বন্ধুরা প্রথম পর্বে কোন ভূমিকা ছাড়াই গদ্য কবিতা ছন্দ কবিতা আর কবিতার সংজ্ঞা নিয়ে সামান্য আলোকপাত করেছি। আজও ছন্দ নিয়ে বিশেষ করে গদ্যছন্দ নিয়ে থাকবো। তবে তার আগে সাহিত্য কি, পদ্য ও ছড়া নিয়েও সামান্য বলবো।

আসলেই সাহিত্য কী ?
=================
মানুষের দুটি দিক - শরীর ও মন। এই মনের চর্চাকে বলা হয় মনন। মানুষ তার জান্তব সত্তা থেকে ক্রমে মানব সত্তায় উত্তরণ ঘটাতে সক্ষম হলো যখন সে কথা বলতে শুরু করলো। রাতারাতি মানুষ কথা বলে নি। ঐক্যবদ্ধ শিকারের সময় শব্দের সংকেত দিয়ে শুরু। ধীরে ধীরে তা রূপান্তরিত হয় সংগঠিত সজ্জায়। শুরু হলো কথা। এই কথার বিনিময়ে তার ভাবনার ক্রমোন্নতি ঘটল। যা রূপ নিল গোষ্ঠীবদ্ধ পারস্পরিক ব্যবহারে। যাকে বলা হয় সংস্কৃতি। মানুষ কখনই থেমে থাকে নি। তাদের কার্যাবলী শুধুমাত্র খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান আর যৌনতার মধ্যে সীমায়িত থাকল না। শুরু হল তাদের মনন বা ভাবনার বিচ্ছুরণ। জন্ম নিল চিত্রাঙ্কন, প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় প্রতিরূপ নির্মাণ, সঙ্গীত যাকে বলা হল শিল্প। ক্রমে তারা তাদের কথাকে এই অঙ্কন ও প্রতিরূপ নির্মাণের মাধ্যমে স্থায়ী করতে শিখল। জন্ম নিল লিপি। তারা তাদের কথার ঔৎকর্ষকে লিপিবদ্ধ করতে শুরু করল যা হল শিল্পের একটা ভাগ। তার নাম সাহিত্য। ক্রমে সাহিত্যের ধারার অগ্রগতি হল। তৈরি হলা আলাদা চরিত্রাবলী। জন্ম নিল গদ্য, পদ্য ও নাটক। গদ্য সম্পর্কে ঐতিহাসিক রিচার্ড গ্রাফ লিখেন, "প্রাচীন গ্রিসের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায় যে, গদ্য তুলনামূলকভাবে অনেক পরে বিকশিত হয়েছে”। আগে মানুষ সৃষ্টি করেছিল পদ্য। পদ্যচর্চাই হয়েছে দীর্ঘকাল।

গদ্য হলো ভাষার একটি রূপ, যা সাধারণ পদবিন্যাস ও স্বাভাবিক বক্তৃতার ছন্দে লেখা হয়। সাহিত্যের আরেকটি ধারা হচ্ছে নাটক। নাটক হলো এমন এক ধরনের সাহিত্য, যার মূল উদ্দেশ্য হলো তা পরিবেশন করা। সাহিত্যের এই ধারায় প্রায়ই সঙ্গীত ও নৃত্যও যুক্ত হয়, যেমন গীতিনাট্য ও গীতিমঞ্চ।

তাহলে জানতে পারি পদ্য কীঃ
=====================
  পদ্য হলো সাহিত্যিক ধারার একটি রূপ, যা কোনো অর্থ বা ভাব প্রকাশের জন্য ভাষার নান্দনিক ও ছন্দোবদ্ধ গুণ ব্যবহার করে থাকে। এককথায় পদ্য হচ্ছে শব্দ প্রয়োগের ছান্দসিক কিংবা অনিবার্য ভাবার্থের বাক্য বিন্যাস। অর্থাৎ ছন্দ এখানে আবশ্যিক শর্ত। পদ্যের আবার দুটি ধারা আছে –
  ১) ছড়া
  ২)কবিতা।  

ছড়ার প্রথম শর্ত, ছড়া ছন্দ মেনে লিখতে হবে।

অন্ত্যমিল থাকা বাঞ্ছনীয় এবং সহজ শব্দের সমন্বয় সাধন। ছড়া লিখতে গেলে পদে পদে মিল থাকাটা বেশ জরুরী। সাধারণত ছড়া হাস্য রসাত্মক, শিক্ষামূলক, ব্যঙ্গার্থক হয় এবং ছড়া মূলত লেখা হয় শিশুদের জন্য।
অন্নদাশঙ্কর রায় ছড়া সম্পর্কে বলছেন ‘ছড়া যদি কৃত্রিম হয় তবে তা ছড়াই নয়, তা হালকা চালের পদ্য। তাতে বাহাদুরি থাকতে পারে, কারিগরি থাকতে পারে, কিন্তু তা আবহমানকাল প্রচলিত খাঁটি দেশজ ছড়ার সঙ্গে মিশ খায় না। মিশ খাওয়ানোটাই আমার লক্ষ্য। যদি লক্ষ্যভেদ করতে পারি তবেই আমার ছড়া মিশ খাবে, নয়তো নয়।’

এবার আসি আবার ছন্দ সম্পর্কে
========================
ছন্দবিশ্লেষক,সাহিত্য সমালোচক প্রবোধচন্দ্র সেন আধুনিক গদ্যকবিতা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন: “মাত্রাবিন্যাসের নীতিকে লঙ্ঘন করলে পদ্য আর পদ্যই থাকে না, সে হয়ে ওঠে গদ্য। কিন্তু কবিরা অনুভব করলেন যে, বিশেষ মাত্রাবিন্যাসের ব্যবস্থার ফলে পদ্যে যে ধ্বনিগত তরঙ্গায়িত ভঙ্গি বা ধ্বনিস্পন্দন জেগে ওঠে, সেই স্পন্দন বা ধ্বনি ভঙ্গিটুকুকে রক্ষা করে যদি নির্দিষ্ট মাত্রাবিন্যাসের বন্ধনকে এড়ানো যায় তাহলে একরকম স্পন্দনমান গদ্যের উদ্ভব হয় যাকে ক্ষেত্রবিশেষ অনায়াসেই কাব্যভাবের বাহনরূপে স্বীকার করে নেওয়া যায়।এইরূপেই আবির্ভূত হলো গদ্যকবিতা।
গদ্যকবিতার এই যে ধ্বনিভঙ্গি বা স্পন্দনলীলা, তাকেই বলা হয়েছে ‘গদ্যছন্দ’।
…পদ্যের রঙ লাগা গদ্যই হচ্ছে গদ্যকবিতার বাহন। গদ্যে ও পদ্যের রঙ লাগে যে কণ্ঠস্বরের প্রভাবে, সে কণ্ঠস্বর বস্তুত ভাবেরই দ্যোতক। এই ভাবাবেগের ফলেই গদ্যকবিতায় ভাষা স্পন্দিত হয়ে ওঠে পদ্যের মতো।
… গদ্যকবিতার ভাষায় পদ্যের ন্যায় মাত্রাবিন্যাসের সুনির্দিষ্ট নীতি ও পরিমাণ রক্ষিত হয় না, কিন্তু তাতে কবিতার ভাবস্পন্দনটুকু রক্ষিত হয়। সাধারণ গদ্যের সঙ্গে কবিতার গদ্যের পার্থক্য এখানেই।”

★প্রবোধচন্দ্র সেন ও মাহবুবুল আলমের বক্তব্যের মাধ্যমে গদ্য ছন্দের মূল প্রকৃতিটা ফুটে উঠেছে। এই প্রকৃতিকে ধারণ না করেই বাংলা ভাষাভাষী নবীন প্রবীন অনেকেই গদ্যকবিতার গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিতে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন ইদানিং। যা বাংলা কাব্য সাহিত্যের জন্য সবুজ সংকেত আশা করা যায় না। এটা দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতিরই নামান্তর।

★মনে রাখতে হবে কোন কাজই ছন্দহীন নয়। ছন্দ মূলত অদৃশ্যমান একটি জিনিস। যা প্রতিটি বিষয়ের অন্তর্নিহিত একটি Power বা শক্তি,দ্যোতনা। প্রত্যেক মানুষের জীবনেও এর অস্তিত্ব বিদ্যমান।
ছন্দ মূলত একটি পরিমিতি বোধ বা পরিমিতি জ্ঞান, একটা শৃঙ্খলা, একটা স্রোতধারা। যা আমাদেরকে গন্তব্যের শেষ প্রান্তে অবলীলালায় পৌঁছে দেয়।

একজন বাস চালকের কথা ভাবুন- খুলনা থেকে ঢাকা পর্যন্ত যেতে তার বাসকে কতোভাবে কতো বুদ্ধিমত্তার সাথে নিয়ন্ত্রণ করেন-ঐ নিয়ন্ত্রণ কৌশলটাই তার ছন্দ। একজন বৈমানিক আকাশ পথে যানজটের ভয় না থাকলেও প্রাকৃতিক পরিবেশ বা অন্যান্য বাঁধা বিপত্তিকে মাড়িয়ে যাত্রীও বিমানকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্যে বাস চালকের মতো নয়, তার মতো করে প্রতিষ্ঠিত গাইড লাইন মাফিক বিমানকে পরিচালনা করে থাকেন। বিমান চালকের দূরদর্শিতাই তার ছন্দ।গদ্য কবিতার ভেতরেও অনুরূপ ছন্দ থাকবে, যা অন্ত্যমিল প্রধান ছড়া কবিতার মতো অনেকের কাছেই (যাদের ছন্দ জ্ঞান নেই) ছন্দটা দৃশ্যমান হবে না, ছন্দকে তারা আবিষ্কার করতে পারবেন না। তাদের এই অক্ষমতাই ভ্রান্ত পথেই তাদের ধাবিত করছে।

প্রকৃত পক্ষে ছন্দ ছাড়া কবিতার অস্তিত্ব নেই,থাকবে না। যারা বলেন: গদ্য কবিতার ছন্দ নেই, তারা মারাত্মক ভুলই বলেন। গদ্যছন্দ মানে ছন্দহীনতা নয়। ছন্দ অবশ্যই থাকবে। সেটা ধরার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে আমাদের। আমাদের অনেক অগ্রজের মানসম্পন্ন কালোর্তীর্ণ গদ্যকবিতা (ছন্দোবদ্ধ) রয়েছে, যা সাধারণ পাঠকের কাছে, নবীন কবির কাছে ছন্দহীন মনে হতে পারে।গদ্য কবিতায় মূলত মুক্তছন্দের প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। আর মুক্তছন্দটা নির্ভর করে-অক্ষরবৃত্তের পরিবর্তিত রূপের ওপরই।অর্থাৎ অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কাঠামোতেই গদ্যছন্দ বা মুক্তছন্দের বিস্তার বা প্রসার। যখন অন্ত্যমিলীয় রীতিতে অক্ষরবৃত্তের ব্যবহার করা হয় তখন প্রতি চরণে নির্দিষ্ট মাত্রা বসানো হয়।
(একটু দেখানোর চেষ্টা করি।  বন্ধুগন এ অংশটা ভালো না লাগলে এড়িয়ে যেতে পারেন)
★ যার শুরুটা হয় সাধারণত ১৪ মাত্রা দিয়ে (৮+৬) । এছাড়া ১৮ মাত্রা (১০+৮), ২২ মাত্রা (১২+১০) এই মাত্রাকেন্দ্রিক পর্ব বিভাজনও  আবশ্যকীয় নয়। তবে সঙ্গতিটা ধরে রাখতে পারলে চমৎকারীত্ব আসে, ভিন্ন আবেগ বা দ্যোতনা সৃষ্টি হয়, কবির সৃজনশীলতা দীপ্ত হয়।এর বাইরে চরণের মোট মাত্রা ৬,১০, ১৪, ১৮, ২২, ২৬, ৩০, ৩৪ করেও সাজানো যায়। কখনো কখনো আধুনিক কবিগণ এক চরণে ০৮ মাত্রা দিয়ে পরের চরণে ১০ মাত্রা দিয়ে মাত্রার কাঠামো ০৮+১০=১৮ ঠিক রাখেন। আবার প্রথমে ১২+পরে১০মাত্রা দিয়ে ২২মাত্রার হিসেব করেন। কখনো ১৬+১০/ ১৮+১২=৩০/ ২০+১৪=৩৪ দিয়ে মাত্রার হিসেব ঠিক রাখেন।গদ্য কবিতায় মুক্তছন্দের নামে মূলত এই জাতীয় হিসেবকে বিবেচনা করা হয়। যেখানে মুক্তাক্ষর এক মাত্রা বিশিষ্টি হয় এবং বদ্ধাক্ষর শব্দের শেষে ব্যবহৃত হলে দুই মাত্রা বিশিষ্ট হয় (তিন জায়গায় ব্যতিক্রম হয়ে থাকে: কথ্য ক্রিয়াপদ, নির্দেশক পদ এবং সমাসবদ্ধ পদ, যেখানেই বদ্ধাক্ষর বসুক দুই মাত্রা হিসেব ধরা হবে।)।

মুক্তছন্দ সাধারণত স্বরবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্তের বাঁধনে বাঁধা যায় না। কারণ স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের পর্ব মাত্রার চালটা একবারেই নিয়ন্ত্রিত, অংকের মতো, বিজ্ঞানের সূত্রের মতো। অক্ষরবৃত্তের উদার নীতিই তাকে গদ্য ছন্দের বাহন করেছে। আমরা জানি: সমপর্ব ও সমমাত্রার বাধ্যবাধ্যকতা নেই অক্ষরবৃত্ত ছন্দে। যার কারণে কবি এখানে মোটামুটি নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন। তিনি কবিতার চরণকে ছোট বড় করবেন একটি ছকের মধ্যে ফেলে, ফ্রেমের মধ্যে রেখে।আর সেটা হলো: ৬,১০, ১৪, ১৮, ২২, ২৬, ৩০, ৩৪ মাত্রাবিশিষ্ট চরণ। এর বাইরেও যে মাত্রা গণনার আরেকটি কৌশল ব্যবহৃত হয়ে থাকে তারও উল্লেখ করা হয়েছে (ভিন্ন ভিন্ন চরণে: ৮+১০/ ১০+৮/ ১২+১০/১০+১২/ ১৪+৮/৮+১৪/ ১০+২০/২০+১০/ ১৬+১০/১০+১৬ প্রভৃতি)।

গদ্যছন্দে রচিত (বিবর্তিত অক্ষরবৃত্ত ছন্দ) দুএকটি গদ্য কবিতাকে সামনে আনলে আশাকরি গদ্য কবিতায় ছন্দের প্রয়োগ বা প্রয়োজনটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।

★১)ছাড়পত্র✍সুকান্তভট্টাচার্য-------------------

যে শিশু ভূমিষ্ট হল আজ -10
তার মুখে খবর পেলুমঃ-10
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,-10
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার-22
জন্মমাত্র সুতীব্র চীৎকারে।-10
খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত-18
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।-18
সে ভাষা বুঝে না কেউ,কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।-22
আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা-14
পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের-14
পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ট শিশুর-14
অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।-10
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;-18
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে-18
চলে যেতে হবে আমাদের।-10
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ-18
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল-14
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-18
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।-18
অবশেষে সব কাজ সেরে,-10
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে-14
করে যাব আশীর্বাদ,তারপর হব ইতিহাস।।18

কবির এই ছাড়পত্র কবিতার মধ্যে চার ধরণের চরণ পেয়েছি।
10 মাত্রার চরণ,
14 মাত্রার চরণ,
18 মাত্রার চরণ এবং 22 মাত্রার চরণ।
কী চমৎকার মুক্তছন্দের প্রয়োগ করেছেন কবি।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মুক্তক মাত্রা ব্যবহারের কথায় আমরা আগেই এমন বিন্যাসের কথা উল্লেখ করেছি। এই 6,10,14,18,22,26,30,34,38 মাত্রার চলনই মুক্ত অক্ষরবৃত্তের চাল।

এবার আমরা কবি জীবনানন্দ দাসের ‘আকাশনীলা’ গদ্য কবিতাটি মাত্রা বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি:
★২) আকাশনীলা –✍(জীবনানন্দদাস)
সুরঞ্জনা,ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,-18
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;-14
ফিরে এসো সুরঞ্জনা; 08
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;-14
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;-10
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;-10
দূর থেকে দূরে – 06
আরো দূরে যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর।-18
……. …… ……আকাশের আড়ালে আকাশে-10
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ;-10
তার প্রেম ঘাস হয়ে সুরঞ্জনা,14
ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,-10
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;-14
ফিরে এসো সুরঞ্জনা;08
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে; 14……

……….কবি জীবনানন্দ দাসের এই কবিতাতে আমরা 6,10,14,18 মাত্রার চরণ পেয়েছি। শেষের দিকে ‘ফিরে এসো সুরঞ্জনা’ চরণটিতে কেবল 08 মাত্রাপেয়েছি কিন্তু পরের চরণের 14 মাত্রার সাথে যার হিসেব যুক্ত করলে মোট মাত্রা 22 দাঁড়াবে। এরদ্বারা আবারো প্রমাণ হলো-গদ্যকবিতা ছন্দহীন নয়, বরং ছন্দবদ্ধ।

★৩) কবি শামসুর'রাহমানের ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতাটির মাত্রা দেখে নিতে পারি:
নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।-26
মমতা নামের প্লুত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়-22
ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে-22
শিউলিশৈশবে 'পাখী সব করে রব' ব'লে মদনমোহন-22
তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক। তুমি আর আমি,-26
অবিচ্ছিন্ন পরস্পর মমতায় লীন,-14(অংশ বিশেষ)

কবি শামসুর রাহমানের এই কবিতার মুক্তছন্দের মাত্রা বিন্যাস আমরা লক্ষ্য করি-14, 22, 26 মাত্রা সম্বলিত চরণ। এসব কবিতা কী তবে ছন্দহীন, নাকী ছন্দবদ্ধ।

এপার বাংলা ওপার বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিপ্রাণ কবি আল মাহমুদও বলেছেন ছন্দের দোলা ছাড়া কবিতা হয় না বলেই দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ করেছেন। ছন্দের মায়াজালে আবর্তিত হবে কবিতা।

এবার বলা যাক প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আরো কিছুঃ
=================================
ছন্দ ছাড়া কবিতা লেখা যাবে না, কবিতা হবে না এটাও আমি মানতে নারাজ। আধুনিক কবিতা বা গদ্য কবিতার ছন্দটা কেমন হবে, অদৃশ্যমান বিরাম বা ছেদ চিহ্ন, মাত্রা পর্বের মাধ্যমে কিভাবে কবি তার অন্তর্জাত অভিব্যক্তিকে ভাষারূপ দেবেন তা নির্ভরকরে ব্যক্তির সৃজনশীলতার ওপর।

★কবি বানানো যায় না, কবি গড়া যায় না। কবিত্বশক্তিকে সৃষ্টি করা যায় না। কবি ও কবিত্ব মহান স্রষ্টারই অপার দান। কবিতার অনুভব একান্তই পরম করুণাময়ের প্রদত্ত অনুভূতিসিক্ত। ইচ্ছে করলেই একজন কবি কবিতা লিখতে পারেন না। কবিতা লেখার জন্যে তার বুকের ভেতর প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হতে হয়, ভাঙা গড়ার তীব্র বেদনা বা ভালোবাসা সৃষ্টি হতে হয়- যা আর্টিফিসিয়াল বা কৃত্রিম কিংবা আরোপিত নয়; একান্ত স্বাভাবিক, ঝরনাধারার মতো উৎসারিত, কলোছলো নদীর স্রোতের মতো বেগমান; যার উৎস স্রষ্টা প্রদত্ত কবি মনের স্বচ্ছ বেলাভূমি।কবিকে, কবিত্ব শক্তিকে হয়তো শাণিত করা যায়, কবির বোধের বিষয়গুলো আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমে পরিশীলিত করা যায়, কবিত্ব শক্তি প্রবাহের গতিধারাকে মরিমার্জিত করা যায়। কাল বা সময়কে চিহ্নিত করে কবিকে প্রাণিত করা যায় নতুন বিষয়ে, নতুন আঙ্গিকে তার কবিত্ব শক্তিকে প্রবাহিত করার দিকে- যা সভ্যতার বিনির্মাণের অংশ হতে পারে, সমাজ বিপ্লবের প্রেরণা হতে পারে। কালে কালে, যুগে যুগে, দেশে দেশে কবি এবং কবিতাই হয়েছে তারুণ্যের শক্তি, বিপ্লব সংগ্রামের অমীয় উদ্দীপ্ত মন্ত্র। কবির কবিতা অন্ত্যমিল প্রধান,সমিল প্রবহমান হোক আর নাহোক ছন্দ কবিতার শরীরে থাকবেই। ছন্দের সিম্ফনিতে উচ্চকিত হবে কবিভাবনা। যারা গদ্য কবিতা লিখতে চান, অন্ত্যমিলকে মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে খড়গ মনে করেন-তাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। ছন্দোবদ্ধ অন্ত্যমিল প্রধান ছড়া কবিতা সাধারণ পাঠক মনে যে টেকসই ছবি আঁকতে সক্ষম- গদ্য কবিতা তার অন্যরূপ। গদ্য কবিতার পাঠকও একমাত্র কবিই বলা যায়। মোদ্দাকথা বোদ্ধা পাঠকই অনুধাবনে, রসাস্বাদনে সক্ষম আধুনিক গদ্য কবিতা। আর একধাপ এগিয়ে বলা যায় একদম বর্তমানের মানে উত্তর আধুনিক গদ্য কবিতা বলতে যখন কেউ কেউ বলেন: “যা বুঝানো যায়না, বোঝা যায় না”।  এজাতীয় কবিতার তবে কী প্রয়োজন আছে সমাজ সংসারে- তা অনেকেরই বুঝে আসে না। কবি যদি তার নিজের লেখাকে ব্যাখ্যা করতে না পারেন, পাঠক যদি তার লেখায় রসাস্বাদন করতে না পারেন-তবে এই গদ্য কবিতার নামে কাগজ কলম বিনাশ করার আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কিনা। আমি মনে করি- কবিতা লিখতে গেলে রসাস্বাদন উপযোগী ভাব ভাষা ও অলঙ্কার উপকরণের মাধ্যমে করতে হবে। গদ্য কবিতার মধ্যে যে কবিতা গুলো পাঠকের মনে কষ্ট করে হলেও টিকে গেছে বা জায়গা করে নিয়েছে- তার কোনটাই ছন্দহীন নয়(দু একটা ব্যতিক্রম ছাড়া), ভাব ভাষা অধরা নয়, বক্তব্য উদ্দেশ্যহীন খামখেয়ালি বা হেয়ালীপূর্ণ নয়,ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের বিশাল ক্যানভাসকে ধারণ করেই নির্মিত হয়েছে যে কবিতার শরীর, যে কবিতায় বিমূর্ত মানুষের চিরকালীন আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি।গদ্যকবিতা একান্তই যারা লিখতে চান, তাদের নিষেধ করবো না। কারণ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য পর্যন্ত এবং সেই ধারাবাহিকতায় আজকের দিনের নবীন কবিও গদ্য কবিতা লিখে চলেছেন অবলীলায়। অত্যন্ত দুঃখের এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে- সবার কবিতা কিন্তু কবিতা হচ্ছে না, কারো কারো কোন কোন কবিতাই কবিতা হচ্ছে। যাদের কবিতা, কবিতা হচ্ছে তারা ছন্দ জেনে বুঝে, ছন্দকে নতুনত্ব দিয়ে কবিতা লিখছেন। গদ্য কবিতাতেও তারা সচেতনভাবে ছন্দের প্রয়োগ করছেন। তার বিপরীতে ছোট চরণ, বড় চরণের আইডিয়া থেকে যেসব কবি গদ্য কবিতা লিখছেন- সময়ই বলে দেবে তাদের পরিণতি কী হবে, তাদের কবিতার অবস্থান কোথায় কিভাবে নির্ণিত হবে।

আগামী পর্বেও চোখ রাখুন কবিতার আলোচনায়-------