাই নয়, উপমা কবিতার এক শক্তিশালী হাতিয়ার। কবিতায় যথা কথা যথাভাবে বলার জন্যে উপমা এক নান্দনিক আড়াল, উৎকৃষ্ট মাধ্যম। উপমা কখনো বল্লমের তীক্ষ্নতা ধারণ করে, উপমা কখনো মলমের উপশম প্রদান করে। সহজ কথা সহজভাবে না বলতে পারলে উপমারা হয়ে উঠে সর্বশেষ করণ। উপমা কবিতার জন্য এক আবশ্যক উপাদান। অবয়বে উপমা খানিকটা স্থূলতা আনলেও কার্যে আনে শিল্প, বোধে আনে অতুলন সৃজনশীলতা। বাংলা কবিতায় আদি যুগে আধ্যাত্মিকতা ধারণকারী উপমা নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে ধারণ করেছে অপার্থিব বিমূর্ততা। উপমা তাই যুগজীর্ণতা দূর করে কবিতার প্রাচীন প্রাচীরে এনেছে নবধারা জল। উপমার গুণে কবিতা আজ হয়ে উঠেছে এক অনতিক্রম্য শিল্প।
প্রতীকঃ
=========
প্রতীক হলো এমন কিছু, যা তার নিজ রূপের আড়ালে অন্য আলাদা কিছু, অন্য আলাদা সত্তার ইশারা করে। সিম্বলিজম এর বাংলা পরিভাষা প্রতীকধর্মীতা. ফরাসি তথা সাহিত্যের জগৎ এর প্রথম আধুনিক কবি ‘ চার্লস বোদলেয়ার "(১৮২১- ১৮৬৭).তাঁর রচিত "দ্যা ফ্লাওয়ার অফ ইভিল" গ্রন্থটির মধ্যে সিম্বলিজম এর বীজ বপন ছিলো। এটি রচিত হয় ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দে। তার মৃত্যুর কয়েক বছর পর সিম্বলিজম আন্দোলনের সূচনা হয়। সিম্বলিজম আন্দোলনের ঋত্বিক মালার্মে হলেও এই আন্দোলনের প্রবক্তা ছিলেন জাঁ মোরেয়াস। সিম্বলিজম শব্দটির নতুন অর্থব্যঞ্জনায় প্রথম ব্যবহার করেছিলেন জাঁ মোরেয়াস "লে ফিগারো"(Le Figaro) পত্রিকায় 1886 খ্রীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে। এর পর আত্মসচেতন ভাবে ফরাসিতে মালার্ম, ভালেরি, ভর্লেন, মোরেয়াস সিম্বলিজম আন্দোলন করেন। পরবর্তী কালে এই আন্দোলনের প্রভাব ফরাসি থেকে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ইঙ্গ-মার্কিন ও ইউরোপ এ ছড়িয়ে পড়ে।
একদিক থেকে দেখলে সিম্বলিস্ট কাব্য রোমান্টিশিজম এর উজ্জ্বল উত্তরাধিকার বহন রয়েছে। সিম্বলিজম কবিতায় উঠে আসছিলো ব্যক্তিগত প্রতীক। এই কবিতা গুলির গভীর ব্যঞ্জনার সঠিক অর্থ উন্মোচন করতে পারে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও ধ্যানী ব্যক্তিবর্গ । তাছাড়া এর সঠিক অর্থ কেউ না বুঝিয়ে দিলে তা কারোর কাছে বোধগম্য হয়ে উঠতে অনেক সময় লেগে যায় । সিম্বলিজম এ কবি যা ভাবেন তার প্রতীকি হিসেবে ব্যবহার করে কবিতার মধ্যে এক অন্য চিত্র সৃষ্ট করেন। বাংলা সাহিত্যের জগৎ এ রবীন্দ্রনাথের কবিতায় প্রতীকের ব্যবহার থাকলে ও আসলে তা ব্যঞ্জনা ছাড়া আর কিছু নয় । রবীন্দ্র পরবর্তী আধুনিক কবি তথা তিনের দশকের কবিগন আত্মসচেতন ভাবে প্রতীকধর্মী কবিতা রচনা করেন.জীবনানন্দ দাশ (বিড়াল, বোধ, বনলতা সেন, হায় চিল), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (উটপাখি,শাশ্বতী) ,শক্তি চট্টোপাধ্যায় (অবনী বাড়ি আছো) বিনয় মজুমদার। এছাড়াও অনেকেই প্রতীকধর্মী কবিতা রচনা করেছেন। প্রতীকধর্মী কবিতায় মুল বৈশিষ্ট্য কবিতার দুর্বোধ্যতা নয়, অলীক ভাবনার সৃষ্টি । বর্ননীয় বিষয় এর মুল বিষয় কে একই রেখে প্রতীক আনবে।
★বন্ধুগন, ভালো লাগলে বলবেন, তাহলে আরো কিছু বলবো।★