হাল আমলে নিঃসন্দেহে বাংলা কবিতা ডট কম নবীন প্রবীন কবিদের একটি বাতিঘর। প্রতিদিন বাড়ছে কলেবর, প্রতিদিন বাড়ছে কবিদের বিচরণ। দিনের অনেক সময় তাই প্রেমিকার মতো কেড়ে নিচ্ছে বাংলা কবিতা।তৃষ্ণার্ত থাকতে হয় অতঃপরও।
বাড়ছে প্রত্যেকের সংগ্রহশালা। নেশার লাটিম যেমন ঝিম ধরে, সময়কে ফাঁকি দিয়ে বাংলা কবিতায় কবিদের মুগ্ধ অংশগ্রহন আরো সামনে এগোতে সাহস যোগায়। ছড়ানো ছিটানো লেখা গুলোকে একত্রিত করে একটি জায়গায় অগনিত কবি লেখক পাঠকের চোখের নাগালে, পাঠের নাগালে রাখতে পারা কম কথা নয়। তাই সকল সময়ই বাংলা কবিতা ডট কম এর প্রতিষ্ঠাতা আর সৃষ্টির অনুপ্রেরণাদাত্রীর (প্রতিষ্ঠাতার সহধর্মিণী) প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে আজ আমার একটি নতুন বিষয়ের অবতারণা করছি।
বাংলা কবিতা আসরে দুই বছর ধরে লিখছেন একজন কবি। তিনি কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বেড়ে ওঠা কবি মোঃ আমির হোসেন। স্বাধীন স্বত্বা নিয়ে দিন যাপনের চিন্তায় তিনি সরকারী চাকুরী ছেড়ে ব্যক্তিগত জীবন বেছে নিয়ে অনবরত লিখে চলেছেন। কবিতা তার স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা। জীবনবোধের কঠিন জিঞ্জির ভেঙ্গে শব্দের অবাক কারিশমায় তিনি তুলে আনেন সত্যিকারের বোধের কবিতা। সমাজ রাষ্ট্র দেশ, প্রকতি প্রেম আর জীবন
ভাবনার অপূর্ব সব কবিতায় তার মধ্যকার কবি স্বত্বা, দ্রোহ স্বত্বা, জীবন দর্শন উঠে এসেছে। বাংলা কবিতা আসরে তিনি এ যাবত ৩৩৬ টি কবিতা পোস্ট করেছেন। চলতি মে/২২ মাসের অদ্যাবধি তিনি ৬ টি কবিতা পোস্ট করেছেন। আশাকরি ছয়টি কবিতা নিয়েই আজ অল্প বিস্তর আলোচনা করবো। যা পাঠপূর্বক কবি মোঃ আমির হোসেনের কবিতার রূপ রস গন্ধ আর বর্তমান কবিতার নানা বিষয় নিয়ে আমরা অল্প বিস্তর জানতে সক্ষম হবো।
আজই তার পোস্টকৃত কবিতা "রক্তাক্ত প্রহর"
কবি স্বগতোক্তি করছেন আর অবচেতনে অন্তঃকরণে হাঁটছেন রাজপথে, ভাবছেন এই বিষণ্ণ সময়ের ভাবনা। জীবনের প্রবল চাহিদার কাছে দৃষ্টি দিয়ে দেখছেন অবোলা অসময় জেঁকে বসে আছে। প্রকৃতিও তার সঠিক চলার খেয়ালকে ছেড়ে চরম বিরাগ আমাদের এই নগর সভ্যতার ওপর। কবিতায় তিনি বলছেন,
"এলেবেলে হাঁটছি, দ্বিপ্রহর, ক্লান্তিকর,অকালপক্ক বেয়াদব রোদের ভেতর!
ক্রমাগত বেলাজা হয়ে উঠছে জ্যৈষ্ঠের গতর;
মুগদা বিশ্বরোড ধরে হেঁটে যেতে দেখেছি
মরে পরে আছে বিকলাঙ্গ ভোর।"
এই জ্যৈষ্ঠের খরতাপে ভোরের তরতাজা রোদ বাতাস পরিবেশ কোনটাই নেই। রাজধানী ঢাকা শহরে মুগদা বিশ্বরোড ছেড়ে এবার কবি লিখলেন,
"বংশাল মোড়ে খাঁড়া কানকাটা বেহায়া দুপুর, চারদিকে ঝুলে আছে-এলোমেলো পোড়েন বিস্তর;
নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে-দুঃসহ এক ধুসর নগর"
শহরের জনকোলাহল হতে দূরে কোন এক দুঃসহ ধূসর নগরে যেন কবি দাঁড়িয়ে আছেন, দেখছেন বিভ্রমের পুচ্ছ উড়ে যায় পাঁচমিশালী ভাবনাদের নিয়ে। তারপর কবি আবার বলছেন,
"বিবর্ণ নীলিমায় লুকায় স্বস্তির মুখ।
তবুও দিন যায়, চকিত চোয়ালে ঢুকে
থেমে যায় সব কোলাহল।"
আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়, ছায়ায় স্বস্তি আসে আবেগহীন বিষণ্নতায় রাতের অন্ধকার ভেদ করে বেরিয়ে আসে কবির আরাধ্য রক্তিম সকাল।
"নিরাবেগ বিষণ্নতায় খুলে যায় রাতের আগল,
বিষুবরেখায় ঝুলে থাকে-আলম্বন গিলে খাওয়া এক রক্তাক্ত প্রহর!"
আধুনিক শব্দালঙ্কারের ঝংকারে কবি উচ্চমার্গের এ কবিতায় একটি আশা একটি বেদনার রূপকল্প এঁকে দিলেন অবলীলায়।
২০/৫ তারিখে পোস্টকৃত কবিতার শিরোনাম
"রাতের শরীর"
"দুরন্ত গতির গাড়িটি থেমে গেছে /বিকল হয়ে পড়ে আছে অবেলায়,/রাত্রির চোয়ালে ঢুকে গেছে রাত /আধাঁর হাতড়ে হাতড়ে হেঁটে,/ হারিয়ে গেছে গন্তব্য সময়।"
কবিতাটির শরীর জুড়ে কোন ক্ষয়িত এক জীবনের কষ্টকান্না গুমরে কেঁদে যাচ্ছে। জীবনের আলোক প্রবাহ দূরে আরো দূরে নিক্ষিপ্ত হয়ে অন্ধকারকে আলিঙ্গন করে কবি নীরব নিস্তব্ধতা আশা করছেন।
স্বল্প কলেবরে উপস্থাপিত কবিতার শেষে এসে দেখা গেলো
"ইতস্তত সময় পোহায় নিস্তব্ধতা,
অসকাল বুকে নিয়ে/প্রদক্ষিত সময়ের গায়ে/লেপ্টে আছে রাতের শরীর!"
বিষণ্ণতা কাটছে না। জেঁকে বসে আসে ঘাড়ের ওপর নিস্তব্ধ অন্ধকার।
মানুষ মরণশীল। মৃত্যুই তার শেষ ঠিকানা। মহাজ্ঞানীগন মৃত্যুর অমোঘ বিধানে লিখে রেখে গেছেন তাদের সমৃদ্ধ চিন্তন। তেমনি কবিগনও কম যাননি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বলেছেন,
মরনরে তুঁহু মম শ্যাম সমান
আবার এই মাটি আলো বাতাসকে ছেড়ে যাবার বিনয়ী কষ্টকে ধারণ করে তিনি জীবনকে টানতে গিয়ে বললেন,
মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই।
কবি শারীরিকভাবে থাকতে না পারলেও মানবের মাঝে বেঁচে আছেন সত্য। কিন্তু সে তো রবি ঠাকুরের কথা। এই সমাজ রাষ্ট্রে আর দশজন মানুষতো আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন। আমাদের এ আসরের আলোচ্য কবি মোঃ আমির হোসেনও তেমনি এই উত্তরাধুনিক কালখণ্ডে এসে তার "চলে যাবো "নামক কবিতায় কবির অবর্তমানকালকে চিহ্নিত করে জীবনের এক এপিটাফ লিখলেন। আমাদের দেশেরই এক ২৯ বছরের টগবগে যুবক কবি আক্তারুজ্জামান লেবু মারাত্মক মর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে শুয়ে হৃদয় বিদীর্ণ করা যেসব কবিতাগুলি লিখে এদেশের বহুজনকে কাঁদিয়েছেন। আমার সে সুযোগ হয়েছিল তার বহু কবিতা নিয়ে সুবিশাল ধারাবাহিক আলোচনার। মায়ের কাছে লেখা তার করুণ কান্নার কবিতা মৃত্যু পরবর্তীতে কবরে ঝুলিয়ে দেবার যে কষ্ট, তা আমরা লক্ষ্য করেছি। ঠিক যেন প্রায় তেমনই একটি প্রতি কবিতা " চলে যাবো"
চলে যাবো কোন একদিন
থেকে যাবে এই বিস্তীর্ণ আকাশ,আগের মতোই থাকবে সুদূর নীহারিকা,গ্যালাক্সীর পেটের ভেতর
বিলিয়ন নক্ষত্রের ধূসর জোছনার হাটে
বিলি করা হবে অদূর পৃথিবীর ভাবনা!"
একদম সহজ সরল ভাষায় কবির চলে যাওয়ার পর এই প্রকৃতির কী অবস্থা হবে তারই একটি চিত্র তিনি কবিতায় আঁকলেন।
রাতের প্রহর, থেকে থেকে শোনা যাবে ডাহুকের ডাক।
ভেসে আসবে “আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম,”আমতলার ফাঁক গলে দেখা যাবে ভোরের সোনাঝরা রোদ।
ভরা যৌবনে ভেদরের বিলে
আগের মতোই ফুটবে চোখ জুড়ানো শাপলার ফুল,
মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি বর্ণনার শেষদিকে কবি সকাতর হয়ে বলছেন,
কাঠালিয়ার তীর ধরে কেউ হেঁটে যাবে কাঠপট্টির দিকে,এই ধানক্ষেত, মাটির গন্ধ, ধুলি উড়ানো সাঁঝের বেলা
সব থেকে যাবে আগের মতোই।
থাকবো না আমি, এখানে কোন একদিন,এই দেশ, এই মাটির সাথে মিশে থাকা
আমার আজন্ম স্মৃতিরা হারিয়ে যাবে
মহাকালের পথে!
মৃত্যুচিন্তা আর দেশ প্রকৃতি মানুষকে অন্তঃকরণে ভালোবাসার কী অসাধারণ প্রতিফলন কবিতায় উঠে এলো! কবি জানেন একদিন তাকে চলে যেতে হবে তবুও তার স্মৃতিপটে আগাম এসে বার্তা দিয়ে গেলো
পৃথিবীর রপ রস গন্ধ কেমনতর হবে। কেমনই থাকবে এই দেশ মাটি মানুষ।
"সময়ের দস্তাবেজ " শিরোনামীয় কবিতাটিতে একবার চোখ বুলিয়ে দেখুন কবি লিখেছেন,
"নীরবে এবং কখনো সশব্দে
বরাদ্দ দিনগুলি খরচ হয়ে যাচ্ছে অহেতুক!
শরণার্থী স্বপ্নের বোঝা মাথায়,
সময়ের দরবারে-হাজারো দর কষাকষিতেও
সুরক্ষা হারায় ভাগ্যের ঘন্টাঘড়ি।
অস্তিত্বের অতীত হাতড়ে-বকেয়া পরিশোধ করে যাচ্ছে
ক্ষতবিক্ষত সত্যের শরীর;
এবং গলগলে রক্তে
ভিজে চলেছে সময়ের দস্তাবেজ!
দস্তাবেজ শব্দার্থ দলিল পাট্টা, নথি, নথিপত্র। কবি সময়ের দস্তাবেজ বা দলিল বলে কবিতাটিতে একজন মানুষ একটি জীব অথবা কোন বস্তু বা বস্তুসমুহ সংক্রান্তে বলছেন জীবনের জন্য ঈশ্বর কর্তৃক বরাদ্দকৃত দিনগুলি অবহেলে পার হয়েই যাচ্ছে। সামান্য সময়ের আশ্রয়প্রার্থী মহাকালের নিকট যতটাই দর কষাকষি করুক না কেন নিয়ন্তা কর্তৃক বণ্টনকৃত সময়ই ডেসটিনি।
"কষ্টগুলি জীবিত হয়ে উঠছে" নামক কবিতায় কবির নিজ ভাষায় পাঠ করতে পারি,
সময়টা এমন চলছে যে,
পুরাতন কষ্টগুলি পুনরায় জীবিত হয়ে উঠছে!
সমস্ত ক্ষত, নিরাময় করার পরিবর্তে
প্রতিটি মিনিটকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে-ধূসর চক্রের মুখোমুখি।
চরম হতাশাকে অস্বীকার করার যে ধৈর্য
আমার ভেতরে প্রোথিত ছিলো,তাকে উপড়ে
ছুড়ে ফেলা হয়েছে সর্বকালের প্রবাহে।
আমি দুঃখের অশ্রু দিয়ে
নতুন করে আঘাতগুলিকে সুখের প্রলেপ দিতে চাই
কবি হতাশাগ্রস্থ আবার হতাশা দূর করার প্রত্যয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ। হতাশাময় কবিতা কোন সমাধান নয়। তাই তিনি সুনিপুণ হাতে লিখলেন,
"আমি দুঃখের অশ্রু দিয়ে
নতুন করে আঘাতগুলিকে সুখের প্রলেপ দিতে চাই"
এখানেই কবিতার স্বার্থকতা, এখানেই কবিতার দায়বদ্ধতা। তবুও বলতে হয় কবিতায় যেমন বানের মতো দুঃখ নেমে আসবে তেমনি থাকতে হবে উত্তরণের পথ। থাকতে হবে উপমা অলংকার আর আধুনিক কবিতায় ছন্দের দ্যোতনা কাব্যিকতার চমক।
বাংলা কবিতা আসরে অনেক বোদ্ধা কবিতা ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, রয়েছেন অনেক সাহিত্য রসবোধ সম্পান্ন পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। তাদের প্রত্যেকেরই স্বকীয় চিন্তা চেতনায় কাব্য সাধনার প্রয়াস রয়েছে। কবি মোঃ আমির হোসেন তার বাইরে নন। তবে তার স্বল্প সংখ্যক কবিতা পাঠে সার্বিক আমির হোসেন বিবেচনা করা সমীচীন নয়। তার এ স্বল্প সংখ্যক কবিতার মধ্যিখানে বিচরণে এটাই প্রতীয়মান, সমাজ রাষ্ট্র দেশ মৃত্যু জ্বরা যন্ত্রণা আর জীবনের কোন এক না ছোঁয়ার আক্ষেপ তার কবিতায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। এই জল এই মাটি কাদা মেখে কবিতার যে বিচরণ, তা সার্থকতার শিখরে পৌছে যাক। হয় হোক বাংলা কবিতার।