কবিতা কবি-জীবনের অনুসঙ্গ। অন্তহীন জীবনের অজস্র পথের বাঁকে নিজেকে খুঁজে ফেরা হাজার বছরের ব্রাত্য-নাগরিক প্রতিনিধি হচ্ছেন স্বয়ং কবি। কবি  তার তত্ত্ব তালাশকে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তকে পঙক্তির পর পঙক্তির অবয়বে ফুটিয়ে তোলেন। তা নয় কি? একমাত্র কবির পক্ষেই এই প্রশ্নের জবাব দেয়া সম্ভব। জবাব না পেলেও প্রকৃত পাঠকের কিছু যায় আসে না কেননা তিনি কবিতার রন্দ্রে রন্দ্রে হেঁটে হেঁটে কবিতার মর্মমূলে পৌঁছতে পারেন; অন্তরের অন্তর্লোকে ধারন করতে পারেন কবিতার নান্দনিক সুষমা এবং অনুভব করতে পারেন কবির সেই আপাত অমসৃণ দুর্গম বন্ধুর পথ পরিক্রমার স্বপ্নচারী আবেগিক মুহূর্তগুলিকে।  যা পাঠকের চেতনালোকে প্রেম- প্রজ্ঞার দীপ্তিমিতি হয়ে ঔজ্জ্বল্য ছড়ায় আজীবন। অজস্র কবিদের ভীড়ে আমার আজকের আলোকপাতের কবি জীবন ও প্রকৃতি নিয়ে যিনি হাজার বছরের জীবনাবিজ্ঞতার জারকরসে পুষ্ট প্রত্যক্ষদর্শী এক নাগরিক কবি। তিনি তার স্বল্প পরিসর জীবনে নিজে দেখে যেতে পারেন এবং আমাদেরকে দেখিয়ে যেতে পারেন পৃথিবীর জন্ম মৃত্যুর অজস্র ইতিহাস।যা একমাত্র প্রকৃত কবির পক্ষেই সম্ভব। জীবনানন্দের 'সেই হাজার বছরের 'দীর্ঘপথ একজীবনে পাড়ি দেয়া আমার বিবেচনায় একজন কবির অমর কীর্তি।  যদিও মহাকালের প্রতিতুলনায় কবি বেঁচে থাকেন কয়েকটি মুহূর্ত  মাত্র। আমার দেখা, চেনা এবং জানা একজন কবি মোঃ সিরাজুল হক ভূঞা সেই চিরজীবন্ত কবিদেরই যোগ্য উত্তরসূরী। যিনি এখনও দুঃখজীর্ণ পৃথিবীতে অসংখ্য বিপন্নবোধের দ্বারা তাড়িত হওয়া সত্ত্বেও প্রাণোচ্ছল, আত্মবিশ্বাস ও প্রত্যয়দৃঢ়তা নিয়ে অতিক্রম করার চেষ্টা করছেন প্রকৃতির যাবতীয় অন্ধকার। আর তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে কবিতার প্রতি, ঈশ্বরের পৃথিবীকে প্রত্যক্ষ দৃষ্টিতে দেখবার চোখ নিয়ে তাপস হয়ে উঠতে পারার কারনেই।
তার চার চারটি কবিতার বই
★জীবন ও প্রকৃতি
★প্রকৃতির ছোঁয়া
★প্রকৃতি ও প্রেম
★ স্মৃতি ও প্রকৃতি শিরোনামে এবারকার বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশ পেয়েছে। প্রতিটি কবিতার বই ঝকঝকে তকতকে ছাপা, কভার বোর্ড বাইন্ড, নির্ভুল বানানে উন্নত মননশীলতা দিয়ে প্রকাশক মোঃ বুলবুল হোসেন, বুলবুল পুস্তক প্রকাশনী কালিহাতি, টাঙ্গাইল হতে প্রকাশ করেছেন।
"জীবন ও প্রকৃতি "শিরোনামীয় বইটির নাম ভূমিকার কোন কবিতা না থাকলেও জীবনের নানা রঙ নানা অধ্যায়কে প্রকৃতির সঙ্গে একীভূত করে কবি সুচিত্রণে চিত্রিত করেছেন তার দরদী হাতে। ৫৬ টি কবিতা দিয়ে ৪ ফর্মার বইটিতে "রূপের পাহাড় মালনীছড়া" শিরোনামে কবিতায় কবি বললেন,
"সিলেট শহর ঠায় দাঁড়িয়ে মালনীছড়ার পাশে,
দেখতে পারো মালনীছড়া যদি সুযোগ আসে।
মালনীছড়া ছেড়ে আসা এতো সহজ নয়,
দিন বদলে ঝরে পড়া প্রেমও জিন্দা হয়।"

প্রকৃতির অনুপম স্নিগ্ধতা, রূপ লাবণ্যে ভরকরা সুর ছন্দের প্রতিটি কবিতায় কবি বুনে দিয়েছেন একদম সহজ সহজ স্বপ্নের আলপনা

"নিঝুমদ্বীপে নীরবতা" কবিতায় কবি লিখলেন

"ঢেউ উঠে ছুটে আসে সাগরের পানি,
লোনাজলে ভেসে যায় দ্বীপ আটআনি।
কেওড়াতলা ভরে উঠে জোয়ারের জলে,
সুনসান  নীরবতা  মধ্যরাত  হলে।"

একই দ্বীপ নিয়ে "নিঝুমদ্বীপ মন কাড়ে  "শিরোনামীয় কবিতায় তিনি শেষাবধি লিখলেন,
"বাংলা মায়ে এমন দ্বীপ আর কোনোটা নাই,
নিঝুমদ্বীপের মতো করে এমন মজা পাই।
তীরে যখন জোয়ার আসে
মনটা তখন শূন্যে ভাসে
নিঝুমদ্বীপের চতুর্পাশে জোয়ার দেখে যাই।"

বাংলাদেশের ফুল-ফল, পশু- পাখি,নদী-পাহাড়, পর্যটনের আকর্ষনীয় অঞ্চলের রূপ বর্ণনা কবির নানা কবিতায় এসেছে। বাংলাদেশের রাজশাহী জেলাও তার আশপাশে প্রচুর আম চাষ হয়। আমের বর্ননাসহ "তৃপ্তির বাতি" শিরোনামে তার একটি কবিতায় রাজশাহী জেলাকে নতুন অভিধায় ভূষিত করে লিখলেন,
"পাকা আমে সারা দেশ সয়লাব হয়,
নিজ গুণে আম করে জনমন জয়।
পেট ভরে আম খেয়ে স্বাদ নিয়ে মাতি,
আমের জন্য রাজশাহী তৃপ্তির বাতি।"

কবির কবিতায় চিরকালীন তৃপ্তি ও এই তৃষ্ণাকালীন বোধ- অতল অন্তহীন কবিতাসমুদ্রে স্নানকাতর পাঠক হৃদয়েরই এক প্রোজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ। আর তাই কবি সিরাজের কবিতা প্রতিবেশের জায়মান বৈরিতার দাবদাহের ভেতরে, জেঁকে বসা অশান্তির ভেতরে আমাদের হৃদয়ে বয়ে আনে গীতল প্রশান্তি

কবির এমনতর সহজ সরল শব্দ বাক্য উপমা অলংকারে ভরপুর আমাদের লোকজ এতিহ্য,  জীবন ও প্রকৃতির অপার বিস্ময় নিয়ে লেখা কবিতার মধ্যেও আছে আধুনিকতার চরমতম ছোঁয়া। তার "স্মার্ট বাংলার রূপ" কবিতাটি পাঠ করতে করতে ইতি টানবো। আমার বিশ্বাস সমাদৃত হবে কবির এ কবিতার বইটি।
"কৃষকের ক্ষেতে আজ ভরা বোরো ধান,
আরো আছে তাঁর ঘরে বাটা ভরা পান।
কথা শুধু কথা নয় যথা রূপায়ণ,
হাইব্রিড চাষ নিয়ে ভাবে সারাক্ষণ।

মান্ধাতার চাষাবাদে উন্নতির ধারা,
চৈত্রের অতি খরায় সেচে পানি ছাড়া।
কলে জল কলে চাষ কলে কেটে আনে,
আজ আর ঢেঁকি নয় কলে ধান ভানে।

থানা কৃষি অফিসার কৃষকের পাশে,
ঘুরে ঘুরে ক্ষেত দেখে আসে প্রতিমাসে।
সহকারী অফিসার প্রতিদিন পায়,
দৌড় দিয়ে কৃষকেরা যার কাছে যায়।

ডিজিটাল সেবা দেয় প্রতি ইউনিয়ন,
ভরে উঠে গ্রামগঞ্জে কৃষকের মন।
উন্নয়ন করে যায় স্থানীয় সরকার,
দরকারে কৃষকেরা যায় বারবার।

খরকুটোর ঘর দেখি বিলিনের পথে,
কৃষকের বাড়ি আজ ইঁট গাঁথা রথে।
প্রত্যন্ত গ্রামেও দেখি শহরের ছায়া,
ডিজিটাল সেবা পায় নাই কোন ভায়া।

পাকা রাস্তা পল্লীবিদ্যুৎ প্রায় বাকি নাই,
গ্রামগঞ্জে হাঁটা পথে অটোতেই যাই।
গ্রামে থেকে শহরের সুবাতাস পায়,
সুদিন চলে আসলো স্মার্ট বাংলায়।
__________________________________