★আজকের পর্বে থাকছে কবিতায় প্রতিকবিতা ★
     -কেউ আঘাত পেয়ে থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী-

কবিতার বহুগামিতা পাঠক মাত্রেই জ্ঞাত। বাংলা কবিতায় দেখা যায় একেক ঘরাণা যেমন রবীন্দ্র ঘরানা, নজরুল ঘরানা, আধুনিক ঘরানা, জীবনানন্দীয় ঘরানা ইত্যাদি জনপ্রিয় হয় সীমাবদ্ধ থিমকে কেন্দ্র করে। যেমন রোমান্টিকতার জন্য রবীন্দ্রনাথ, বিদ্রোহের জন্য নজরুল, বিষাদের জন্য জীবনানন্দ ও আধুনিকরা ইত্যাদি। কিন্তু হরেক রকম কবিতার স্বাদ দেবার মত কবির দেখা পাওয়া ভার। ফলে এমন এক জটিলতা তৈরি হয় কবিতার জগতে, এমন এক সীমাবদ্ধতার ঘেরাটোপে ঘুরতে থাকে কবিদের চিন্তাভাবনা।  এই ভাবনা তাদের নিজেদের স্বতস্ফূর্ত প্রকাশকেই বিপদগ্রস্থ করে তোলে।
মুষ্ঠিমেয় কিছু কবি কখনই কোনো ঘরানা মানতে চান না। কিছু মানুষ এই কবিতার নাম দিয়েছেন ইন্টেলেকচুয়াল কবিতা বা বুদ্ধিদীপ্ত কবিতা বা প্রতিকবিতা।
জীবনানন্দের সব কবিতা পর পর পড়লে মনে হতে পারে আসলে সব মিলিয়ে একটা মহাকাব্যই পড়ছি। এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে ঘরানা। কিন্তু তার কিন্তু ‘সমারুঢ’ কবিতাটাকে মনে হতে পারে খানিকটা দলছুট। কারণ কবিতাটার বিষয়ই তার প্রকাশ ভঙ্গিকে নির্ধারণ করে দিয়েছে। নীচের কবিতাটাকে ইয়েটসের ‘স্কলার’ কবিতার ছায়া কবিতা বলে মনে করা হয়। কি লিখেছেন তিনি?

‘বরং নিজেই তুমি লেখোনাকো একটি কবিতা—’
বলিলাম ম্লান হেসে; ছায়াপিণ্ড দিলো না উত্তর;
বুঝিলাম সে তো কবি নয়— সে যে আরূঢ় ভণিতা:
পাণ্ডুলিপি, ভাষ্য, টীকা, কালি আর কলমের ’পর
ব’সে আছে সিংহাসনে— কবি নয়— অজর, অক্ষর
অধ্যাপক; দাঁত নেই— চোখে তার অক্ষম পিঁচুটি;
বেতন হাজার টাকা মাসে— আর হাজার দেড়েক
পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি;
যদিও সে-সব কবি ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক
চেয়েছিলো— হাঙরের ঢেউয়ে খেয়েছিলো লুটোপুটি।

কবিতার সাথে সম্পর্কিত একটা পেশাকে এখানে আঘাত করা হয়েছে। চরিত্রটা হয়তো কলেজে স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের কবিতা পড়ায়, অথবা কবিতার গবেষক। সেই কবিতা যেই কবিতাগুলা লিখতে গিয়ে কবি স্বয়ং ‘হাঙ্গরের ঢেউয়ে লুটোপুটি’ খেয়েছে। এইটা খুব অদ্ভুত যে কবিতা লেখা পেশা নয়। কবিকে পেশাদার বলার কোনো উপায় নাই। অথচ সেই কবির জীবনী লেখক বা কবিতার ব্যাখ্যাকার কিন্তু পেশাদার। যে কবি না খেয়ে মরে গেছে তার জীবনী লেখক তার জীবনী লিখে লাখ টাকার মালিক।

নিকানোর পাররা, গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, মিউশ, তাদেউশ রুজেভিচ, পিটার হেন্ডকে, মায়াকোভস্কি, হানস মাগনুস এনসেন্সবার্গার, পাবলো নেরুদা, রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, আবুল হাসান  ও সুবোধ সরকারসহ অনেক কবি আছেন যাদের ইন্টেলেকচুয়াল কবি বলা হয়। যাদের কবিতাকে বলা হচ্ছে প্রতিকবিতা।

থিমিটিক্যাল কবিতা খুব দ্রুত পাঠকের বিরক্তি উৎপাদন করে তাই দরকার হয় নতুন কবিতার। কিন্তু নতুন কবিতা কেবল স্লোগান স্বর্বস্ব! এই স্লোগান সর্বস্বতার।

কবি হচ্ছেন এমন এক বাড়ি যার সব কটি দরজা জানালা সবসময় খোলা থাকে। প্রচুর হাওয়া বাতাস অভিজ্ঞতা প্রেম হতাশা আশাবাদ বিষাদ ক্ষোভ দ্রোহ খেলা করে তার উঠোন জুড়ে। তিনি আবহাওয়া থেকে বুঝে নিতে পারেন সতর্কতার মাত্রা। তিনি বোঝেন প্রকৃতির ইশারা।

যেমন নিকানোর পাররার কবিতা পড়ে প্রতিক্রিয়া না দেখানো অসম্ভব।  ১৯১৪ সালে নিকানোর পাররা দক্ষিণ চিলির এক ছোটশহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। মার্কিন মদদে সালভাদর আইয়েন্দেকে হত্যা করে সামরিক শাসক হেনেরাল পিনোশেত্ চিলেতে সামরিক একনায়কতন্ত্র কায়েম করার পর নিকানো পাররাকে বেশ কিছুদিন নির্বাসনে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল। নিকানোর পাররা ব্যক্তিজীবনে একজন বিজ্ঞানী। তিনি সুদীর্ঘকাল গণিত আর পদার্থবিদ্যার শিক্ষক ছিলেন। তখন কবি শিল্পী চলচ্চিত্রকাররাই ছিলেন পিনোশেতের প্রত্যক্ষ সমালোচক। নিকানোর পাররার কবিতার বই প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে সত্যিকার অর্থে বিশ্বকবিতায় সূচিত হয়েছিল নতুন এক কবিতার যাত্রা- প্রতিকবিতা। ১৯৩৮ সালে বের হয় প্রথম কবিতার বই, নামহীন গীতিমালা ।  ১৯৪৯ সালে বের হয় তুমুল আলোচিত,বিখ্যাত বই কবিতা ও প্রতিকবিতা । ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আরো চারটি কবিতার বই প্রকাশ করেন।১৯৬৯ সালে পান চিলির জাতীয় সাহিত্য পুরস্কার। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত কৃত্রিম সৃষ্টি  বইটার সচিত্র কবিতাগুলোর জন্য বেয়াদবি, ব্লাসফেমি, নোংরামির অভিযোগে তুমুল সমালোচিত, আলোচিত হন। মৃত্যু ২৩ জানুয়ারি,২০১৮ । (বিদায় নিকানোর পাররা, জাহেদ সরওয়ার )।
নিকানোর পাররার এই প্রতিকবিতা যখন প্রথম প্রকাশিত হয় বইটা হাতে নিয়ে অনেকেই নাক সিটকেছিল। চিলির আরেক বিখ্যাত কবি পাবলো দে রোখা এই বইটি হাতে নিয়ে লেখেন, ‘এইসব স্থূল, বদখত্, গোঁয়ার, অলস ওড়গুলো, মৈথুনের পূর্বকল্পনা আর সচেতনভাবেই যাদের জীববিদ্যা আর উদ্ভিদবিদ্যা থেকে টেনে আনা হয়েছে। প্রতিকবিতাগুলো এই বিষম করুণাযোগ্য আর বমিজাগানো ভাঁড়ামোরই দ্বিতীয় সংস্করণ।‘  গির্জার অধ্যক্ষ ফাদার সালভতিয়েররা বলেছিলেন, ‘নিকানোর পাররার ‘কবিতা ও প্রতিকবিতা’ এতই অনৈতিক ও নোংরা যে ময়লা ফেলার ডাস্টবিনেও এটা ফেলা যাবে না, কারণ গারবেজ ক্যান অবৈধ সন্তানকে জায়গা দিলেও এত অনৈতিক নয়।‘ অন্যদিকে পাবলো নেরুদা বলেছিলেন, ‘নিকানোর পাররা আমাদের ভাষার মহত্তম নামগুলোর অন্যতম।‘‘ কবিতা ও প্রতিকবিতা’ বের হবার পর হুলুস্থুল পড়ে গিয়েছিল। একদিকে যেমন তুমুল আক্রমণ অন্যদিকে বিপুল সমর্থন। তিনি লিখলেন –

আধ শতাব্দী ধ’রে
কবিতা ছিল বেহেস্ত
গুরুগম্ভীর সব বেকুবদের জন্যে
যতক্ষণ-না আমি এসে হাজির হলাম
আর তৈরি করলাম আমার রোলারকোস্টার।
[রোলারকোস্টার; কবিতা ও প্রতিকবিতা]

নিকানোর পাররার প্রায় কবিতাই খাপখোলা তলোয়ারের মতো। কিন্তু তার কবিতার আঘাত যেন মধুময়, রসসিক্ত। এ যেন বার্নাড শ’র সেই উক্তির মতোই, চূড়ান্ত অপমান করার সময়ও চূড়ান্ত রসিক হতে হবে। তিনি অবলীলায় চূড়ান্ত অশ্লীল শব্দও (শ্ল্যাং) ব্যবহার করেছেন কিন্তু সে সব অশ্লীল হিসেবে পরিগণিত হয় নি। তিনি লিখছেন,

কোনো প্রার্থনা চলবে না, হাঁচিও নয়
থুতু ফেলা নয়, বাহবা দেয়া নয়, হাঁটু গেড়ে বসা নয়,
পুজো নয়, চিত্কার নয়, ডুকরানো নয়,
কেশে কেশে কফ তোলা নয় ।
এ তল্লাটে ঘুমোবার অনুমতি নেই।
কোনো টিকা দেওয়া নয়, কথাবার্তা নয়, দল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া নয় ।
চো-চো দৌড় নয়, পাকড়ে ফেলা নয় ।
ছোটা একেবারেই মানা
ধূমপান নিষেধ।
চোদা বারণ। [হুঁশিয়ারি; শ্রেষ্ঠ কবিতা ও প্রতিকবিতা]
** এখানে অনুবাদক বলেছেন শেষে ‘সঙ্গম বারণ’ বলতে পারতাম, কিন্তু তাতে সঠিক অনুবাদ হত না, কারণ শ্লেষটাই যেত উবে।

তাঁর কবিতাকে আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে খাপছাড়া, কিন্তু মেদহীন ঝরঝরে আপাতরসিক কবিতাগুলো একেবারেই অব্যর্থ তীর। প্রচুর জাম্পকাট ব্যবহার করেন তিনি কবিতায়।
নিকানোর পাররার একটা কবিতা আছে ‘নামবদল’ নামে যেখানে তিনিও সবকিছুর নামবদল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

কোন কারণে সূর্যকে
চিরকাল সূর্য বলে ডাকা হয়?
আমি বলি তাকে ডাকা হোক
চল্লিশ-লিগ জুতোর বিল্লি বলে।

আমার জুতোগুলোকে কফিনের মতো দেখাচ্ছে বুঝি?
জেনে রাখুন আজ থেকে
জুতোকে বলা হবে কফিন।
[নামবদল : শ্রেষ্ঠ কবিতা ও প্রতিকবিতা।]

লাতিন আমেরিকায় শতকজুড়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ গেড়ে বসেছে। চিলিতে তো আরও ভয়াবহ অবস্থা হয়েছিল। তিনি লেখেন,
ইউ এস এ
যেখানে স্বাধীনতা একটা মূর্তি
ফিদেল যদি এ বিষয়ে নিরপেক্ষ হতো
সে আমাকে বিশ্বাস করতো
ঠিক যেমন আমি তাকে বিশ্বাস করি।
[হাতের কাজ]

★যাইহোক,আজকের প্রসঙ্গ  প্রতি-কবিতা।★
------------------------------------------

নবীন কবিদের কাছে আমার বিনম্র বক্তব্য, কেউ কবি হতে পারবেন না, যদি না কবি সময়ের ধারণা আঙ্গিকের রূপান্তরের মধ্যে সেই কবির কবিতা রচিত হয়।অনেকেই বিশ্বাস করেন যে,সব কবিরই একটা উত্তরণ থাকে। কবিদের জীবনে বাস্তব আর পরাবাস্তব মিলেমিশে সময়ের সঙ্গে সাজুয্য ঘটিয়ে কবিতার সহাবস্থান ঘটে। এইভাবে কবিতার মধ্যদিয়ে পরবর্তী কবিতাজীবনের বীজ রোপিত হয়ে থাকে। কোন আড়ম্বর নয়, কোন মেকি শব্দের বাতুলতা নয় - মেদবর্জিত, অলংকারবিহীন,প্রতীক অবয়ব থেকেই প্রতিকবিতার সৃষ্টি।
১৯৩৫ সালে ডেভিড গ্যাস কোয়েনের' এ শর্ট সার্ভে অব সুররিয়ালিজম 'গ্রন্থে যে দুটো শব্দ ব্যবহৃত হয়েছিল,"অ্যান্টি লিটেরেচার'ও 'অ্যান্টি পোয়েট্রি"।  অবশ্যই আমরা জানি ইতিপূর্বে ১৯২৬ সালে কবি বাস্তামেন্ত বালিভান ' অ্যান্টি পোয়েমস ' বলে বই লিখেছেন। কিন্তু 'অ্যান্টি পোয়েট্রি 'এই ধারণাটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন  চিলির কবি নিকানোর পাররা। ১৯৫৪ সালে তার বিখ্যাত বই ' পোয়েমস অ্যান্ড অ্যান্টি পোয়েমস ' প্রকাশিত হওয়ার পর গোটা পৃথিবীতে বিশেষ করে ইউরোপে 'প্রতি কবিতার ' ধারণা রীতিমতো বিস্তার লাভ করে।

তাঁর সদর্প ঘোষণা ছিল- জিজ্ঞেস করছো, কোথায় ছিলাম, কোনদিকে চলেছি,/ ধ্বজভঙ্গ শরীর নিয়ে কোনদিকে যেতে পারি? জাহান্নাম,,,,।

প্রতিকবিতার অন্যতম দিক হচ্ছে মাস কমিউনিকেশন, জনগণের সঙ্গে সংযুক্তিকরন, পাঠকের সঙ্গে সহবাস, কবিতার অভিব্যক্তির সঙ্গে সহমিলন, পুনর্মিলন ঘটানো।

বাংলা কবিতায় এই ধারা নিয়ে এসেছেন সুবোধ সরকার। জন্ম ১৯৫৮ সালে। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ পঞ্চাশের অধিক। রচনাকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৩ সালে তিনি পান ভারত সরকারের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। তাঁর পিতৃদেব ছিলেন বাংলাদেশের পাবনা জেলার লোক। দেশভাগের সময় হাজার হাজার মানুষের মতো তাঁর পিতা-মাতাও স্বদেশ পরিত্যাগ করে কৃষ্ণনগরে চলে যান । শরনার্থী হওয়ার যন্ত্রণা তাঁকে ছোটবেলা থেকেই অনুভব করতে হয়েছিল। অনুভব করতে হয়েছিল ক্ষুধার যন্ত্রণা। তবু সেই যন্ত্রণার কথা তিনি কখনও তাঁর কবিতায় প্রধান করে তোলেননি বরং স্বদেশ ও দেশবাসীর যন্ত্রণা বরাবর তাঁর নিজের জীবনের দুঃখ যন্ত্রণার থেকে বড় হয়ে উঠেছে। সহধর্মিনী কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের সাথে একযোগে বের হয় তাঁর ও মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিতার বই ‘সুবোধ মল্লিকা স্কয়ার''। ব্যর্থ বামপন্থার দৃষ্টান্ত তাঁকে স্বাধীন মতামত প্রদানের সেই অধিকার দিয়েছে ততখানিই, যতখানি দিয়েছে বিতর্ক। কবি দেখেছেন খাদ্য,পানীয়, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারগুলো মানুষকে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হয়েছেন বামপন্থীরা আর তাই নতুন প্রতিশ্রুতি আর উদ্দীপনাময় নবগঠিত সরকারকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। বামপন্থী সমালোচনায় মুখরিত হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতা। সেইসঙ্গে হিন্দুইজম এর নামে হিন্দুত্বের শাসানির রাষ্ট্রীয় কৌশলকেও বিরোধিতা করেছেন তিনি। কবিতার মধ্যে দিয়েও তার প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে ‘পপিউলিস্টিক’ কবিতা লেখার অভিযোগ কিংবা সাম্প্রতিক ও বিশেষতঃ রাজনৈতিক স্পর্শকাতর বিষয়বস্তু নিয়ে কবিতা লেখার অভিযোগকে কবিতা দিয়েই নস্যাৎ করেছেন তিনি। জনপ্রিয়তার লোভে সুবোধ সরকার কখনও তাঁর কবিতাকে বিসর্জন দেননি, বিসর্জন দেন নি খ্যাতি ও সম্মানের লোভে।  কৃষ্ণনগর জেলা সদরে বড় হওয়া কবি তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতার’ র ভূমিকায় বলেন : “কৃষ্ণনগরের ১ নম্বর প্লাটফর্মে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আমরা স্কুলের বন্ধুরা আড্ডা দিচ্ছিলাম। শিয়ালদার দিক থেকে ট্রেন আসছিল। হঠাৎ শুনলাম গেল গেল একটা চিৎকার। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি চলন্ত ইঞ্জিনের সামনে পড়ে থাকা একটা পাঁউরুটি তুলে নিতে ঝাপিয়ে পড়েছে একজন। ট্রেন চলে গেল এবং থামল। দুটো কোচের মাঝখান দিয়ে দেখতে পেলাম লোকটা ২ নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে সেই পাঁউরুটি খাচ্ছে আর হাসছে। পাঁউরুটি আর মৃত্যুর মাঝখান থেকে উঠে আসা ওই হাসি আমাকে সারারাত ঘুমোতে দেয়নি। পরের দিন ভিরু হাতে একটা কবিতা লিখেছিলাম, হুবহু যা দেখেছি তাই।‘
‘ঋক্ষ মেষ কথা’ দিয়ে যার যাত্রাপথ শুরু, আটের দশকে লেখা তাঁর ‘কবিতা ৭৮-৮০’ শুরু করেছিল যে চলার গতি পরবর্তীকালে ‘প্রতিকবিতা’র প্রবক্তা যে সেই দশকের এক সচেতন নিষ্ঠাবান কবি তাঁর প্রমাণ পাই ‘রাজনীতি’ কবিতায়। এই রাষ্ট্রনীতির সমালোচনা সুবোধ সরকার বারবার করেছেন।লক্ষণরেখা অতিক্রম করেছেন বারবার। ‘সাহিত্য অকাদেমি-২০১৩’পুরস্কারে সম্মানিত সুবোধ সরকারের কাব্যগ্রন্থ ‘দ্বৈপায়ন হ্রদের ধারে’ প্রসঙ্গে সমালোচক বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এ বছর ‘সাহিত্য অকাদেমি’ পুরস্কারে সম্মানিত সুবোধ সরকারের ‘দ্বৈপায়ন হ্রদের ধারে’ হাতে নিয়ে এমাথা থেকে ওমাথা যেতে আসতে প্রথমেই মনে হলো, বইটা একটা গনগনে উনুন।“
কবি সুবোধ সরকারের ‘শাড়ি’ কবিতাটা খুব চেনা সকলের।

বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা
একদিন দুপুরে শাশুড়ি ঘুমিয়ে, সমস্ত শাড়ি বের করে
ছতলার বারান্দা থেকে উড়িয়ে দিল নীচের পৃথিবীতে ।
শাশুড়ি পড়িয়ে দিয়েছেন তাকে সাদা থান
উনিশ বছরের একটা মেয়ে সে একা ।

কিন্তু সেই থানও এক ঝটকায় খুলে নিল তিনজন, পাড়ার মোড়ে
একটি সদ্য নগ্ন বিধবা মেয়ে দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে, ‘বাঁচাও’
পেছনে তিনজন, সে কি উল্লাস, নির্বাক পাড়ার লোকেরা ।

বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা…

আবার নির্ভয়া কাণ্ডের কথা মনে করে ‘রজনীগন্ধা কফিন’ কবিতাটিতে সুবোধ সরকার লেখেন,

তোমাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি দামিনী।
সারা দেশ জুড়ে আমরা কেঁদেছি, সারা দেশ জুড়ে আমরা ফুঁসেছি।
ভারত রাষ্ট্র বাঁচাতে পারেনি তোমাকে–
জনজোয়ারের চাপে মাথা নিচু করেছে অশোকস্তম্ভ।
দেশের বাইরে পাঠিয়ে তোমাকে ফেরৎ আনতে পারিনি।
ফেরৎ আনতে পারিনি তোমাকে দামিনী
ফেরৎ এসেছে রজনীগন্ধা কফিন, ফেরত এসেছে আমার ভারতকন্যা
আমার মেয়েটি তেরো দিন ধরে মৃত্যু সরাতে সরাতে
তেরো দিনে হল অনন্যা।

এভাবে সৃষ্টির স্বাক্ষর ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন কবি সুবোধ সরকার নানা সংবেদনে, বিচিত্রতর ভাবনায়।
স্বাক্ষর কবিতা বা সিগনেচার পোয়েম। যদি আমরা কবি "জীবনানন্দ "এর 'বনলতা সেন ' কিংবা ' আট বছর আগের একদিন ', নজরুলের ' বিদ্রোহী ', সুকান্তের ', আঠারো বছর '  বিষ্ণু দের ' ঘোড়সওয়ার ', অমিয় চক্রবর্তীর ' বিনিময়', বুদ্ধদেব বসুর ' শীত রাত্রির প্রার্থনা ', সুধীন্দ্র নাথ দত্তের ' শ্বাশতী', সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ' যত দূরেই যাই', নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ' কলকাতার যীশু 'অথবা' অমলকান্তি ', শঙ্খ ঘোষের ‘বাবরের প্রার্থনা’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ' কেউ কথা রাখেনি ',শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ' অবনী বাড়ি আছো' নির্মলেন্দু গুনের 'স্বাধীনতা শব্দটা কিভাবে আমাদের হলো' সামসুর রাহমানের 'স্বাধীনতা তুমি' সৈয়দ শামছুল হকের' নুরুল দীনের সারারাজীবন'– এই সকল কবিতার দিকে দৃষ্টি রাখি এগুলিকে অবশ্যই কালজয়ী কবিতা বলা যায়। কিন্তু এই কবিরা বিভিন্ন ধরনের কবিতা লিখেছেন এবং লিখতেন। এ গুলি অবশ্যই এদের স্বাক্ষর কবিতা।এই ধরনের কবিরা চিরকালই আঘাত পেয়েছেন সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে। এই কবিরা অতিমাত্রায় অনুভূতিপ্রবণ হন। খোলা কথা খোলাখুলি কবিতায় বলেন কারণ তাদের মনও খোলা আকাশের মত। এরা চিরকালই সফট টার্গেট। চিলির নিকানোর পাররা তো ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন প্রায় প্রতিদিন। পালিয়ে বেড়িয়েছেন। চাকরিতে পড়েছেন তুমুল বিপদে। অবশেষে ২০০৪ সাল থেকে মৃত্যু অর্থাৎ ২০১৮ সাল অবধি নীরবতা অবলম্বন করেছেন। বৃদ্ধ বয়েসে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন বিতর্ক থেকে।

কবি সুবোধ সরকারের পরে এপার বাংলায় ওপার বাংলায় বহু কবি কবি প্রতিকবিতা লিখছেন, লিখবেনও জানি। এই মুহূর্তে শ্রীজাতের একটি কবিতার অংশ    

বানায় কারা নিয়ম কানুন
শানায় কারা আক্রমন
শরীর যদি ভাঙল তবু
সজাগ হয়েই থাকলো মন ।
হয় যদি হোক আবার চাবুক
যায় যদি যাক লোক ভেসে
তবুও মুঠো শক্ত হবেই
গর্জে ওঠার অভ্যেসে ।
মানুষ থেকেই মানুষ আসে
বিরুদ্ধতার ভিড় বাড়ায়
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

---- ★আগামী  পর্বে  চোখ রাখুনঃ থাকছে কবিতায় শ্লীলতা ও অশ্লীলতা★