এবছরের জুনের প্রথম দিকে হঠাৎ একদিন মনে হয়েছিলো ভালোবাসা সবার জীবনে আশীর্বাদ বা অফুরন্ত জীবনীশক্তি নিয়ে আসে না; কারো কাছে আসে অভিশাপ হয়ে— আমৃত্যু নিঃসঙ্গতার বার্তাবাহক হিসেবে। সবার জন্য নচিকেতার 'প্রতিবার প্রেমে নতুন জীবন' কিংবা হুমায়ুন আজাদের 'প্রতিটি প্রেমই প্রথম প্রেম' তত্ত্ব সত্য নয়। এরকম একজন মানুষের জীবনকে ভালোবাসা কিরকম উষর করে দিতে পারে তা কেন্দ্র করেই লিখেছিলাম 'আকাল' কবিতাটি। যে সময় লিখেছিলাম সে সময় সদ্য প্রয়াত কবি হেলাল হাফিজের কথা মাথায় ছিলো না— কিন্তু আজ মনে হচ্ছে কবিতাটি যদি পৃথিবীর একজন মানুষের জীবনের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ হয়, তিনি হলেন হেলাল হাফিজ।

কবিতাটির কিছু লাইন এরকম:

শরতের সেই শেষ সন্ধ্যায়
কোনো এক বিধ্বস্ত বেখেয়ালি বৃহস্পতিবার
একঝাঁক জোনাকির আলোয়
একজোড়া চোখে চোখ রেখেছিলো হৃদয় আমার।
তারপর থেকে এ জীবনে ভালো লাগে নাই
কক্ষনো কোনো কিছু কোনোদিন আর!

সেই শেষবার ভালো লেগেছিল দুটি ক্লান্ত চরণ,
বিষণ্ণ চশমার আড়ালে একজোড়া করুণ নয়ন;
কৃষ্ণচূড়ার মতো একটা মানুষ বহুদিন
চোখে গেঁথেছিল— বহুক্ষণ, বহুকাল বিমর্ষ মলিন
এক নিষ্পাপ মুখে হয়েছিল হৃদয় নাকাল!
তারপর দুচ্ছাই! কী আকাল
নামলো জীবনে। ...

একে একে
কত কিছু এলো গেল সেই থেকে:
কত শরত, হেমন্ত এসে হয়ে গেছে ফিকে,
শিশিরের শুভ্রতায় চারদিকে
কতবার দূর্বা গজিয়েছে। শীতার্ত বসুমতী
কত করে রাঙাতে চেয়েছে এ মন, কত শত সরস্বতী
চোখের সামনে সব রূপসীর জমিয়েছে ভিড়-
কচি হলদিতে ঘষে মুখ, মন আর তাদের শরীর
দিয়ে করিয়েছে ছল— মায়াময়ী জাল
বিছিয়েছে কত দিন। তবু ক্ষণকাল
এই মন ধায়নি সে পানে...

অবশেষে
কোকিলের ডাকে বসন্ত এসে
চারিদিকে বিছিয়েছে রঙ, সাজিয়েছে ফুলের বাহার।
তবু সেই শেষ বিধ্বস্ত বেখেয়ালি বৃহস্পতিবার
থেকে এ জীবনে ভালো লাগে নাই,
কক্ষনো কোনো কিছু কোনোদিন আর!

ভালবাসার কাছে সবকিছু, এমনকি জীবনকে পর্যন্ত, তুচ্ছ করে দেওয়া উচিত কিনা সে ফয়সালা নৈয়ায়িক কিংবা দার্শনিকরা করবেন। হেলাল হাফিজরা মূর্খ না বুদ্ধিমান, নিখাদ প্রেমিক নাকি একগুঁয়ে, জীবনমুখী নাকি জীবনবিমুখী তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে— কিন্তু যা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে না তা হলো হেলাল হাফিজরা ভালোবাসতে পারেন কিনা। হেলাল হাফিজ আমাদের শেখায় যে পৃথিবীতে অন্তত এখনো কিছু মানুষ আছে যারা ভালোবাসার কাছে,— তা ভালোবাসা বলতে যা-ই বুঝাক না কেন, জীবনকে তুচ্ছ করে দিতে পারে;— জীবনকে নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারে।

জীবনানন্দ দাশ প্রেমের অমরতা ও দীর্ঘস্থায়িত্ব নিয়ে সংশয়ী ছিলেন— গল্প, উপন্যাসের মতো কবিতায়ও তিনি “হৃদয়ে প্রেমের দিন কখন যে শেষ হয়, ছাই শুধু পড়ে থাকে তার…”, “প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়…” এর মতো পঙক্তি রচেছেন। এ ব্যাপারে তার সাথে দ্বিমত প্রকাশের স্পর্ধা খুব কম লোকেরই আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশ্বাস, সময় এতটাও নির্মম নয় যে সে আজীবন মানুষকে হৃদয়ে, অ্যাশেজ ট্রফির মতো, প্রেমের ছাই বয়ে বেড়ানোর যন্ত্রণা দেবে। কোথাও একটা লিখেছিলাম:

সময় নির্মম নয়: সব কিছু ভুলে গিয়ে বাঁচার
সুযোগ সে করে দেয় বারবার
অবিরত জীবনের পথে হেঁটে চলা আহত
পথিকদের; সব দগদগে দাগ— সব বীভৎস ক্ষত
সে আড়াল করে দেয় স্নেহার্ত জননীর মতো।

সময়ের সহযোগিতায় তাই পৃথিবীর কাউকে বা কোনো কিছুই ভুলে যাওয়া কঠিন নয়— অসম্ভব তো নয়ই। ভুলে যাওয়াই সহজ, বরং চিরকাল কাউকে মনে রাখাটাই কঠিন। আর হেলাল হাফিজরা এই কঠিন কাজটাই করে যান; আজীবন স্মৃতি ও সম্মানের জলধারায় ভালোবাসার বীজকে মহিরুহের রূপদান করে চলে যান। ভালোবাসার জন্য তারা জীবন নিয়ে ছেলেখেলা অবশ্যই করতে পারেন কিন্তু ভালোবাসা তাদের কাছে কোনো ছেলেখেলা নয়, কোনো খামখেয়ালিপনা নয়, কোনো জয়-পরাজয় সংগ্রাম নয়— একটা নিখাদ বোধ। হয়তো অস্ফুট মুদ্রাদোষে তারা প্রায়ই স্বগতোক্তি করেন:
"ভুলে যাওয়া যায় বলে যদি ভুলে যাই
তবে মেকি এ প্রেমের বুলি; তবে তো বৃথাই
এই ভালোবাসা-বাসি।..."

কিছুদিন আগে এক বিখ্যাত প্রেমিককে দেখেছিলাম কীভাবে সে বিসিএসে এ দেশ সেরা হয়ে তার প্রাক্তনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছিলেন; কাফি নামক এক মহামারী কনটেন্ট ক্রিয়েটর— এক কালোত্তীর্ণ মোটিভেশনাল স্পীকারকে দেখেছিলাম 'কখনোই প্রাক্তনকে ক্ষমা করবেন না' মোটিভেশন দিতে; শ্রদ্ধেয় নজরুল ইসলামকে দেখেছিলাম প্রাক্তনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে নিম্নোক্ত অর্ঘ্য প্রদান করতে:

"নারী নাহি হ’তে চায় শুধু একা কারো,
এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো!
ইহাদের অতিলোভী মন
একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়,
যাচে বহু জন।..."

একজন হেলাল হাফিজই হয়তো পারেন এযাবৎ জন্ম নেওয়া সকল সুশান্ত পালদের তাবৎ ভালোবাসা বোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যেতে।