আজও গদ্যছন্দ সম্পর্কিত। থাকছে দুটি পর্ব
========================

        বন্ধুগন কবিতা কি ?  আধুনিক কবিতা, গদ্য কবিতা এসব নিয়ে গত দুটি পর্ব প্রকাশ করেছি। বেশকিছ বন্ধু উৎসাহ যুগিয়েছেন। যাবো ছন্দ প্রকরণ নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক উদাহরণসহ মজাদার আলোচনায়। তার আগে আমরা কবিতার পূর্বাপর এবং গদ্য কবিতা নিয়ে আমাদের মানসিক অবস্থার বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে গদ্য কবিতা নিয়ে কিছুটা আলোচনার  প্রয়োজন মনে করি।
দুটি পর্বে ভাগ করেছি। পড়বার সুবিধার্থে। প্রায় সমভাবে আলোচিত দুটি পর্বের একটি পাঠ করলেও আমরা জানবো অনেক কিছু।

        ★জীবন ছন্দময়। জীবনের প্রতিটা কাজ ছন্দময় না হলে জীবন তার স্বাভাবিক গতিতে চলে না। নদী পাহাড় সাগর মানুষের হাঁটাচলা-যেদিকেই তাকাই না কেন, প্রতিটি স্থানে আমরা একটা নিপুণ ছন্দ দেখতে পাই। আমাদের দেহেরও একটা রিদম আছে। হৃৎপিণ্ড একই ছন্দে চলছে মৃত্যু পর্যন্ত। ছন্দ ছাড়া কোনো কিছুই চলে না; কিন্তু ছন্দটার যখন পতন হয়, তখনই সব কিছু এলোমেলো বিষাদময় হয়ে ওঠে। কবিতার ক্ষেত্রেও বিষয়টা তেমনই। কবিতা মানেই ছন্দ। ছন্দ মানেই কবিতা।

        কবিতার দুটো রূপ আমরা দেখতে পাই। পদ্য কবিতা এবং গদ্য কবিতা। কবিতা কাকে বলে? ‘যাহা দেখিতে কবিতার মতো, পড়িতে কবিতার মতো ও শুনিতে কবিতার মতো তাহাই কবিতা’ সংজ্ঞাটা শুনতে পড়তে এবং বলতে বেশ মজার। আসলেই কি তাই ?  না বন্ধুরা, কবিতা বিষয়ক নানা সংজ্ঞা আমরা প্রথম পর্বে পেয়েছি।

       বাংলা কবিতার ইতিহাস অনেক লম্বা, ত্রিশের দশক পর্যন্ত প্রলম্বিত। প্রাচীন চর্যাপদ থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত কবিতার আঙ্গিক ভাব ভাষা বিষয়ে অনেক কিছু সংযোগ হয়েছে। লেগেছে নতুনত্বের ছোঁয়া। বহু গড়াপেটার পর অতি আধুনিক যুগে গদ্যে ছন্দ এসে স্থিরতা পেয়েছে কবিতা। বর্তমান আধুনিক কবিরা গদ্যছন্দে লিখতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। রবীন্দ্রনাথের আগে কবিতা বলতে মাত্রা ছন্দবদ্ধ পদ্য কবিতাকেই বোঝাতো। কিন্তু ছন্দ মেলাতে গিয়ে কবি মনের ভাব প্রকাশে ছন্দ মেলানোর জন্য অনেক সময় যথাযথ শব্দ খুঁজে পান না এবং এই কাজটা খুবই মুশকিল, তখন মাত্রার বিষয়টাকে এড়িয়ে গিয়ে জটিল এক অন্ত্যমিলের কবিতা রচনা করলেন, যেটাকে আমরা গদ্য কবিতা বলি।
      
     আগের পর্বে  আমি নামহীন কিছু কবির কথা বলেছি, যাদেরকে অপরিপক্ক কবি বলা যায়- সবাই নয় এই দলে। তারা কবিতা লিখছেন ঠিকই কিন্তু কবিতার ভাষা, কবিতার ছন্দ অন্ত্যমিল পাঠকের বোধগম্য হচ্ছে না। এই অবোধগম্যতার কারণে অনেকে গদ্যছন্দের কবিতাকে কবিতাই মনে করেন না। আসলে কবিতা আকারে সাজালেই তাকে কবিতা বলে না, পড়তেও কবিতার মতো লাগতে হবে।
আগেই বলেছি ছন্দ ছাড়া কবিতার অস্তিত্ব নেই। গদ্য কবিতারও ছন্দ আছে। কবি তার মনের ভাবকে পাঠকের চাহিদা মতো ছোট বড় লাইনে সাজিয়ে কাব্যিক ভাষায় উপস্থাপন করেন। এর মাঝেই ছন্দ বিরাজ করে। পাঠক কবিতা পাঠ শুরু করলেই বুঝতে পারে এটা কিভাবে পাঠ করতে হবে, কিভাবে পাঠ করলে এর রসাস্বাদন করা যাবে। পাঠক যদি কোনো কবিতা থেকে এই ছন্দের রসাস্বাদন করতে পারে, তাহলেই সেটা সফল গদ্য কবিতা। সাগরে একটার পর একটা ঢেউ ওঠে, ঢেউ ভাঙে; বড় ঢেউয়ের মাঝে আবার ছোট ছোট ঢেউ তালে তালে বড় ঢেউয়ের সমান্তরালে মিশে যায়, গদ্য কবিতার ছন্দটাও তেমনি। কবিতার ভাব ভাষা সব ঠিক থাকার পরেও যদি পড়তে ছন্দময় না হয়, তাহলে বুঝতে হবে শব্দ বিন্যাসে জটিলতা হয়েছে, তখন সেটা কবিতার আকারে হয়েও কবিতা হয়নি। এখানেই একজন কবির দক্ষতা নিরূপণ হয়।

      নজরুল-রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ একসময় গদ্য কবিতার ঘোর বিরোধী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ স্বরূপ তাঁর সম্পাদিত একটা পত্রিকায় গদ্য কবিতা প্রকাশ বন্ধ করেছেন, নজরুল ইসলাম তো গদ্য কবিতার বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ কবিতাও লিখেছেন। পরবর্তীতে তাঁরা বুঝেছেন যে, কবিতার গদ্যরীতি কবিতার অন্যতম প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ নিজেই গদ্য কবিতা লিখে গেছেন। গদ্য ছন্দে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা-

‘হঠাৎ দেখা’

রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,
ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন।
আগে ওকে বারবার দেখেছি
লালরঙের শাড়িতে
দালিম ফুলের মতো রাঙা;
আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,
আঁচল তুলেছে মাথায়
দোলনচাঁপার মতো চিকনগৌর মুখখানি ঘিরে।

       জীবনানন্দ, রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ,  হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ কাদরী, আবুল হাসান সফলভাবে গদ্যছন্দে কবিতা রচনা করেছেন, যা বাংলা সাহিত্যে গদ্য কবিতার স্কেল বললে ভুল হবে না।

গদ্যছন্দের কবিতার কিছু উদাহরণ-
কবি জীবনানন্দ দাস
""অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।""

'এবার আমি’
- শহীদ কাদরী

আমি করাত-কলের শব্দ শুনে মানুষ।
আমি জুতোর ভেতর, মোজার ভেতর সেঁধিয়ে যাওয়া মানুষ
আমি এবার গাঁও-গেরামে গিয়ে
যদি ট্রেন-ভর্তি শিউলি নিয়ে ফিরি
যে লোহা, তামা, পিতল এবং পাথর
তোমরা আমায় চিনতে পারবে তো হে!’

অবেলায় শঙ্খধ্বনি
-রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ
-
‘অতোটা হৃদয় প্রয়োজন নেই,
কিছুটা শরীর কিছুটা মাংস মাধবীও চাই।
এতোটা গ্রহণ এতো প্রশংসা প্রয়োজন নেই
কিছুটা আঘাত অবহেলা চাই প্রত্যাখান।
সাহস আমাকে প্ররোচনা দেয়
জীবন কিছুটা যাতনা শেখায়,
ক্ষুধা ও খরার এই অবেলায়
অতোটা ফুলের প্রয়োজন নেই।’

          তবে গদ্য কবিতায় সবচে বেশি যশ করতে পেরেছেন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। রবীন্দ্রনাথের বলয় ভেদ করে তিনি এই রীতিতে কবিতা রচনা করেন। ১৯০১ সালে কলকাতার হাতিবাগানে জন্ম নেয়া এই কবি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি। ‘কবি সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিশ্বকবি বলেছিলেন; মননশীল তাঁর মন, তিনি মনন বিলাসী। তিনি বাংলা ভাষার একজন আধুনিক প্রধান কবি। তাঁকে কেউ কেউ বাংলা কবিতার ‘ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক’ বলে থাকেন।’ (সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-জীবন ও সাহিত্য, আলোচক-নীলরতন চট্টপাধ্যায়)। এখানে ‘ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক’ বলতে কবিতায় গদ্যরীতির কথা বলা হয়েছে। এই আধুনিক কালে এসেও তাঁর কবিতায় চিন্তা চেতনার স্বাতন্ত্র্য, ভাবনা, জীবনদর্শন, রোমান্টিকতা, কবিতার শব্দ প্রয়োগ এবং বাক্যগঠন তাঁর গদ্য কবিতাকে আলাদা বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছে। তাঁর একটি কবিতা

‘নাম’
--সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

‘চাই, চাই, আজও চাই তোমারে কেবলই।
আজও বলি,
জনশূন্যতার কানে রুদ্ধ কণ্ঠে বলি-
অভাবে তোমার
অসহ্য অধুনা মোর, ভবিষ্যৎ বন্ধ অন্ধকার,
কাম্য শুধু স্থবির মরণ।
নিরাশ অসীমে আজও নিরপেক্ষ ভবন আকর্ষণ
লক্ষ্যহীন কক্ষে মোরে বন্দী করে রেখেছে প্রেয়সী;
গতি-অবসন্ন চোখে উঠিছে বিকশি
অতীতের প্রতিভাস জ্যোতিষ্কের নিঃসার নির্মোকে।
আমার আগের স্বপ্নলোকে
একমাত্র সত্তা তুমি, সত্য শুধু তোমারই স্মরণ।’

        উপরে যে কবিতার অংশগুলো উল্লেখ করা হলো, সে কবিতাগুলো নিজ নিজ কবিদের সময়কালের অন্যতম সেরা রচনা এবং গদ্যছন্দে রচিত আদর্শ এবং পরিপুষ্ট কবিতা। এই কবিতা গুলোর রচনা বৈশিষ্ট্যের দিকে খেয়াল রেখে গদ্যছন্দে কবিতা রচনা করলে ছন্দে বিচ্যুতি হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে এবং শেখা যায় অনেক। আমরা ইদানীং অনেক গদ্য কবিতা পড়ি, সেটা ভালো লাগার পরিবর্তে বিরক্তি উৎপাদন করে। এসব কবিতার রচয়িতারা মনে করেন নিবন্ধ প্রবন্ধকে একটু সাজিয়ে কবিতার আকারে লিখলেই কবিতা হয়ে গেলো। আসলে তা নয়। বর্তমানকালের কবির গদ্য রচনায় সেই ছন্দ পাওয়া যায় না বলেই গদ্য কবিতা সঠিক ছন্দে পাঠকের মনে দোলা দেয় না। ছন্দের যে রীতি আছে সেটা না মেনে কবিতা রচনার কারণেই নজরুল রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ আমাদের কবিকুলে জন্ম নিচ্ছেন না। সব মানুষই হাঁটে। কেউ বেঁটে-তার হাঁটার ছন্দটা এক রকম, কেউ লম্বা- তার হাঁটার ছন্দ অন্য রকম; কিন্তু প্রত্যেকের হাঁটার একটা তাল লয় মাত্রা ছন্দ আছে। গদ্য কবিতার বেলায়ও বিষয়টা তেমনি। সবার রচনা যে একই ধাঁচের হবে, তার কোনো মানে নেই; রচনার ভিন্নতা থাকতেই পারে। যে যেভাবে রচনায় পটু, সে সেভাবে রচনা করবে, কিন্তু অন্তর্নিহিত ছন্দটা ঠিক থাকতে হবে। অনেকে কিবতায় একটু মিস্টিরিয়াসিটি না থাকলে তাতে রস থাকে না। কবিতায় এই মিস্টিরিয়াসিটি বুঝতে যদি পাঠকের প্রাণান্তকর অবস্থা হয়, তাহলে কবিতার অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সে প্রশ্নটা থেকেই যায়। আর একটা কথা মাথায় রাখা প্রয়োজন যে, খুব উচ্চমার্গের শব্দ প্রয়োগের কবিতা পাঠের মতো শিক্ষিত লোকের সংখ্যা দেশে অপ্রতুল।
সাধারণ অল্পশিক্ষিত লোকের বোধগম্যতার বিষয়টা বোধে নিয়ে গদ্যরীতিতে কবিতা রচনা করলে পাঠকপ্রিয়তা পায় দ্রুত। সর্বোপরি একটা কথা সবাই মানবেন যে, যে যত নিয়ম মেনে কবিতাই রচনা করুন না কেন, পাঠক যদি সেটা পাঠে এবং শ্রবণে আনন্দ না পায়, যদি সাবলীলতা না থাকে, যদি পঠনে হোঁচট খেতে হয়, তাহলে তাকে আর যা-ই বলি অন্ততঃ কবিতা বলা যাবে না।

                        দুই
                      ====

       গদ্যের যে স্বাভাবিক ছন্দ বা গদ্যের যে ছন্দ তা ঠিক গদ্যছন্দের অনুরূপ নয়। পার্থক্যটা হলো— গদ্যের যে ছন্দ তা গদ্যের ছন্দ আর গদ্য কবিতার যে ছন্দ তা হলো গদ্যছন্দ। এ বিষয়ে শঙ্খ ঘোষ ‘গদ্যকবিতা ও অবনীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধের ফুটনোটে লিখেছেন—‘সুরচিত গদ্যমাত্রেরই একটা ছন্দপ্রবাহ আছে। তার ধ্বনির উত্থান-পতনে, তার যতির হ্রস্বদীর্ঘতায়, তার শব্দব্যবহারের সুমিত বলয়ে— তৈরি হয় এই ছন্দ। এর কোন পূর্বনির্দিষ্ট নিরূপিত ধরণ নেই। একেই বলা যায় গদ্যের ছন্দ। এই ছন্দ শুনেই ‘পথের পাঁচালী’র অপু একদিন মুগ্ধ হয়েছিল তার ছেলেবেলার পাঠশালায়, ভেবেছিল বড়ো হয়ে খুঁজে নেবে রামায়ণ-মহাভারতের দেশ। আর এর তুলনায় গদ্যছন্দ কথাটির প্রয়োগ একটু বিশেষিত। গদ্যকবিতা নামে চিহ্নিত যে বিশেষ রচনাশ্রেণীটি, এ হলো তার ছন্দ। এরও নেই কোন পূর্ব-নির্ধারিত রূপ। কিন্তু শ্রুতিতে বা অনুভবে বুঝে নেওয়া যার সাধারণ গদ্যের ছন্দের থেকে এর স্বতন্ত্র এক স্পন্দন, হয়তো খানিকটা ছোটো আর সুষমাময় হয়ে আসে এর শ্বাসপর্বগুলি।’ আগেই উল্লেখ করেছি গদ্যছন্দ মূলত ভাবের ছন্দ। কবিতাকে কবিতা বলার জন্য ছন্দ অথবা ছন্দহীনতা বড় বিষয় নয়। বড়ো বিষয় হলো কবিতাকে কবিতার নির্যাসে ধারন। সেই নির্যাস ধারনের একটি উপাদান হলো ছন্দ যেটা অনেককাল যাবৎ কবিতার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসাবে ছিল। কিন্তু গদ্য কবিতায় যাকে বাতিল করা হলো। আসলেই কী বাতিল করা হলো? মোটেই না। শুধু ছন্দের গণিত বাদ পড়লো। আসলো ভাবের আর বাক্যের প্রবাহমানতার ছন্দ। গদ্য কবিতায় কবিত্ব দেখানো কবির বরং কঠিনই হয়ে গেল! কবিত্ব কী দেখানোর জিনিস? উত্তর হবে না। কবিত্ব হয়ে ওঠার ব্যাপার। একজন কবি, কবি হয়ে ওঠার মাধ্যমে যা লাভ করে। গদ্য কবিতায় কবিত্ব দেখানোর সুযোগ আরো বেড়ে যায়। কারণ এখানে গাণিতিক ছন্দের হিসেব কষে কবিতা লিখতে হয় না। আবেগের ঘোড়াকে ভাবের ছন্দে বেঁধে গদ্য কবিতা আগায়। মঞ্চে নৃত্যরত রমণীর মতো ধরাবাঁধা ছকে নাচে না, চলার পথে নিজের খেয়াল খুশি মতো সে চলে। সুন্দর শব্দবাগানের মধ্যে হেঁটে যায় আর হরেকরকমের শব্দফুল সে মাথায় গুঁজে নেয়। সময়ে সময়ে সে বাহারি রূপ ধারণ করে এগিয়ে যায় গন্তব্যে। তৈরি হয় গদ্যছন্দ।

★কবিতায় অলঙ্কারঃ--
      
প্রাচীন যুগ হতে ছন্দের পাশাপাশি কবিতায় আরেকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে সেটা হলো অলঙ্কার। গদ্য কবিতা ছন্দ ত্যাগ করেছে বলে অলঙ্কারও কি ত্যাগ করেছে? অবশ্যই না। বরং ছন্দের জায়গায় অলঙ্কারটাই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে বা পাওয়া উচিত বলে মনে হয়। ছোট বেলায় মায়ের মুখে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় শুনেছি—‘সাজিলে গুঁজিলে বেডি আর লিপিলে পুঁছিলে মেডি’। এর চলতি রূপ হয়েছে—‘ সাজালো গোছালে নারী আর লেপ্লে পুঁছ্লে বাড়ী’। পরবর্তীতে সেটার পশ্চিম বাংলার রূপ পাই এভাবে—‘নিকালে চুকালে মাটি আর সাজালে গুছালে বিটি’ পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে কথাটির অর্থ পরিবর্তন হল খানিক। তবুও কাছাকাছি। মেয়ের বাস্তবিক রূপ কোন বিষয় নয়, একটু পার্লার থেকে ঘুরিয়ে আনলেই সে অতুলনীয়া হয়ে ওঠে। কারণ তার হাতে, গলায়, নাকে, কানে ও সিঁথিতে গয়না পরানো হয়। যা নারীকে করে তোলে অপরূপা। কবিতা কি নারীরই মতো? বিবিধ অলঙ্কারে সজ্জিত না করলে তার সৌন্দর্যের ভাটা পড়ে? যেটি কবিতা তার কোন কিছুরই অপরিহার্যতা নেই। কবিতাকে কবিতা বলতে তাকে গদ্য বা পদ্য কোন কিছুতেই ভাগ করার দরকার পড়ে না। ছন্দের মাপকাটিতে লেখা অনেক কবিতাই পৃথিবীতে আছে যাকে অন্তত কবিতা বলে চলে না। গদ্যের ক্ষেত্রে সেটা আরো প্রকট। তাই কবিতায় তাও আবার গদ্যে লেখা কবিতায় অলঙ্কার কবিতাকে আরো বেশি কবিতা করে তুলবে নিঃসন্দেহে। সুন্দরী নারীরাই দেখা যায় সাজুগুজু করে বেশি নিজেদের বেশি সুন্দর করে তোলার জন্য। কবিতার কথাগুলোকে আরো বেশি কবিতা করতে তাই কবিরা অলঙ্কার ব্যবহার করেন।
অলঙ্কার দুই ধরনের হতে পারে—
১[]শব্দালঙ্কার ও
২[]অর্থালঙ্কার।
মূলত শব্দের উচ্চারণের ধ্বনিতে যে অলঙ্কার নিহিত তাই শব্দালঙ্কার এবং শব্দের অর্থবোধকতার জন্য যে অলঙ্কার তৈরি হয় তাই অর্থালঙ্কার। কবিতায় যখন শব্দ উচ্চারিত হয় তখন তা আমাদের কানে এসে দোলা দেয়। এ দোলা হতে পারে কবিতার কোন একটি শব্দের ধ্বনিতে অথবা পুরো লাইনের সমন্বিত ধ্বনিতে। শব্দালঙ্কারের প্রথম যে বিষয়টা আমাদের সামনে আসে তা হলো অনুপ্রাস। সহজে বলতে হলে বলা যায়— একটা বর্ণ বা বর্ণগুচ্ছ যদি বারবার বাক্যের মধ্যে ব্যবহৃত হয় তাকে বলে অনুপ্রাস।

   ★এবার আসি অর্থালঙ্কারের কথায়। একজন নারীকে আমরা দুরকম গুন দিয়ে বিচার করি— রূপবতী ও গুণবতী। সাধারণত বাইরের সৌন্দর্য দিয়ে অর্থাৎ তার গায়ের রঙ আর পরিহিত বিভিন্ন অলঙ্কার দিয়ে আমরা রূপ নির্ধারণ করি। আর কখন আমরা গুণবতী বিশেষণটি লাগাই? নারীর লজ্জা, দয়া, নম্রতা, ক্ষমা, বিনয় ও জ্ঞান এসব দিয়েই আমরা গুণ বিচার করি। এসব ভেতরের বিষয়। ঠিক তেমনি কবিতায় বাক্যের ভেতরকার সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় তার অর্থের কারণে। বিবাহযোগ্য নারীকে পছন্দ করার ক্ষেত্রে আমরা হয় বাহ্যিক রূপকে প্রাধান্য দেই নয়তো ভেতরের গুণকে প্রাধান্য দেই। একটার আধিক্য হলে অন্যটির কম হলেও চলে। শব্দালঙ্কার আর অর্থালঙ্কার কবিতার ক্ষেত্রে ঠিক তেমনি। অনুপ্রাস, যমক ও শ্লেষ দিয়ে যেমন আমরা কবিতাকে বাহ্যিকভাবে শব্দালঙ্কারে সজ্জিত করি ঠিক তেমনি অর্থের শোভায় কবিতা অর্থালঙ্কারে সজ্জিত হয়। মূলত অর্থের আশ্রয় গ্রহণ করে কবিতায় যে অলঙ্কার সৃষ্টি হয় তাই অর্থালঙ্কার। কবিতা খুব সহজে শব্দের শাব্দিক অর্থ পাল্টে দিতে পারে। বাক্যে শব্দের সুষম ব্যবহারের মাধ্যমে যা সম্ভব। অর্থালঙ্কারের একটি বিশেষ রূপ হচ্ছে সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার। সাধারণত উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা ইত্যাদি হলো সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার। এ ছাড়াও আরো বিভিন্ন রকম অলঙ্কার আছে যা অলঙ্কার শাস্ত্রে বিধৃত আছে। কবিতা মাত্রই এসবের আবশ্যকতা জরুরী। গদ্য কবিতাও তার ব্যতিক্রম নয়। গদ্য কবিতায় বরং এসবের চাহিদা বেশি।

★এবার আসি গদ্য কবিতার প্রবণতার দিকে।

বিগত তিন দশকের কবিরা কিভাবে গদ্য কবিতা রচনা করছে তার দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। কবি রিজোয়ান মাহমুদ আশির দশক হতে উজ্জ্বল কবিতা উপহার দিয়ে যাচ্ছেন। এখনো সমান সরব। নিগুঢ় দার্শনিক বোধ নিয়ে তিনি সাজিয়ে তুলেন কবিতার দেহ। অকপটে কবিতায় কথা বলার আশ্চর্যরকম শক্তি আছে তার। অব্যক্ত বোধকে নিমেষে ব্যক্ত করে দেন তার স্বাভাবিক সরলতায়। প্রেম ও কামকে তিনি কবিতায় ধরেন এক মুগ্ধ মাত্রায়। কবিতায় মানবিক চেতনাগুলোকে মিথের মোহগ্রস্থতার মাঝে উপস্থাপন করার শক্তি কবিকে করেছে আলাদা। তার একটি কবিতা এরকম—

""সংখ্যালঘু পরমারা আর আমাদের পাড়ায় আসে না। ওর চোখ বড় হয়ে লজ্জা হয়েছে দ্বিগুণ।
সে শাড়ি পরেছে বারোহাত,
চোখের কাজলে বেঁধেছে অনেক পুণ্যবতী দিন ও রাত। আসবে কেন বা একথা বলেছে মাস্টার মশাই।
খুব বেশি দূরে নয়, বিগত দু’দশক আগে এই গ্রাম ছিল সম্পূর্ণ তাদের। দুপুরের ঘনছায়া, মিঠেরোদ
স্নানের জলের ঘ্রাণে সুখী ছিল সব অন্ধকার। এরকম দিনে আমিও পরমা পায়ে হেঁটে গেছি পরানপুরে, শানে বান্ধা ঘাট, থরো থরো জল, সম্মুখে প্রাচীন রূপমহল। যে গীতার বাণী ওকে করেছে আরাধ্য তা ভস্ম হয়েছে দুর্বৃত্তের হাতে। অন্ধচোখে মাস্টার মশাই পরম মমতায় ছুঁতে পারে না পরমার মুখ।"
[পরমার মুখ, গগনহরকরা ডাকে, রিজোয়ান মাহমুদ]

এখানে কবি পাশের গ্রামের পরমার কথা বলছেন। যে কবির শৈশবের খেলার সাথী। আস্তে আস্তে মনের সাথীও হয়ে উঠেছিল পরমার অজান্তে। যদিও দুজনের ধর্ম এক নয়। পরমারা সংখ্যালঘু। সংখ্যালঘু নির্যাতিত হয়, অত্যাচারিত হয়। দুর্বৃত্তের হাতে পরমারাও সেই অত্যাচারের শিকার হয়। পরমারা বড় হয়, সেলোয়ার কামিজ ছেড়ে বার হাত শাড়ি পড়ে। কিন্তু সেই আগের মতো কি কবির কাছে ছুটে আসতে পারে? তার চোখ বড়ো হয় অর্থাৎ তার দেহে বসন্ত আসে, লজ্জার বাড়ার পাশাপাশি তার ভয়ও বাড়ে। সেই দুর্বৃত্তের ভয়। কবি কী সুন্দর করে সংখ্যালঘু নির্যাতনের চিত্রের পাশাপশি কবির প্রেমময় শৈশবকে তুলে এনেছেন। কবি গদ্য কথনের দিকেই জোর দিয়েছেন বেশি। অর্থাৎ কবি কোন বাঁধা ধরা ছন্দে না গিয়ে গদ্যের দিকে ঝুঁকে কী কবিতাময় করে তুল্লেন কথাগুলো। তাই এটা গদ্য না হয়ে হয়ে যায় গদ্য কবিতা।
-----------------------------------------
চোখ রাখুন আগামী পর্বে আসছে উত্তারাধুনিক কবিতা নিয়ে মজার মজার তথ্য.....