সমরেশদা, কী করে জানবো বন্ধু রশীদ করীমের ভাড়াটে
ফ্ল্যাটবাড়িতে সেই রাতেই হবে
আপনার সঙ্গে আমার শেষ দেখা? কী করে জানবো
আর কোনোদিনই স্মৃতির সহায়তা ছাড়া
দেখবো না আপনার অবিশ্বাস্য সুন্দর
হাসি উদ্ভাসিত মুখ?
চারজনের নরক গুলজার করা আড্ডা। আপনি, জিল্লুর,
খোদ মেহমান নেওয়াজ গৃহকর্তা আর আমি। কখন যে নগ্নিকা
সন্ধ্যার আব্রু ঢাকা পড়লো রাত্রির জমকালো আলোয়ানে,
টের পাই নি। অবিশ্যি আসরের মুল গায়েন
ছিলেন আপনি আর আমরা স্বেচ্ছায়
মেনে দিয়েছিলাম, দোহারের ভূমিকা। যখন কথার
রেণুসমূহ ঝরে পড়েছিল আপনার
ভেজা-ভেজা ঠোঁট থেকে, ভাবছিলাম কত নারীর
মন জয় করেছে এই হাসি, কথা বলার ঢঙ এবং
মুখাবয়ব। ইরানী এক মহিলা কবি বিষয়ে
বলতে গিয়ে, লক্ষ করলাম, আপনার চোখে হাফিজের গজল,
উজ্জ্বল দু’টি বাহু, আর
যৌবনদীপ্ত উদ্ধত বুক আর কবরে-নুয়ে-পড়া
গোলাপের ছায়া। তখন আপনার ক্লান্তি গ্যাছে অস্তাচলে।
সমরেশদা, একসময় আমাদের সেই আসর ছেড়ে
চলে গেল জিল্লুর, বাড়ি ফেরার
তাড়া ছিল ওর। কথাবার্তার ফাঁকে এক সময়
হঠাৎ বললেন আমাকে, ‘আসুন, এখন থেকে আমরা
একে অন্যকে তুমি বলি, কী জানেন, আপনি, কথাটার
মধ্যে দূরত্ব বেশ ঘাড় বেঁকিয়ে বসে থাকো
আপনি, সমরেশদা, আমাকে তুমি বলতে গিয়ে, মনে পড়ে,
বেশ কয়েকবার হোঁচট খেলেন। যখন ‘তুমি’ আপনার
কণ্ঠে সাবলীল খেলা শুরু করলো,
তখনও আমি সংকোচে বিহ্বল, খানা-খন্দে পড়ে যাওয়া
মানুষের মতো লুটোপুটি খাচ্ছি। বহু চেষ্টা করেও
আমার আপনাকে আর তুমি বলা হলো না।
সমরেশদা, কী করে মেনে নেবো আপনার মতো
একজন তারুণ্যে টগবগে মানুষ
আর নেই কলরবময় কলকাতায়, অন্য কোথাও নেই?
কী করে মেনে নেবো মৃত্যুর এই প্রহারকে,
যা আপনাকে নিমেষে চূর্ণ করেছে অভ্রগুড়োর মতো?
হায়, এখন আপনি
বিলীন পঞ্চভূতে এবং জীবন্ত শুধু অগণিত শব্দের সংসারে।
আপনারা আত্মা কি বিবর থেকে বেরিয়ে
উড়ে গ্যাছো উর্ধ্বলোকে প্রজাপতির মতো? এখন আপনি
অনেক দুর্ভাবনা থেকে মুক্ত; উপন্যাসের
কিস্তি শেষ করার তাগিদ নেই নাছোড় সম্পাদকের
তরফ থেকে, তাড়া নেই অর্থ উপার্জনের,
আপনি এখন মুক্ত ভনভনে স্বাক্ষরশিকারিদের
হৈ-হল্লা থেকে, সমালোচকদের হুল-ফোটানো কলমের
খোঁচা থেকে, স্খলনের অপবাদ
বয়ে বেড়ানো থেকে। মৃত্যু ঢালের ধরনে
আড়ালে রেখেছে আপনাকে বহুরূপী ঝুটঝামেলা থেকে।
এমন এক সময় ছিল, যখন মৃত্যুভয়ে
আমার রক্তে তুষার জমে যেতো। মৃত্যুর ওপর
ভীষণ্ন রাগ হতো আমার,
কেননা বহু মহাত্মা, মনীষী আর শিল্পীকে
শিকার করেছে সেই নির্বিকার
নিষাদ, আপনিও রেহাই পেলেন না তার
তীর থেকে। এখন বুঝি, বৃথা এই ভয়, ক্রোধ কিংবা ঘৃণা।
এর কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করে না,
অপ্রতিদ্বন্দ্বী দাবাড়ুর মতো সে খেলে চলেছে
নিজের খেলা। আমরা যারা ওর বোড়ে,
তারা ঘায়েল হচ্ছি নির্ধারিত কালে। তাই, বাটি থেকে
সমস্ত দুধ মাটিতে পড়ে গেলে
যেমন কপালে করাঘাত করলে কোনো লাভ নেই,
তেমনি নিষ্ফল মৃত্যুর বিরুদ্ধে অপটু অভিনেতার মতো
তর্জন গর্জন করা। শেষ অব্দি মেনে নিতেই হয়
যে-কোনো চলে-যাওয়া প্রতিবাদ ফেনা হয়ে উবে যায় হাওয়ায়।
একদা আপনি সওয়ার হয়েছিলেন
আগুন রঙের এক বলীয়ান ঘোড়ায়। তার
দাপটে কেঁপে উঠেছিল
ধনিক গোষ্ঠীর ভিত। কিন্তু কী যে হলো একদিন
স্বেচ্ছায় সেই ঘোড়ার জিনচ্যুত হলেন। সে রাতে এর কারণ
জানতে চেয়েছিলাম আপনার কাছে। কে না জানে
আধুনিক বাংলা গদ্যশৈলীর
আপনি এক প্রধান স্রষ্টা। আপনি সেই গদ্যের
কলাকৌশল গলায় খেলিয়ে
উত্তর দিতে চেষ্টা করলেন। মাফ করবেন,
আপনার উক্তিতে মাধর্য ছিল যত বেশি,
যুক্তি ছিল ততটা কম। আপনাকে মনে হচ্ছিল
সেই ক্লান্ত পাখির মতো যে
আটকে গ্যাছে আগুনধরা সরোবরে। সমরেশদা,
হয়তো আপনার কাছে
আগুন রঙের ঘোড়ার নিঃশ্বাসের আঁচ অসহ্য ঠেকেছিল!
আমার এই তুচ্ছ লেখা কি বিবেচিত হবে
শোকগাথা হিসেবে? এখন যে বলপেন দিয়ে দিখছি,
তার চোখে শোকের কুয়াশা কোথায়? কোথায়
সেই হাহাকার তার গলায়
যা শুনে ডুকরে উঠবে প্রতিটি পংক্তি? সমরেশদা,
কী ব্যর্থ আর অসহায় এই লোক,
যে আপনার যোগ্য একটি শোকগাথাও আজ
রচনা করতে পারলো না।
নিজেকে ধিক্কার দেয়া ছাড়া কী-ই বা আর
করতে পারে সে? হাতের কলমটাকে টুকরো টুকরো করে
ভেঙে ফেলা ছাড়া কী আর
করার আছে তার? কখনো হয়তো কোনো নির্ঘুম রাতে
আপনার কোনো লেখা পড়ে, কোনো কথা ভেবে
অথবা গ্লাশে চুমুক দেয়ার ভঙ্গি মনে করে
আমার অন্তরাত্মা হু হু করে উঠবে,
কেউ জানবে না।
সমরেশদা, আজ বাতাসের কানে মুখ রেখে
আপনাকে আর্তস্বরে ‘তুমি’ বলে ডাকছি, এই দুনিয়ার
দর্পণ ভেদ করে কি আমার এই ডাক
পৌঁছুচ্ছে তোমার কাছে? পৌঁছুক আর না-ই পৌঁছুক,
এই প্রথমবারের মতো আপনাকে তুমি বলে সম্ভাষণ করলাম,
অথচ তা’ শোনার জন্যে তুমি আর নেই।
(হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ)