ন্যাকামোর শিরশ্ছেদ করেছি অনেক আগে আমি,
গলা টিপে মেরেছি কৈশোরে
গোঁড়ামির একচক্ষু দানোটাকে শিউলিতলায়
পাখি আর হাওয়া
আর নীলকমল ও লালকমলের চন্দ্রালোক চমকিত
গল্প সাক্ষী রেখে। ভাঙো, যত
ব্যবহৃত ছাঁচ ভেঙে ফেলো বলে লোক জড়ো করি
চারপাশে, অথচ নিজেই
আরেক ছাঁচের দিকে এগিয়ে চলেছি সবান্ধব।
মধ্যবিত্ত মেজাজে চায়ের কাপে ঠোঁট রেখে দেখি
আশির দশক মাদী ঘোড়ার মতন পাছা দোলাতে দোলাতে
চলে যাচ্ছে, জরাগ্রস্ত বারান্দায় দাঁড়বন্দি, একা
তোতাপাখি বলে আমাদের
প্রভুর বছরে কত খড়কুটো, রক্তিচিহ্ন মিশে আছে; বিদায় বিদায়।

পুত্রদের তেতে-ওঠা মতবাদঝলসিত কথা শুনে ভয়ে
গলা কাঠ হয়ে আসে, কন্যাদের পতিগৃহে যাত্রা
চোখে তুলে নিয়ে
আমার ভেতর থেকে একজন ব্যথিত পুরুষ
বেরিয়ে সন্ধ্যায় ঘাটে গিয়ে
পানিতে নিজের ছায়া দেখে
ভীষণ চমকে ওঠে। পরিত্রাণ নেই ভেবে মগজের কোষে
কিছু মেঘ ভরে নিয়ে ফিরে আসে স্বগৃহে আবার।
কিছুটা বিভ্রান্ত বটে ইদানীং তবু চোখ কান
খোলা রাখি, সমাজতান্ত্রিক প্রীতি নিয়ে ধান্দাবাজি
ঢের হলো আশপাশে, ধর্মযাজকের সত্তায় প্রবল শান
দেয় খর রাজনীতি। বিপ্লব ফ্যাশন কোনো-কোনো
গুলজার মহলে এবং
ধোপার কুকুর যারা, তাদের নিকট ভীতিটাই
মৌল অতিশয়; ছাগলের ছাল-ছাড়ানো কসাই নিয়মিত
গায় ওহো সাঁই-সাঁই গণতন্ত্রগীতি।
অকস্মাৎ ব্রোঞ্জের চওড়া প্লেট থেকে
বেমক্কা বেরিয়ে পড়ে সুশোভিত ড্রইংরুমের
গালিচায় তিন লাফ দিয়ে
রাঙা চোখ তুলে বিপ্লবের নান্দনিক
ব্যাখ্যা দাবি করে
মহেঞ্জোদারোর ষাঁড় আর
রাবীন্দ্রিক সন্ধ্যার উতল মেঘমালা
ফুঁড়ে চলে যায় স্তব্ধ পূর্ণিমায় পুলিশের গাড়ি।

হায় যৌবনেই বামপন্থা বানপস্থে গেলো বুঝি
গায়ে অস্তরাগ মেখে। নাকি
মাঝে-মাঝে রাগী সজারুর মতো কাঁটা খাড়া করে
ছোটে দিগ্ধিদিক? আমি ভীষণ অস্থির
কম্পাসের মতো আচরণে
জীবনযাপন করি, পূর্ব-পরিচিতা কারো মুখ
ভেবে ভেবে স্ত্রীকে নিয়ে শুতে যাই; আতশী হৃদয়ে
স্বপ্নের কোলাজ ফোটে, আঁধারে তাকাই
কিছু আবিষ্কারের ব্যাকুল প্রতীক্ষায়।
কখনও-কখনও
লোকালয় আর উৎসবের স্তব করতে গিয়ে
কবিত্বের দিব্যতায় গুমসান প্রান্তর এবং
ধ্বংসস্তূপবিষয়ক স্তোত্র লিখে ফেলি।
অথচ আমার চৈতন্যের
খোলা পথে বুগেনভিলিয়া ফুটে থাকে থরে-থরে,
বাজে আনন্দিত রাগমালা।
কোনো-কোনো ঋতুতে এবং অমাবস্যা নেমে এলে
হরিণ লুকিয়ে রাখে মুখ লতাগুল্মে, কাটে তার
কাল, চেষ্টাহীন; শিকারির
পদশব্দে, উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে
নিয়তির ছায়া মিশে থাকে; প্রতীক্ষায় ত্রিকাল দোদুল্যমান।

ফাঁসির মঞ্চের আসামির মতো চাঁদ ঝুলে আছে
সেই কবে থেকে,
বেশ্যালয়ে একদা নতুন মুখগুলি
ক্রমশ পুরনো হচ্ছে এবং রবীন্দ্রনাথ একা
বড় একা আলখাল্লা দুলিয়ে নিশীথে
চলেছেন হেঁটে অ-বনেদী গলি দিয়ে নেয়ামত
দর্জির ঈষৎ বাঁকা উঠোন পেরিয়ে।
এদিকে দাঁতাল বর্বরেরা ঢুকে পড়ে মায়াবনে।
চাদ্দিকে খেমটা নাচ, হল্লাগুল্লা, অবিরত
কাজিয়া ফ্যাসাদ বাড়ে, হামেশাই হয় লোকক্ষয়
জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে, মহাপুরুষের বাণী শত-
শত ক্যানভাসারের কণ্ঠনালী বেয়ে নামে; জয়-
পরাজয় কাদা লেপে দেয় মৃত সৈনিকের হাতে,
স্থির চোখে, ছেঁড়া টিউনিকে। নানাদেশে রাজনীতি-
পরায়ণ ধীমানেরা ধুধু দৃষ্টি ও স্খলিত দাঁতে
কাটাচ্ছেন কাল কারাগারে, কোনোখানে নেই স্থিতি।

টিনোসোরাসেরা মাটি ফুঁড়ে দ্রুত বেরুচ্ছে আবার
পারিপার্শ্বিকের সৌন্দর্যকে তছনছ করে, শুরু হবে
সংহারের পালা, হয়ে যাবে নিমেষে কাবার
বিভিন্ন গর্বিত জাতি, পারবে না বিপুল অগুরু
ঢাকতে লাশের গন্ধ। কূলে-উপকূলে দেশান্তরি
মানুষের ভিড় বাড়ে ক্রমাগত। এত কোলাহল,
তবু কেন এমন নির্জন বাসভূমি? ভ্রষ্ট তরী
কোথায় যে নিয়ে যাবে! চতুর্দিকে খলখলে জল।

স্বপ্নাদ্য সিংহের মতো হেঁটে যাই বিনষ্ট প্রান্তরে
হেঁটে যাই স্বপ্নভস্মময় চোখে উদ্দেশবিহীন।
কুৎসিত মুখোশ আঁটা কতিপয় লোক ঘরে-ঘরে
ছড়ায় আগুন, ঘৃণা-বীজ; জানে নাকো চিরদিন
প্রেমই শুধু কীর্তনের অভীষ্ট বিষয়। যে ব্যথিত
কবি ছিলো এ শহরে, মাথায় ছিলো না শিরস্তাণ
তার; ভুলে যাই রণরোল, জয়ীধ্বনি, অভিযান-
স্মৃতিতে ধারণযোগ্য কিছু নয় কবিতা ব্যতীত।

   (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ)