কৈশোরে পৌঁছে
মাত্র দু’চার দিনের ফারাকে
একে একে বাপ-মা দু’জনকেই হারিয়ে ফেলে
মুতালিব আলি। প্রথমে
এক ব্যাপক অমাবস্যা কাফনের মতো এঁটে গেল
ওর সত্তায়। কিন্তু একদিন শরতের রোদ্দুর
ওর কৈশোরকে হাত ধরে পৌঁছে দিলো
যৌবনে।
মধ্য যৌবনে মুতালিব আলির
ঘরে এল এক-গা চমকিলা যৌবন নিয়ে
এক কনে। ওকে দেখলে অবশ্য
কু’চবরণ কন্যার মেঘবরণ চুলের কথা মনে পড়েনা।
কিন্তু একেবারে ফ্যালনাও নয়
সে মেয়ের রূপ। এক ধরনের মাধুর্য ওর
সারা মুখ জুড়ে
খেলা করে বিকেলবেলার আলোর মতো।
একদিন মুতালিব আলির খালি ঘরে
তার ঘরণীর কোলে মাণিকের
আভা ছড়িয়ে খোকা এল। দিন যায়, খোকা
মায়ের কোল ছেড়ে উঠোন পেরিয়ে
রাস্তায় যায়। মিছিলে আওয়াজ তোলে, সে আওয়াজে
দোলে সারি সারি কুর্শি,
চলে জোর কদম। গুলি খায়,
লুটিয়ে পড়ে ভবিষ্যতের দিকে মুখ রেখে।

বুকের একমাত্র মাণিককে হারিয়ে
মা বিলাপ করে। মুতালিব আলি কাঁচা-পাকা
চুলভর্তি মাথা নিয়ে
বসে থাকেন রঁদ্যার মূর্তির মতো। কাল, বিখ্যাত শুশ্রুষাকারী,
তাকে মাঝে মধ্যে রক্তকরবীর গুচ্ছ এবং
কোত্থেকে উড়ে-আসা
পাখির পুচ্ছ থেকে চোখ সরাতে দেয় না।
মুতালিব আলি অফিসে যান,
সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময়
গুনগুনিয়ে সুর ভাঁজেন পুরানো গানের।

এক হেমন্তসন্ধ্যায় মুতালিব আলির
গৃহিনী, জয়তুন খাতুন,
বুকের বাঁদিকটা চেপে ধরে টলে পড়লেন, সারা দুনিয়া
দুলে উঠলো খোকার শৈশবের দোলনার মতো! তারপর
আর তিনি উঠে দাঁড়াননি
গা ঝাড়া দিয়ে।
মুতালিব আলি এখন একা, ভীষণ একা,
একেবারে একা। এখন
তার জীবন যেন খুব সান্নাটা এক গোরস্তান।
দিন যায়, চুলে আরো বেশি পাক ধরে, মুখের ভাঁজগুলি
হয় গাঢ়তর। দিন যায়, পূর্ণিমারাতে
বলক-দেওয়া দুধের ফেনার মতো জ্যোৎস্না
ছড়িয়ে পড়ে উঠোনে, জানলা গলে
লুটিয়ে পড়ে খাঁখাঁ বিছানায়। দক্ষিণ দিক থেকে
এক ঝাঁক স্বপ্নের মতো হাওয়া আসে, ভালো লাগে,
মুতালিব আলির ভালো লাগে।

   (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ)