১৯২১ সাল। এপ্রিলে কুমিল্লার দৌলতপুরে আলী আকবর খান নামের অগ্রজতুল্য এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যায় এক ছন্নছাড়া পলটন ফেরত কিশোর সৈনিক। সেখানে গিয়ে বন্ধুর ভাগনীর প্রেমে পড়েন। জুনের ১৭ তারিখ এই প্রেম বিয়ের পিঁড়ি অব্দি গড়ায়, কিন্তু ওই পিঁড়ি অব্দিই; পিঁড়ি থেকেই চির-বিচ্ছেদ!

কলকাতায় ফিরে বড়দিনের ছুটিতে, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের কোনো গভীর রাতে ২২ বছর বয়সী সেই কিশোর হঠাৎ কলম তুলে নিয়ে লিখে ফেললেন ১৪৯ লাইনের একটি দীর্ঘ কবিতা। না না, ভুল বললাম—কলম নয়, ফাউন্টেন পেন কেনার মত টাকা ছিল না। দোয়াতে বারবার কলম ডোবাতে হয় বলে কবি বেছে নিয়েছিলেন পেন্সিল। কবিতা এর আগেও লিখেছিলেন তিনি। 'মোসলেম ভারত' পত্রিকায় বের হওয়া তার কবিতা পড়ে স্বয়ং মধ্য গগনে দেদীপ্যমান রবীর মনেও আগ্রহ জন্মেছিল এই বিস্ময়-কিশোর সম্বন্ধে। সে যাই হোক, পরদিন ভোরবেলা প্রথমেই বন্ধু মুজফফর আহমদকে কবিতাটি শুনালেন। মুজফফর আহমদ সামনাসামনি প্রশংসা করতে পারেন না। তাই কবিতা শোনার পরও তিনি উচ্ছ্বসিত হতে পারেননি।

বেলা গড়ালে 'মোসলেম ভারত' পত্রিকার আফজালুল হক সেই বাড়িতে আসেন। কবিতাটি পড়ে শুনালে তিনি এক কপি সঙ্গে নিয়ে যান। দুপুরের আগে বাসায় এসেছিলেন শ্রী অবিনাশ ভট্টাচার্য। তিনি জানান 'মোসলেম ভারত' কবে বের হবে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। এরপর 'অবিনাশদা'র কথায় তাকে আরেকটি কপি পেন্সিলে লিখে দেন। ৬ জানুয়ারি ১৯২২, বৃষ্টিস্নাত শুক্রবার, সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয় সেই কবিতাটি। কালজয়ী সেই কবিতার নাম 'বিদ্রোহী'; কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

প্রকাশ হওয়া মাত্রই বাংলা সাহিত্য জগতে সাইক্লোন বয়ে গেল। শীতকালের অকাল বৃষ্টির মধ্যেও চাহিদা ছিল আকাশচুম্বী। জানুয়ারির সেই সপ্তাহে দু'বার প্রকাশ করতে হয়েছিল বিজলী পত্রিকা। সাইক্লোনের বেগে চাহিদা বাড়তে থাকলে পরবর্তীতে 'মোসলেম ভারত', 'প্রবাসী', 'সাধনা', 'ধূমকেতু'সহ আরও অসংখ্য নামী-বেনামি, খ্যাতনামা-অখ্যাত-নামা পত্রিকা প্রকাশ করতে থাকে 'বিদ্রোহী'। জনমনে এই পরিমাণ আলোড়ন সৃষ্টিকারী কোনো কবিতা এর আগে, পরে বা সমকালে বাংলা জগৎ দেখেনি।

কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেন, "সেদিন ঘরে বাইরে, মাঠে-ঘাটে রাজপথে সভায় এ কবিতা নীরবে নয়, উচ্চকণ্ঠে শত শত পাঠক পড়েছে। সে উত্তেজনা দেখে মনে হয়েছে যে, কবিতার জ্বলন্ত দীপ্তি এমন তীব্র যে ছাপার অক্ষরই যেন কাগজে আগুন ধরিয়ে দেবে। ... গাইবার গান নয়, চীৎকার করে পড়বার এমন কবিতা এ দেশের তরুণরা যেন এই প্রথম হাতে পেয়েছিল। তাদের উদ্দাম হৃদয়ের অস্থিরতারই এ যেন আশ্চর্য প্রতিধ্বনি।"

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বলেছেন, "এ কে নতুন কবি? নির্জীব দেশে এ কার বীর্যবাণী? শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, সমগ্র দেশ প্রবল নাড়া খেয়ে জেগে উঠল। এমনটি কোনোদিন শুনিনি, ভাবতেও পারিনি। যেন সমস্ত অনুপাতের বাইরে, যেন সমস্ত অঙ্কপাতেরও অতিরিক্ত... গদগদ-বিহ্বলের দেশে এ কে এল উচ্চ-বজ্রনাদ হয়ে। আলস্যে আচ্ছন্ন দেশ আরামের বিছানা ছেড়ে হঠাৎ উদ্দণ্ড মেরুদণ্ডে উঠে দাঁড়ালো।"

ভাব, ভাষা, ছন্দ—সব কিছুতেই আমরা দেখতে পাই চিরাচরিত নিয়মকে ভেঙে ফেলার তাড়না। এই কবিতার মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যকে তিনি প্রথম পরিচিত করান সমিল প্রবহমান মাত্রাবৃত্ত ছন্দের সাথে। এর পূর্বকার বাংলা কবিতার পাঠক ও লেখক দুটোই ছিল ঔপনিবেশিক মানসিকতায় পঁচে যাওয়া ইংরেজি শিক্ষায় গর্বিত মধ্যবিত্ত বাঙালি শ্রেণী। তখনকার কবিতাগুলো লেখা হতো 'দুজনে যুগল প্রেমের স্রোতে' ভেসে যাওয়ার জন্য কিংবা সৌখিন ড্রয়িংরুমে বসে ভাবনা-বিলাস করার জন্য। 'বিদ্রোহী' কবিতা আত্মপ্রকাশ করেই ইউরোপীয় 'উন্নত রুচি', 'সূক্ষ্ম সৌন্দর্য' ও 'বাবুকালচার'কে দূরে সরিয়ে প্রথম ঔপনিবেশিক যুগের গণমানুষের স্বর হয়ে উঠতে পেরেছিল।

এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তূর্য নিয়ে সদ্য প্রথম প্রেমের পরশ আর বিচ্ছেদের স্বাদ পাওয়া যুদ্ধ ফেরত সৈনিক কবি প্রেম ও দ্রোহের, সৌন্দর্য ও নিয়মহীনতার, স্নিগ্ধতা ও বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের যে একীভূত রূপ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন, তা এর আগে বিশ্ব কখনো দেখেনি। ইসলামের ঐতিহ্যের সাথে গ্রিক ও হিন্দু পুরাণের যে মিশেল তিনি ঘটিয়েছেন, তা কল্পনাতীত।

ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ এবং সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়া 'বিদ্রোহী'-ই প্রথম ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলাবদ্ধ মানুষের মুখে বসিয়েছিল:

"আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি নাকো কোনো আইন...!"

কল্পতরু সেনগুপ্তের মতে, "এই কবিতা বাংলার বিপ্লববাদীদের ঘোষণাপত্রের ভূমিকা পালন করেছে। সর্বপ্রকার ভীরুতা ও দীনতা থেকে মুক্ত হয়ে এগিয়ে চলার সাহস যুগিয়েছে। ....এ কবিতা সেই সময়ের তরুণ প্রজন্মকে সংগ্রামে সংঘবদ্ধ হতে, কারাগারের অন্ধকার আর ফাঁসির মঞ্চকে অগ্রাহ্য করতে এবং মৃত্যুকে তুচ্ছ করতে সাহস যুগিয়েছে।"

এটি যেমন লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছিলো, তেমনি ব্রিটিশ সরকারের সাথে সাথে সমাজের বহু গোড়া ও সুশীলের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলো। প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথেই দুই ধর্মের ধার্মিকগণ ধর্মরক্ষার্থে তাদের অস্ত্র: হীন ভাষা, হীনতর প্রজ্ঞা, এবং হীনতম মানসিকতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন নজরুলের উপর। প্রথম আঘাতটা হানে স্বজাতি মুসলিমরাই। তারা এই 'নরাধম' 'ধর্মদ্রোহী' 'কাফের' শয়তানের বিরুদ্ধে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ আনেন।

বিদ্রোহী-তে নজরুল লিখেছেন:
‘ভ্যূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর।’

এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মুন্সী মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দিন আহমদ বলেন, "এ উদ্দাম যুবক যে ইসলামি শিক্ষা আদৌ পায় নাই তাহা ইহার লেখার পত্রে পত্রে ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পাইতেছে। হিন্দুয়ানি মাদ্দায় ইহার মস্তিষ্ক পরিপূর্ণ। ...নরাধম হিন্দু ধর্মের মানে জানে কি? ...এই রূপ ধর্মদ্রোহী কুবিশ্বাসীকে মুসলমান বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে না। লোকটা মুসলমান না শয়তান?"

আরেক ধাপ অগ্রসর হয়ে ইসলাম রক্ষায় নেমে, যেন নিজেই নিজেকে আল্লাহর প্রতিনিধি ভেবে, যশোরের কবি গোলাম মোস্তফা নজরুলকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে 'নিয়ন্ত্রিত' নামক কবিতায় লেখেন:

"ওগো বীর,
সংযত কর, সংহত কর, ‘উন্নত’ তব শির,
‘বিদ্রোহী’- শুনে হাসি পায়,
বাঁধন- কারার কাঁদন কাঁদিয়া বিদ্রোহী হতে সাধ যায়?
সেকি সাজে রে পাগল সাজে তোর?
আপনার পায়ে দাঁড়াবার মত কতটুকু জোর আছে জোর?
ছি ছি লজ্জা, ছি ছি লজ্জা!..."

গোলাম মোস্তফার এ কবিতাকে অবশ্য নজরুল গালাগাল হিসেবে গণ্য করেননি, বরং 'জবাব' হিসেবেই নিয়েছিলেন। কিন্তু অন্যদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন গালাগাল আর অভিশাপ।

হিন্দু সমাজও তাঁকে ‘সাম্প্রদায়িক’ ও ‘উগ্রমুসলমান’ বলে গালাগাল করেছিলো। ব্যথিত নজরুলের ভাষ্য: "কয়েকজন গোড়া ‘হিন্দুসভা’ওয়ালা তাহার নামে মিথ্যা কুৎসাও রটনা করিতেন। ইহাদিগকে আঙ্গুল দিয়া গণনা করা যায়, ইহাদের আক্রোশ সম্পূর্ণ সম্প্রদায় বা ব্যক্তিগত। আজকাল কার সাম্প্রদায়িক মাতলামির দিনে, আমি যে মুসলমান ইহাই হইয়া পড়িয়াছে অনেক হিন্দুর কাছে অপরাধের সামিল আমি যত বেশি অসম্প্রদায়িক হই না কেন?"

আরবি, ফার্সি শব্দের সাথে সংস্কৃত শব্দের মিলবন্ধনকে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সমাজ মেনে নিতে পারেনি। অলংকারজ্ঞাণহীন মূর্খদের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিলো দ্রোহে ভরা ব্রিটিশবিরোধী নিম্নোক্ত চরণগুলো:

"আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিব পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালি বিধির বক্ষ কবির ভিন্ন।..."

এবং অন্যত্র:

"আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়।
জগদ্বীশ্বর ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল-মর্ত্য!"

আক্রমণ এসেছিল প্রিয়জনদের কাছ থেকেও। নজরুলের 'খেয়াপারের তরণী' কবিতা পড়ে বছর দেড়েক আগে মুগ্ধ হয়েছিলেন কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার। নজরুল গুরুর ন্যায় শ্রদ্ধা করতেন তাকে, মোহিতলালও দিয়েছিলেন ছোট ভাইয়ের আসন। ১১ বছরের ছোট নজরুলকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন পাশ্চাত্য সাহিত্যের সাথে, সাথে করে নিয়ে যেতেন সকল সাহিত্য আসরে; পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন দেশের অনেক বড় বড় সাহিত্যিকের সাথে। মাঝে মাঝে নজরুলের কবিতা শুনতেন, কখনো সখনো নিজের কবিতা শুনিয়ে কিশোর কবির মূল্যায়ন চাইতেন। একদিন শুনিয়েছিলেন নিজের লেখা 'আমি' প্রবন্ধটি। প্রবন্ধটির কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি...

আমি
(শ্রীমোহিতলাল মজুমদার বি.এ.)

আমি বিরাট। আমি ভূধরের ন্যায় উচ্চ, সাগরের ন্যায় গভীর, নভো-নীলিমার ন্যায় সর্বব্যাপী।...

আমি ভীষণ,—অমানিশীথের সমুদ্র, শ্মশানের চিতাগ্নি, সৃষ্টি নেপথ্যের ছিন্নমস্তা, কালবৈশাখীর বজ্রাগ্নি, হত্যাকারীর স্বপ্নবিভীষিকা, ব্রাহ্মণের অভিশাপ, দম্ভাব্ধ পিতৃরো। আমি ভীষণ,—রণক্ষেত্রে রক্তোৎসবের মতো, আগ্নেয়গিরির মগ্নিবমনের মতো, প্রলয়ের জলোচ্ছ্বাসের মতো, কাপালিকের নরবলির মতো, সদ্যশোকের মতো, অখণ্ডনীয় প্রাক্তনের মতো...

আমি মধুর—জননীর প্রথম পুত্রমুখ চুম্বনের মতো, ... প্রণয়িনীর সরম-সঙ্কোচের মতো,... আমি করুণার অশ্রুজল, প্রেমের আত্মত্যাগ, স্নেহের পরাজয়।... আমি শনির উপরে বৃহস্পতি, শয়তানের পার্শ্বে জেহোবা, আহিমান-শত্রু ওরমজদ, মারবিজয়ী নির্বাণ দেবতা। শ্মশানকুল বাহিনী জাহ্নবী, নিশীথ অন্ধকারে প্রস্ফুটিত ফুলদল, অসহায় ক্রন্দনের উপাসনা।...

বলাই বাহুল্য, ব্যাপক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও 'আমি ভূধরের ন্যায় উচ্চ'কে 'শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!' এর সাথে; 'প্রণয়িনীর সরম-সঙ্কোচ' এর সাথে 'গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল-করে দেখা অনুক্ষণ'; 'ব্রাহ্মণের অভিশাপ' এর 'ক্ষ্যাপা দুর্বাসা' সহ অজস্র চরণের সাদৃশ্য আছে।

এসকল সাদৃশ্যের কারণে, চারদিকে যখন বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে শোরগোল বেধে গেছে, তখন মোহিতলাল সবাইকে বলে বেড়ান নজরুল 'আমি' প্রবন্ধের 'ভাব' গ্রহণ করে এই কবিতা লিখেছেন। কিন্তু নজরুল অস্বীকৃতি জানানোয় ও ঋণ স্বীকার না করায় তিনি ক্ষুব্ধ হন এবং বিখ্যাত কবিদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপকারী কুখ্যাত শনিবারের চিঠি পত্রিকার সাথে যোগ দেন। এর পূর্বে মোহিতলাল এই হীন মানসিকতার পত্রিকার একজন কঠোর সমালোচক ছিলেন। মোহিতলাল যোগ দেওয়ার পরপরই সজনীকান্ত দাস 'বিদ্রোহী' কবিতাকে ব্যঙ্গ করে 'ব্যাঙ' নামের একটি জঘন্য প্যারোডি লেখেন।
ব্যাঙ কবিতার কিছু লাইন এরকম:

আমি ব্যাঙ।
লম্বা আমার ঠ্যাং
ভৈরব রভসে বরষা আসিলে
ডাকি যে গ্যাঙোর গ্যাঙ।
আমি ব্যাঙ...
দুইটা মাত্র ঠ্যাং।...

সজনীকান্ত দাস লিখলেও, স্বয়ং মোহিতলাল এই কবিতার এত বেশি প্রচার করেন যে নজরুল ভেবে বসেন এই কবিতা মোহিতলালেরই লেখা। বন্ধুদের পিড়াপিড়িতে নজরুল তখন মোহিতলালকে উদ্দেশ্য করে লেখেন 'সর্বনাশের ঘণ্টা'। এই কবিতায় নজরুল নিজেকে অর্জুন ও মোহিতলালকে দ্রোণ হিসেবে উপস্থাপন করে তার বিরুদ্ধে আনীত 'ভাবচুরির' অভিযোগের প্রতিবাদ জানান। এছাড়াও, মোহিতলালের শনিবারের চিঠির সাথে যোগদানের ঘটনাকে দ্রোণাচার্যের কৌরবপক্ষে যোগদানের সাথে তুলনা করে নিজের অভিমান প্রকাশ করেন ও কিছুটা ভর্ৎসনা করেন। কবিতার কিছু লাইন এরকম:

"চিরদিন তুমি যাহাদের মুখে মারিয়াছ ঘৃণা-ঢেলা,
যে ভোগানন্দ দাসেদের গালি হানিয়াছ দুই বেলা,
আজ তাহাদেরি বিনামার তলে আসিয়াছ তুমি নামি
বাঁদরেরে তুমি ঘৃণা করে ভালবাসিয়াছ বাঁদরামি।...
যদিই অসতী হয় বাণী মোর, কালের পরশুরাম
কঠোর কুঠারে নাশিবে তাহারে, তুমি কেন বদনাম
কিনিতেছ গুরু! কেন এত তব হিয়া-দগ্‌দগি জ্বালা?
হোলির রাজা কে সাজাল তোমারে পরায়ে বিনামা-মালা?
তোমার গোপন দুর্বলতারে, ছি ছি করে মসীময়
প্রকাশিলে গুরু, এই খানে তব অতি বড় পরাজয়।
তুমি ভিড়িও না গো-ভাগাড়ে-পড়া চিল-শকুনের দলে,
শতদল-দলে তুমি যে মরাল শ্বেত-সায়রের জলে।..."

এই কবিতা পড়ে মোহিতলাল অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং নজরুলকে গালাগাল ও অভিশাপ দিয়ে এর জবাব দেন, 'দ্রোণ–গুরু' কবিতায়। এই কবিতায় নজরুলকে তিনি মহাভারতের কর্ণের সাথে তুলনা করেন, যে শুদ্রের ঘরে জন্ম নিয়েও ক্ষত্রিয় হবার স্বপ্ন দেখতো। এই কবিতায় নজরুলকে তিনি 'হীন জাতি', 'চোর' সম্বোধন করে সাম্প্রদায়িকতার চরমে পৌঁছে যান। কবিতাটির কিছু লাইন:

"আমি ব্রাহ্মণ, দিব্যচক্ষে দুর্গতি হেরি তোর—
অধঃপাতের দেরি নাই আর, ওরে হীন জাতি-চোর!
আমার গায়ে যে কুৎসার কালি ছড়াইলি দুই হাতে—
সব মিথ্যার শাস্তি হবে সে এক অভিসম্পাতে,
গুরু ভার্গব দিল যা তুহারে! ওরে মিথ্যার রাজা।
আত্মপূজার ভণ্ড পূজারী! যাত্রার বীর সাজা
ঘুচিবে তোমার, মহাবীর হওয়া মর্কট-সভাতলে!
দুর্দিনের এই মুখোশ-মহিমা তিতিবে অশ্রুজলে!
অভিশাপরূপী নিয়তি করিবে নিদারুণ পরিহাস
চরমক্ষণে মেদিনী করিবে রথের চক্র গ্রাস!"

এই কাদা ছোড়াছুড়ি অনেক দূর গড়িয়েছিল। 'বিদ্রোহী'র সাথে 'আমি'র খানিকটা শব্দ ও গঠনগত মিল আছে, এ কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু ভাবগত মিল একেবারেই নেই। নজরুলের কাব্যিক ঝংকার ওই নীরস গদ্যের ভাবচুরি করে লেখা, এ কথা কারোর বিশ্বাস হবার কথা নয়। কিছুটা প্রভাব থাকতে পারে, কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই 'ভাবচুরি'র পর্যায়ে নয়। নজরুল এই 'ভাবচুরি' মোকদ্দমার রায়টা কালের হাতে ছেড়ে দিয়ে বলেছিলেন:
"আমার মৃত্যু লিখিবে আমার জীবনের ইতিহাস—
ততদিন সখা সকলের সাথে করে নাও পরিহাস!"

ইতিহাস এই মোকদ্দমার ফয়সালা অনেক আগেই করে নজরুলের 'চির উন্নত শির' বজায় রেখেছে। একদিন যারা তাকে কাফের আখ্যা দিয়েছিল, আজ তারাই তাকে 'বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি' প্রমাণের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এককালের নাক সিটকানো হিন্দুরা আজ তাকে 'অসাম্প্রদায়িক', 'কালীভক্ত' প্রমাণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। 'চির উন্নত শির' নজরুল হয়তোবা এতে হাসছেন, কেননা শয়তানের গালাগাল যদিওবা সহ্য করা যায়, স্তুতি সহ্য করা যায় না। শয়তান দেবতার স্তুতি করলে দেবতার মাহাত্ম্য বাড়ে না, বরং দেবতা পড়েন দুর্বিপাকে।