সূর্যোদয় কখনো দেখেনি বলে তিনটি যুবক
প্রত্যহ একত্র হয়ে ধর্ণা দেয় সূর্যাস্তের কাছে।
‘সূর্যের চুল্লিতে আমি বহুদিন সেঁকেছি আত্মাকে
উল্টিয়ে পাল্টিয়ে, ওহে, তবু দেখি এখানে-সেখানে
থেকে যায় স্যাঁতেসেঁতে কিছু ভাব। অর্থাৎ এখনও
জীবন খোলেনি তার সবগুলি দ্বার সরাসরি,
বস্তুত হাতের পাঁচ অলক্ষ্যে দিয়েছে রেখে, তাই
পৃথিবীর রকে আজও হামাগুড়ি দিই, কেউ-কেউ
‘হাঁটি-হাঁটি পা-পা এইমতো কতো নাবালক ছাঁদে
ক্রমাগত চলেছি হোঁচট খেয়ে প্রতিটি প্রহর।
তালগোল কেবলি পাকিয়ে যায় এই পরজীবী
অস্তিত্বের বিমূর্ত চৌকাঠে। পথে দৌড়ে এসে দেখি
আমার আসার আগে যাত্রীর বান্ডিল নিয়ে ওই
ছেড়ে যায় বাস’- এই বলে সটান মাঠের মরা
ঘাসে শুয়ে দুই-মুখ-ফিরে-আসা সিগারেটে দিল
সুখটান প্রথম যুবক। চেয়ে দ্যাখে প্রায় নেভা
আকাশে সূর্যের স্টোভ সূর্যাস্তের রঙ দেখে তার
মনে পড়ে হঠাৎ মোটরে দেখা মহিলার ঠোঁট।
‘ইয়ার বলেছ তোফা। সেই কবে নড়বড়ে টোলে
জল পড়ে পাতা নড়ে মুখস্থ করেছিলুম জন
ত্রিশেক বালক মিলে ঐকতানে প্রশান্ত সকালে,
দুপুরের অন্ধ-করা রোদে আজ কে কোথায়, ওহে,
পড়েছে যে ছিটকে দূরে। ধড়িবাজ যে লোকটা
দেখাল ঘুঘুর ফাঁদ, একদিন সে-ই জানব না
ছিল চেনা সুবোধ বালক, শ্লেটে যার চকখড়ি
বুলাত আদর্শ জীবনের শর্তাবলি প্রথামতো।
‘ভুলেছি সবার নাম। তাদের মুখের রেখাটুকু
মুছে গেছে স্মৃতির অস্থির ক্যানভাস থেকে আজ।
সূর্যাস্তের রোগা আলো’-অবজ্ঞার ঢিল ছুড়ে দূরে
দ্বিতীয় কথক ভাবে- ‘রাশেদা ভাবীর ম্লান ঠোঁট।
‘নামে কী-বা আসে যায়, বলেছেন, কবি-নাট্যকার;
সত্যি, কী-বা আসে যায় নামে’, বলে তৃতীয় যুবক
ঝাড়ল হাতের ছাই, ‘ধরো এই তোমার নামের
যে-অর্থ দাঁড়ায় তার কতটুকু তুমি? কিন্তু যদি
বলি কেউ আমার নামের খামে মনের খেয়ালে
বসায় তোমার নাম, অথবা আমরা তিনজন
যদি ফের তুলে নিই যে-কোনো তিনটি নাম যার
যেটা ইচ্ছে, তাতে কিছু হবে কি বিশেষ হের-ফের?
‘নেমকহারাম নই, দেখেছি তো আরজি পেশ করে
এই জীবনের কাছে রাত্রিদিন, নেপোয় মেরেছে দইটুকু-
আমরা ক’জন শুধু শুকনো মুখে শূন্য হাতে শেষে
প্রত্যহ এসেছি ফিরে রকবাজ সন্তদের ভিড়ে’,
তৃতীয় যুবক ভাবে ‘মধ্যাহ্নের চিৎকারের পরে
এখনও রয়েছে লেগে আকাশের প্যালেটে যে-রঙ,
তাকি নয় উত্তপ্ত সন্ধ্যায় বন্ধ্যা গণিকার ঠোঁট?’
‘আমার জীবনে সুখ নেই’, প্রথম যুবক বলে।
‘আমার জীবনে সুখ নেই’, বাতাসে দ্বিতীয় স্বর
নকশা আঁকে হিজিবিজি।। চিন্তার কপাটে পড়ে খিল।
‘আমার জীবনে সুখ নেই’, বলে তৃতীয় কথক।
সূর্যোদয় কখনো দেখেনি বলে তারা তিনজন
সূর্যাস্তের কাছে চেয়েছে শিখতে কিছু জীবনের
রসায়ন। প্রথম যুবক দ্যাখে দ্বিতীয়ের চোখে
নেই তার নিজের চোখের মণি, তৃতীয়ের চোখ
সেখানে কাঁপছে মৃদু। দ্বিতীয় কথক দ্যাখে তার
নিজের থ্যাবড়া নাক নিয়েছে প্রথমজন কেড়ে।
হোক না কার্বন কপি পরস্পর, কী-বা আসে যায়
রকবাজ সন্তদের ভিড়ে, ওহে, কী-বা আসে যায়…
প্রাণপণ হেঁকে বলো শূন্যতায় কী-বা আসে যায়।
(রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)