আজ থাকছে উত্তরাধুনিক কবিতা বিষয়ক আলোচনা
==========================
||একটু কঠিন তবে দারুণ তাত্ত্বিক||
আধুনিকতার পরে আসে উত্তরাধুনিকতা। কিন্তু এই উত্তরাধুনিকতা কী? এর ধারণা, প্রবণতা কী রকম, বিকাশ কীভাবে হল এই প্রশ্নগুলো অনেককেই আলোড়িত করে।
সাহিত্য, সমাজ, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান, রাজনীতি প্রভৃতিকে উত্তরাধুনিকতা কীভাবে প্রভাবিত করেছে, কতটুকু পরিবর্তন আনতে পেরেছে; মানবজীবনের বিভিন্ন দিকগুলোতে উত্তরাধুনিকতা কত ভঙ্গিতে মিশে আছে এরকম নানাবিধ প্রশ্ন সামনে দাঁড় করানো যায়। ফলে অনিবার্যভাবে উত্তরাধুনিকতাকে অনুধাবন করার প্রসঙ্গটি এসে যায়।
বলা হয় আমরা বাস করছি উত্তরাধুনিক কালের পরিসরে।
আধুনিকতার তিনটি পর্ব
১)আদিপর্ব
২) মধ্যমপর্ব
৩) বিকাশপর্ব
আর অতি আধুনিক পর্ব পেরিয়ে উত্তরাধুনিক কাল পর্বের নতুনত্বকে ধারণ করেই আমরা অনিবার্য ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসরমান। আর সেজন্য উত্তরাধুনিকতার সংজ্ঞাকে আত্মস্থ না করে সচেতন জীবন যাপন প্রায় অসম্ভব। অচেতনভাবে যাপিত জীবনে উত্তরাধুনিকতার প্রভাব আমরা যতটা মেনে নিয়ে চলি, তাতে আমাদের ভূমিকা থাকে শুধুমাত্র গড্ডালিকায় গা ভাসানোর, স্রোতের সাথে তাল মিলানোর। সময় এবং পরিপার্শ্বকে নিয়ন্ত্রণে আমাদের তেমন কোন কিছুই করার থাকে না।
তাই স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে -
উত্তরাধুনিকতা কী, এর লক্ষণ আর বৈশিষ্ট্য কীরূপ?
উত্তরাধুনিক সমাজবাস্তবতা হলো হাইপার রিয়েলিটি, ভার্চুয়াল রিয়েলিটিও ম্যাজিক রিয়েলিটি। আধুনিকোত্তর সমাজে বহুমাত্রিক মানুষেরা নির্মাণ ও বিনির্মাণের যুদ্ধে সক্রিয়। অহিংস ও রক্তপাতহীন এ যুদ্ধে সবাই সবার টার্গেট। এ যুদ্ধে একবাচনে যিনি নির্মাতা অন্য বাচনে তিনিই বিনির্মাতা। এক স্থানে যিনি আক্রমণকারী অন্য স্থানে তিনিই আক্রান্ত। সকল মতবাদের পতন-পথ নির্দেশ করে উত্তরাধুনিকতা নিজেই মতবাদবিমুখ ও মতবাদঘাতী হয়ে পড়েছে। বর্তমানের সংকটময় বিকাশকালকে নানামাত্রিক প্রবণতায়, বহুস্বরে ও বহুকণ্ঠে, অনেকান্তুিক ব্যাখ্যায় এবং বহু দৃষ্টিকৌণিকতা পুনর্গঠন, সংস্কার ও নবায়নের প্রচেষ্টা চলছে।… এক মহাসত্য অপেক্ষা বহু সত্যে আস্থাবান উত্তরাধুনিকতা। সত্যের বস্তুভিত্তি নেই, তা বিষয়ীভূত। সত্য টেক্সট নির্ভর; টেক্সট নির্মিত হয় ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে। বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন টেক্সট নির্মাণ করেন বিচিত্র অভিজ্ঞতার আলোকে। বহু বাচনে বহু সত্য সৃষ্টি করা হয়। এ জন্য উত্তরাধুনিকতায় মহাসত্য নেই, কোন গ্র্যান্ডন্যারেটিভ নেই। সমগ্রকে খণ্ড-বিখণ্ড করে বিশ্লেষণের প্রয়াস সৃষ্টি হয়েছে। একচেটিয়াকরণে নয় বরং বহুমুখী প্রতিযোগিতার দিকেই তার দৃষ্টি।
উত্তরাধুনিকতা সম্পূর্ণ নতুন নয়। মানবচেতনার জাগরণ, বিপ্লবের ধারায় সামাজিক নবজাগরণ, আর্থ-সামাজিক পুনর্জাগরণ ও সাংস্কৃতিক মহাজাগরণ সম্ভব হয়েছে। এ জাগরণ আজ বহুরৈখিক জটিলতা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপট উন্মোচনে উন্মুখ হয়েছে উত্তরাধুনিক চিন্তন-প্রক্রিয়ায়।
আধুনিকতার সূচনাকারী ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব এবং রেনেসাঁস আর চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব পেরিয়ে আজ উত্তরাধুনিক মানুষ ডিজিটাল বিপ্লব, জৈব-প্রযুক্তির বিপ্লব এবং চেতনার বহুমাত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করেছে।♦
♦উত্তরাধুনিকতার ধারণার মধ্যেও তিন ধরনের উপাদান রয়েছে-
১) উত্তর আধুনিক
২)উত্তর-আধুনিক
৩) উত্তরাধুনিক।
এগুলোর আদর্শিক দর্শনও ভিন্ন ভিন্ন। যেহেতু বিষয়গুলো আমি নিজেই আয়ত্তে নিতে পারি নি, তাই এ সম্পর্কে আমি বুঝাতেও পারবো না।কিন্তু কৌতুহল নিবৃত্তি হবে কী করে ? শেষে নিজে নিজেই একটা ধারণা তৈরি করে নিলাম, যা ভুল না শুদ্ধ তা নিরূপণ করাও আমার দ্বারা সম্ভব নয়। কেননা বিষয়টা একান্তই স্বকৃত।আমার ধারণায় আধুনিক কবিতা যেমন একটা উপলব্ধির বিষয়, উত্তরাধুনিক কবিতা হচ্ছে উপলব্ধিশূণ্যতার বিষয়। অর্থাৎ প্রকৃতই আধুনিক কবিতা যেমন সৃষ্ট চিত্রকল্পের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট কোন অর্থ নয়, একটা উপলব্ধিকে পাঠকমনে চালিয়ে দেয়, অন্যদিকে উত্তরাধুনিক কবিতা প্রচলিত ফর্ম ভেঙেচুরে পাঠকমনের পূর্বলব্ধ কোন উপলব্ধিকে গুঁড়িয়ে উপলব্ধিশূন্যতার অনুভূতি তৈরি করে দেয়। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, উপলব্ধি শূণ্যতার উপলব্ধি তৈরি করাই উত্তরাধুনিকতাবাদী কবিতার লক্ষ্য। আবারো বলে রাখি, পাঠক হিসেবে এ আমার একান্তই নিজস্ব উপলব্ধি। একটা উদাহরণ দিলে হয়তো আমার ব্যাখ্যাটা আরেকটু খোলাশা করতে পারবো। যেমন মনে করি, চমৎকার শিল্পশৈলিতে গড়া একটা নান্দনিক ভবন, যা দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায় বা মনে দারুণ ভালো লাগার একটা অনুভূতির জন্ম হয়। চাইলে চেয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে, আহা যদি ভবনটার ভেতরে একবার ঢু মেরে আসা যেতো। না পারলেও ক্ষতি নেই, একটা কাল্পনিক ভ্রমণের মাধ্যমেই ভবনটির স্বপ্নগভীরে ঢুকে যেতে পারি আমরা, যাতে ভালো লাগায় নিজের মতো করে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা যায়। এটাকে যদি আধুনিক কবিতার রূপক হিসেবে ধরে নেই, তাহলে উত্তরাধুনিক কবিতা হবে ওই ভবনেরই ভগ্নদশাপ্রাপ্ত এমন এক অবস্থা যার দিকে তাকালেই দেখা যাবে নির্দয় আঘাতে আঘাতে একটা করুন ইমারতের এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছেঁড়া-ভাঙা টুকরো সব। ভবনটির হা হয়ে থাকা ইট-কাঠ-সিমেন্ট-বালি-রডের ভয়ঙ্কর নগ্নতা নিমেষেই দর্শককে এমন এক উপলব্ধিহীন দশায় নিক্ষিপ্ত করবে, তার বোধ হয়তো এটা বুঝবে যে ভবনের সবগুলো উপাদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু বুঝার উপায় নেই কোথায় কোনটা কিভাবে জুড়ে ছিলো বা ভবনটি আসলে দেখতে কেমন ছিলো। এই তছনছ অবস্থায় পাঠকের সাধ্য নেই উপাদানগুলো জোড়া লাগিয়ে কোন প্রতিরূপ তৈরি করার। হয়তো অক্ষম কল্পনায় সে একটা কাল্পনিক ভবনের চিত্র তৈরি করতে চাইবে। কিন্তু দৃশ্যের রূঢ়তায় তার অক্ষমতার যন্ত্রনা তাকে এমন এক উপলব্ধিহীন বাস্তবতায় নিক্ষিপ্ত করবে যে সে একটা উপলব্ধিশূণ্যতায় আক্রান্ত হবে। অনেকটা আমার এই অক্ষম প্রচেষ্টার মতোই, বুঝাতে চাইলাম কিছু, কিন্তু অসংলগ্নভাবে কিছুই বুঝানো গেলো না ! অর্থাৎ কেবলই শূণ্যতা ! আধুনিক কবিতায় যেমন ভাব বা বিষয়ের একটা কেন্দ্র থাকে, উত্তরাধুনিক কবিতা সেই কেন্দ্রটাকে ভেঙে বা বিলুপ্ত করে অনেকগুলো কেন্দ্র তৈরি করে দেয়। ফলে পাঠক আর প্রচলিত পন্থায় কবিতা থেকে কোন একটি ভাব মিশ্রিত যে এককেন্দ্রিক রস আহরণ করবেন তার উপায় থাকে না। তিনি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। স্বাভাবিকভাবে আধুনিক কবিতার বিষয়ের কেন্দ্রে থাকে মানুষ। কিন্তু উত্তরাধুনিক কবিতা সেই মানুষকে অস্বীকার করে সেখানে অনেকগুলো বিষয়কে নিয়ে একটা ঘুটা দিয়ে দেয়। এখানে কবির যেমন দায় পড়েনি কিছু বুঝানো বা কোন ম্যাসেজ সঞ্চালন করার, তেমনি পাঠকেরও দায় থাকে না কোন কিছু উপলব্ধি করার। নিটোল উপলব্ধিময় আধুনিকতার বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহী ভয়ঙ্কর উপলব্ধিশূণ্যতাই উত্তরাধুনিকতা। কোন তত্ত্বকথা ছাড়া এটাই হচ্ছে আমার উত্তরাধুনিকতাবোধ।
এক্ষেত্রে কেউ একমত হলেও যেমন আমি কোন দায় নিতে রাজী নই, তেমনি কেউ ভিন্নমত পোষণ করলেও আমার কোন আপত্তি নেই। মোদ্দাকথা এ ব্যাপারে এটাই আমার অজ্ঞতা।
♦এছাড়া ভিন্নমতেও ভাবা যেতে পারে একটু ইতিহাস সচেতন হয়েঃ
কী অত্যাশ্চার্য ভাষায় কথা বলে রূপদক্ষ শব্দের কারিগর। কবিতা তো সেই হিরন্ময় হাতিয়ার যা মানব অন্তরকে দলিত, মথিত ও স্পন্দিত করে; সাহিত্যের অন্যান্য মাধ্যমের পক্ষে যা সম্ভব নয়। বুদ্ধদেব বসু একবার বলেছিলেন, “বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যের ইতিহাস কবিতার দ্বারা গদ্যরাজ্য জয়ের ইতিহাস।” আজ এই একবিংশ শতাব্দীতেও সম্ভবত এ কথার যথার্থতা অনস্বীকার্য। সাধারণ মানুষের জীবনে আধুনিক কিংবা উত্তরাধুনিক কবিতার বিশেষ কোন ভূমিকা আছে কিনা সে সম্পর্কে অতীতেও বিতর্ক ছিল আজও হয়তো আছে কিন্তু বর্তমান বিশ্ব বিপুলভাবে যান্ত্রিকতার দিকে এগিয়ে গেলেও কবিতাকে নির্বাসিত করা হয়নি। বস্তুতপক্ষে ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ দেশগুলোতে নতুন নিরিখে নতুন আঙ্গিকে আবিষ্কার করে কবিতাকে প্রতিষ্ঠার কাজে উদ্যোগী হয়েছেন সেসব দেশের আধুনিক ও উত্তরাধুনিক কবিরা। বর্তমান কালের কবিতা বৈদগ্ধ প্রজ্ঞা ও আদিমতাকে ধারণ করে, ইচ্ছার ক্রমিকতায় এবং আনন্দের সংক্রমিকতায় খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করছে একটি অনির্বচনীয় উত্তরণের। বর্তমান কালের কবিতা মানবীয় ইচ্ছাকে অতিক্রম করে মানব স্বভাবের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে প্রকৃতির মত। বাংলাদেশের কবিতাও প্রবল পরাক্রান্ত এবং সুতীক্ষ্ণ ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রবীন্দ্রত্তোর বাংলা কবিতা ত্রিশের বলিষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু এই পঞ্চপাণ্ডবের হাত ধরে প্রবিষ্ট হয় আধুনিক ও আন্তর্জাতিক বলয়ে। তাঁদের প্রজ্ঞা মেধা ও মননের ধার আধুনিক বাংলা কবিতাকে দিয়েছে এক অনিবার্য গতি। তিরিশের সার্থক উত্তরাধিকার বহন করছেন পঞ্চাশের ক’জন উজ্জ্বলতম কবি। এঁদের মধ্যে রয়েছেন আহসান হাবীব [চল্লিশের দশক], শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এঁরা স্ব স্ব ভাবে কাব্যচর্চা করে আধুনিক বাংলা কাব্যকে অধিকতর শক্তিশালী করেছেন। ষাটের দশক আমাদের মানসলোকের ক্রান্তিকাল। অস্থিরতা, নৈরাজ্য, নৈরাশ্য ও অবক্ষয়জনিত একটি দশক। এ দশকের কবিদের কবিতা পড়লে মনে হয় যেন কবিরা অমৃত ও গরল উভয়ই পান করেছেন। একদিকে যেমন তাঁরা উচ্চারণ করেছেন যন্ত্রণার প্রদাহ, অন্যদিকে ছিলেন নতুন শপথে দীপ্ত। পঞ্চাশের উজ্জ্বলতমদের উত্তরসূরী তাঁরা, তাই অনিবার্যভাবে মেধা ও মননের চর্চা পরিলক্ষিত হয় তাঁদের কবিকর্মে। নিরন্তর পরীক্ষা নিরীক্ষায়ও ব্যাপৃত ছিলেন তাঁরা। এ দশকের কবিদের কেউ কেউ বোদলেয়ারের স্মরণাপন্ন হন, কেউ আবার দুঃখবাদী কবি র্যাবোর আশ্রয় গ্রহণ করেন। প্রথাসিদ্ধ পথ না মাড়িয়ে ষাটের কবিরা উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প ও শব্দচয়নে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য আনার চেষ্টা চালান, যা আধুনিক বাংলা কবিতার ধারায় আরেকটি মাত্রা সংযোজন করে। তাঁরা তারুণ্যের যন্ত্রণা এবং সত্য জীবনবীক্ষা উপস্থাপন করে তারই রসে কবিতাকে সম্পৃক্ত করেন। এ দশকের যে সব কবি উজ্জ্বল সাক্ষর রেখেছেন তাঁদের মধ্যে রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন আজাদ, সিকদার আমিনুল হক, আব্দুল মান্নান সৈয়দ এবং আবুল হাসান প্রধান।সত্তর ও আশির দশকে আধুনিক বাংলা কবিতা ষাট দশকের ধারাবাহিকতা মেনে চলেনি। সত্তরের দশকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় ছিল চূড়ান্ত ভাবে অরাজকতাপূর্ণ। তরুণদের হাতে ছিল কবিতার বইয়ের বদলে জমা না-দেয়া অস্ত্র। স্বাধীনতার উজ্জ্বল আভার বৈপরীত্যে সবার চোখে ছিল বিপন্ন বিস্ময়। মুদ্রাস্ফীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের সংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, সামাজিক অবক্ষয় ইত্যদি মিলে সত্তর ও আশির দশকের কবিতা সুস্থ রূপ পরিগ্রহণে সক্ষম হয়নি। এ-সময়ের কবিরা তাদের সমসাময়িক কালকে সঠিক শিল্পমানে সমৃদ্ধ করতে পারেননি। সীমাহীন শূন্যতাবোধ থেকেও মহৎ কাব্য উৎসারিত হতে পারে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তা হয়নি। একটি অস্থির সময়ে শিল্প-সাহিত্য নিজস্ব গতিতে চলে না। এ নিয়ম ভেঙে গতি আনার জন্য যে ধরনের শক্তিশালী কবির প্রয়োজন তা দেখা যায়নি এ দু’দশক জুড়ে, যদিও আশির দশকের কিছু কবি ষাটের কাব্যচেতনা লালনের চেষ্টা করেছেন। অন্যদিকে পাশ্চাত্যের পাপাচারকে উসকিয়ে দিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা লাভে সচেষ্ট ছিলেন কেউ কেউ─আবার শ্লোগানে শ্লোগানে মুখর ছিলেন অনেকে। এর মাঝেও আমাদের কবিতাকে উজ্জ্বল করেছেন অনুরাধা মহাপাত্র, আবিদ আজাদ, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও আবু হাসান শাহরিয়ার। নব্বই দশকের কবিরা কবিতাকে ভিন্ন পথগামী করার কাজে ব্রতী হন। এই স্থিতিশীল সময়ে তাঁরা বিদেশী মিডিয়া ও ইন্টারনেটের প্রতি আকৃষ্ট হন। বিশ্বকাব্য সাহিত্যের নবদিগন্ত উন্মোচিত হয় তাঁদের কাছে। তাঁরা অনেকেই উত্তরাধুনিকতাবাদে মনোযোগী হন। সমকালীন চিন্তাজগতের এক মহাবিষ্ফোরণ এই উত্তরাধুনিকতাবাদ, বহু সমর্থিত এবং বহু নিন্দিত একটি অভিজ্ঞান রূপে দ্রুততর সময়ে এত প্রচারিত এবং সম্প্রসারিত হয়েছে যে এ নিয়ে তর্ক করা যায় কিন্তু উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাত্ত্বিকদের সাথে একমত হয়ে তাই বলা যায়, উত্তরাধুনিকতা একটি অতিশয় দুর্ভাগ্যজনক শব্দ। দুর্ভাগ্যজনক বলেই শব্দটিকে যত্রতত্র ব্যবহৃতও হতে দেখা যায়; অনেক ক্ষেত্রেই অন্তর্নিহিত তাৎপর্যমণ্ডিত দর্শন বিবেচনায় না এনে। উত্তরাধুনিকতা একটি বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া বা ব্যত্যয় যা অতীতে ফিরে স্পর্শ করতে পারে বাল্মীকিকে, অন্যদিকে স্পর্শ করতে পারে বিজ্ঞানের আবিস্কৃত সর্বশেষ নক্ষত্রবলয়। তাত্ত্বিকেরা যেমন আধুনিকতাবাদের আলোকবর্তিকায় প্রবাহিত শতাব্দীর সনাতন ঐতিহ্য, জীর্ণ ও ধর্মীয় আচার অনুশাসন ও নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদির প্রতিপ্রশ্ন তোলেন, এ-সময়ের কবিরাও মূল্যবোধ থেকে যে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের জন্ম তার দ্বারা শাসিত না হয়ে নৈরাশ্যবাদী হয়ে ওঠেন। অতএব উত্তরাধুনিকতাবাদ মূলত আধুনিকবাদ এবং আলোকপ্রাপ্ত শতাব্দীর মিথ্যে আশাবাদ, নৈরাশ্য ও অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে একটি শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। এতে করে নেতির সমর্থনে ইতিকে আনা জরুরী হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে উত্তরাধুনিক কাব্যচর্চা যথার্থ সাফল্যের দিকেই এগিয়েছে। এ সময়ের কবিরা মনন ও মেধায় বলিষ্ঠ। উত্তরাধুনিক কবিতা এবং প্রথাসিদ্ধ কবিতা সমার্থক নয়। এ কবিতা শিকড় সন্ধানী। কখনো অরণ্য জনপদে, চর্যাপদের আলো-আঁধারির জগতে, মধ্যযুগের গীতি কবিতায় আবার কখনো নক্ষত্র মণ্ডিত মহাকাশে আলোক সিঞ্চন করে এগিয়ে যান আমাদের উত্তরাধুনিক পর্বের কবিরা। স্বদেশের জল মাটি ও কাদার সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে দেশজ উপমা উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পের পাশাপাশি ক্ল্যাসিকে সমর্থিত হয়ে ওঠেন এঁরা। নব্বই দশকের এই উত্তরাধুনিক উজ্জ্বল কবিদের অন্যতম শব্দগুচ্ছ সম্পাদক হাসানআল আব্দুল্লাহ। তাঁর স্বতন্ত্র সনেট নামের সনেট সঙ্কলন ছন্দোপ্রকরণে ও চিত্রকল্প নির্মাণে স্বাতন্ত্র্যের ভাস্বর। আব্দুল্লাহর প্রকাশিত বৃহৎ কাব্যগ্রন্থ "নক্ষত্র ও মানুষের প্রচ্ছদ" উত্তরাধুনিকতার স্বীকিরণে ও বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। ধ্রুপদী শব্দ চয়ন, সর্গ বিভাজন, ছন্দ ব্যবহার রীতি ইত্যাদির সংমিশ্রণে এ গ্রন্থটি মহাকাব্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ক্লাসিক ও মিথ উভয়ের দ্যোতনা রয়েছে এই কাব্যে। বায়তুল্লাহ কাদেরী ধ্র“পদী-সঞ্চারি একান্তব্যক্তিক, নৈঃসঙ্গ-সম্পৃক্ত কবি। রহমান হেনরীর কবিতা প্রায়শই জল-মাটির কাছাকাছি। উভয়েই চর্যাপদের প্রজ্ঞাময়তা, বৈষ্ণব কাব্যের অন্তর্নিহিত নির্যাস এবং মিথকে সংস্থাপিত করছেন তাঁদেরকবিতায়। শব্দ-প্রয়োগ কৌশল এবং চিত্রকল্প নির্মাণে এঁরা ব্যতিক্রমী; এবং উল্লিখিত এই তিন কবিই শেকড়-সন্ধানী। টোকন ঠাকুর, আলফ্রেড খোকন, তুষার গায়েন, প্রবীর দাশ নব্বইয়ের উল্লেখযোগ্য কবি। পরিশীলিত ও পরিমার্জিত ভাবে এগিয়ে কবিতা লিখছেন শামীমরেজা, নাজনীন সীমন, ওবায়েদ আকাশ এবং রুকসানারূপা। দৃঢ় আশাবাদের প্রত্যয় রয়েছে এঁদের প্রত্যেকের কবিতায়।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি। সঞ্চয়িতা প্রকাশ কালে তিনি বলেছিলেন, “I do not believe in any superlative degree," যদিও তিরিশের কবিরা তাঁকে কবিগুরু আখ্যায়িত করেছিলেন নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থানের জন্যে। রবীন্দ্র পরবর্তী আধুনিক বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ। এখন সম্ভবত একথা বলা ঠিক হবে যে যুগ-ধর্মই নির্ণয় করে একজন কবি বা সাহিত্যিকের শ্রেষ্ঠত্ব। উত্তরাধুনিক কবিদেরও শেষ পর্যন্ত ওই কালের কাছে নত হতে হবে। নিরবধি কালই সাক্ষ্য বহন করে শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের।
[আগামী বুধবার ৫ম পর্বে থাকছে আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদ নিয়ে জটিল অথচ মজাদার বিষয়--- ]
★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★
টুঙ্গিপাড়া,